পলাশ রহমান, সিনিয়র সাংবাদিক :
ইতালির প্রায় সব সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে উঠে এসেছেন- একজন বাংলাদেশী ইমাম আরিফ মাহমুদ। তাকে নিয়ে সংসদে কথা হচ্ছে, সংবাদমাধ্যমে টক'শো হচ্ছে, পত্রিকাগুলো দিস্তা দিস্তা কলাম লিখছে। কিন্তু কেনো আরিফ মাহমুদ এতো আলোচিত, সমালোচিত হচ্ছেন?
ভেনিসে মাদ্রাসাতুল ইত্তিহাদ নামে একটি প্রতিষ্ঠান চালান আরিফ মাহমুদ। ওখানে প্রবাসী বাচ্চাদের কোরআন শিক্ষা দেয়া হয়। একই সাথে শহরের মধ্যে প্রাক্তন একটি সুপার মার্কেটের জায়গা ভাড়া নিয়ে আরিক মাহমুদ মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেছেন। স্থানীয় আইন অনুসারে শহরের মধ্যে নতুন কোনো উপাসনালয় করার অনুমতি নেই, সুতরাং প্রশাসন মসজিদ প্রতিষ্ঠার শুরুতেই বাধা প্রদান করে। আরিফ মাহমুদ বিষয়টি নিয়ে আদালতে যান। আদালত দুইবার তার মামলার বিপক্ষে রায় দেয়। সম্প্রতি তিনি উচ্চ আদালতে আপিল করেছেন। অর্থাৎ মামলাটি এখনো চলমান।
আরিফ মাহমুদ মসজিদ বন্ধের প্রতিবাদে প্রতি জুমার নামাজ আদায় করেন স্থানীয় একটি পার্কে। সেখানে প্রায় হাজার খানেক মুসল্লি প্রতি জুমায় অংশগ্রহণ করেন এবং শান্তিপূর্ণভাবে নামাজ আদায় করেন।
আরিফ মাহমুদের জুমার খুতবা নিয