
মাজহারুল ইসলাম মাসুম, সিনিয়র সাংবাদিক, লেখক ও গবেষক :
সৃষ্টি জগত দু’ভাগে বিভক্ত।
বস্তুজগত ও আত্মিক জগত। বস্তু বা দৃশ্যমান জগতের সাথে আমরা দৈহিক ভাবে নানা কলা-
কৌশল তথা নিয়ম পদ্ধতির মাধ্যমে যোগাযোগ করে থাকি। পক্ষান্তরে আত্মিক বা অদৃশ্য জগত
হলো অত্যন্ত সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ও রহস্যময় জগত। এই জগতের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের
জন্য বস্তুজগত বা দৃশ্যমান জগতের যোগাযোগ মাধ্যম সম্পূর্ণ অচল। একমাত্র পরিশুদ্ধ ও
নিয়ন্ত্রিত আত্মার সাহায্যেই আত্মিক জগতের সাথে যোগসূত্র স্থাপন করা যায়।
বিজ্ঞানের চরম উন্নতির যুগেও আমরা অনেকেই আত্মিক জগত সম্পর্কে নানা মত পোষণ করে
থাকি। এও মনে করি যে, আত্মিক জগত সম্পর্র্কে চিন্তা
করারও কোন প্রয়োজন নেই, আর তা করলে ঈমানহারা হওয়ার
সম্ভাবনা রয়েছে। মৃত্যুর পরই কেবল সে জগতের প্রশ্ন আসে। আবার অনেকেই মনে করে থাকি
যে, আত্মিক জগত শুধু কল্পনারই জগত
ইত্যাদি। প্রকৃত পক্ষে সৃষ্টির সুচনালগ্ন থেকেই মহান আল্লাহর পক্ষ হতে আগত
নবী-রাসূলগণ ও পরে তাঁদের উত্তরসূরী অসংখ্য মহামানব এবং তাদের অনুসারীগণ আত্মিক
জগতের সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়েছেন, তাঁরা মহান আল্লাহ্ পাক ও তাঁর প্রিয়তম বন্ধু হযরত রাসূল (সঃ)-এর
দিদার লাভে ধন্য হয়েছেন। জেনেছেন স্রষ্টা ও সৃষ্টির রহস্য। কিন্তু বিজ্ঞানের এই
চরম উন্নতির যুগেও আত্মিক জগতের সাথে আমরা অনেকেই পরিচিত নই, এটা আমাদের জন্য চরম ব্যর্থতা। আর এজন্য পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, “যে ইহলোকে অন্ধ সে পরলোকেও অন্ধ এবং আরো বেশী পথভ্রষ্ঠ”(সূরা বনি ইসরাঈল, আয়াত-৭২)।
দেহ আর আত্মার সমন্বয়েই মানুষ। আত্মা ছাড়া দেহ মৃত লাশ। আর
প্রত্যেক মানুষ মূলতঃ দু‘টি দেহের অধিকারী। একটি তার জৈবিক
বা জড় দেহ যা রক্ত মাংস ও হাড্ডিযুক্ত, অপরটি হচ্ছে আলোক বা ইথারিক দেহ যা ধরা ছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু আলোক
দেহধারীর ছবি দেখা যায় ও তার কথাও শোনা যায়। ওই দেহধারীর বাস্তবতা আমরা দেখতে পাই
টেলিভিশন নামক যন্ত্রে। টিভি সম্প্রচার কেন্দ্র থেকে একজন জড় দেহের মানুষকে আধুনিক
বিজ্ঞানের কলা কৌশলের মাধ্যমে ইথারিক বা আলোক দেহে রূপান্তরিত করে সমগ্র বিশ্বে
ইথার তথা তরঙ্গে ছড়িয়ে দেয়া হয়। ভূ-উপগ্রহের মাধ্যমে টেলিভিশন নামক গ্রাহক
যন্ত্রের দ্বারা পৃথিবীর যে কোন প্রান্ত থেকে তাৎক্ষণিক জড় দেহধারী ব্যক্তির আলোক
দেহ দেখা যায় ও তার কথাও শোনা যায়। টিভিতে আমরা যে ছবি দেখি তা ধরা ছোয়ার বাইরে।
কিন্তু তার ছবি ও কথা কোনটিই মিথ্যা নয়। এতো সামান্য জ্ঞানের অধিকারী মানুষের
আবিস্কারকৃত কলা কৌশলের ফল। বর্তমান বিশ্বের অন্যতম যোগাযোগের মাধ্যম ‘ইন্টারনেট’। এর সাথে আলোকময় জগতের যোগাযোগ পদ্ধতির অনেকটা সামঞ্জস্য লক্ষ্য করা
যায়। যেমন, একটি কম্পিউটার বা ল্যাপটপে
ইন্টারনেট কানেকশন সংযোগ করে ঘরে বসে পৃথিবীর যেকোন দেশের খবরাখবর নেয়া ও ছবি দেখা
যায়। তেমনি ডিস এ্যান্টিনার মাধ্যমে টেলিভিশন নামক যন্ত্রে বিশ্বের খবরাখবর নেয়া ও
ছবি দেখা যায়। এই বিষয়গুলো নিয়ে আমরা যদি গভীর ভাবে চিন্তা করি তা হলেই আত্মিক
জগতের চিত্র আমাদের সামনে অনেকটাই পরিস্কার হয়ে যায়। তবে এইযে জাগতিক কলাকৌশলের
বিষয়ে আলোচনা করলাম এগুলো হলো মহান আল্লাহ্ পাকের সৃষ্টি ক্ষুদ্র জ্ঞানের মানুষের
আবিস্কার যা জাগতিক জ্ঞানের ফসল। অপরদিকে আত্মিক জগতের সাথে যোগযোগ করতে হলে
আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জন করতে হবে। আর এই আত্মিক জ্ঞান অর্জনের বিষয়ে পবিত্র কুরআনে
সবিস্তারে বর্ণনা রয়েছে।
পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, “আসমান ও জমিনে যা কিছু আছে সব আল্লাহ্রই এবং সব কিছুকে আল্লাহ্
পরিবেষ্টন করে আছেন” (সূরা নেসা, আয়াত-১২৬)। অন্যত্র এরশাদ হয়েছে,“তিনি (আল্লাহ্) যাকে ইচ্ছা হিকমত(বিশেষ জ্ঞান)প্রদান করেন এবং যাকে
হিকমত প্রদান করা হয় তাকে প্রভূত কল্যাণ দান করা হয় এবং বোধশক্তিসম্পন্ন লোকেরাই
শুধু শিক্ষা গ্রহণ করে” (সূরা
বাকারা-২৬৯)। প্রথমোক্ত আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহ্ পাক বিশ্বজাহানের মালিক এবং সমগ্র বিশ্ব জগত তিনি
পরিবেষ্টন করে আছেন। অর্থাৎ তিনি সমগ্র সৃষ্টি জগতে বিরাজমান। পরের আয়াতে বলা
হয়েছে, মহান আল্লাহ্ দয়া করে যাকে ইচ্ছা
তাকেই ‘হিকমত’ বিশেষ জ্ঞান (তাঁকে জানার জ্ঞান) দান করেন। আর যাকে ওই বিশেষ জ্ঞান
দান করেন তাঁকে প্রভূত কল্যাণও দান করে থাকেন। আর বোধশক্তিসম্পন্ন অর্থাৎ বিশেষ
জ্ঞানের অধিকারীগণই প্রকৃত শিক্ষা লাভের ক্ষমতা রাখেন। মহান আল্লাহ পাকের জ্ঞানে
যারা জ্ঞানী তারা সাধারণ মানব নন বরং তারা বিশেষ মর্যদাশীল ব্যক্তি,তারা আল্লাহ পাকের মনোনিত ব্যক্তি, তারা আল্লাহ্ পাকের বন্ধু বলে পরিগণিত। আল্লাহ্র বন্ধুগণই আত্মিক
জগতের সাথে যোগাযোগের ক্ষমতা রাখেন এবং অপরকেও আত্মিক জগতের শিক্ষায় শিক্ষিত করতে
পারেন। সৃষ্টির শুরু থেকে যত নবী-রাসূল জগতে আগমন করেছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই মহান আল্লাহর সাথে যোগাযোগ রেখে তাঁর নির্দেশ
অনুযায়ী ধর্ম প্রচার এবং মানব জাতিকে হেদায়েতের কাজ করেছেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ
তাঁর নিজ সম্পর্কে এরশাদ করেন, “তিনি (আল্লাহ্)
আদি, তিনিই অন্ত, তিনি প্রকাশ, তিনি গুপ্ত এবং
তিনি সর্ব বিষয়ে সম্যক অবহিত”(সূরা হাদিদ, আয়াত-৩)। অর্থাৎ সৃষ্টি জগত সৃজনের আগে মহান আল্লাহ ব্যতীত আর কোন
কিছুই ছিলনা, সৃষ্টি জগত ধ্বংস হওয়ার পরও তিনি
থাকবেন, তিনি সৃষ্টির মাঝেই নিজেকে প্রকাশ
করেছেন,আবার তিনি তাঁর সৃষ্টি থেকে গোপন
অবস্থায় আছেন।
হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ বলেন, “আমি গুপ্ত ধনাগার ছিলাম, নিজকে প্রকাশ করতে ভালোবাসলাম, তাই সৃষ্টি জগত সৃজন করলাম” (সিররুল আসরার)। অর্থাৎ আল্লাহ্ পাক গোপনে না থেকে নিজেকে প্রকাশ করার জন্য ভালবাসলেন এবং সৃষ্টিকেই তাঁর ভালবাসার মাধ্যম হিসেবে বেঁচে নিলেন। হাদিসে কুদসীতে আল্লাহ আরো বলেন, “মানবজাতি আমার গুপÍ ভেদ এবং আমি মানুষের গুপ্ত রহস্য” (সিররুল আসরার)। মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। সমগ্র সৃষ্টিরাজির উপর প্রাধান্য বিস্তার করার ক্ষমতা মানুষকে দেয়া হয়েছে। এরপরও মানুষ হিসেবে আমরা আত্মিক জগতের কথা ভাবিনা, আল্লাহ পাকের দিদার লাভের চিন্তা করিনা বা কি করে তাঁর দিদার লাভ করা যায় সেই পথের সন্ধানও করিনা। অথচ মহান আল্লাহ পাকের মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্যই ছিল-মানুষের মাধ্যমে তাঁর গুনাবলী প্রকাশ পাবে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ বলেন,“ পৃথিবীর সব গাছ যদি কলম হয়, আর এই যে সমুদ্র এর সঙ্গে যদি সাত সমুদ্র যোগ দিয়ে কালি হয় তবুও আল্লাহ্র গুণাবলী লিখে শেষ করা যাবেনা। আল্লাহ্তো শক্তিমান তত্ত্বজ্ঞানী” (সূরা লোকমান, আয়াত-২৭)। এই অসীম গুনাবলীর অধিকারী মহান আল্লাহ গোপন অবস্থা থেকে প্রকাশ পেয়ে তাঁর গুণাবলীর বিকাশ ঘটাতে চেয়েই মানব সৃষ্টি করেন। আল্লাহ্ পাক মানুষকে এতো উচ্চ মর্যাদায় দিয়েছেন যে, তাঁর প্রতিনিধি করে মানুষকে দুনিয়াতে প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ্ প্রদত্ত এই উচ্চ মর্যাদা সম্পর্কে আমরা নিজেরাই হয়ত অনেকে জানিনা। এছাড়া মানুষের সার্বিক প্রয়োজনে এই সৃষ্টি জগত সৃজিত। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ ঘোষণা করেন, “তোমরা কি দেখনা আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবই আল্লাহ্ তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন এবং প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করেছেন?” (সূরা লুকমান, আয়াত-২০)। বস্তুতঃ আল্লাহ্র অনুগ্রহ ব্যতীত কারো চলার শক্তি নেই। আরো এরশাদ হয়েছে, “তিনি (আল্লাহ্) পৃথিবীর সবকিছু তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন, তৎপর তিনি আকাশের দিকে মনোসংযোগ করেন এবং উহাকে সপ্তাকাশে বিন্যস্ত করেন; তিনি সর্ব বিষয়ে সবিশেষ অবহিত”(সূরা বাকারা-২৯)। এই সৃষ্টি জগত দু‘ভাগে বিভক্ত। যার একটি হলো বস্তু জগত বা দৃশ্যমান জগত আর অপরটি আলোকময় তথা আত্মিক জগত।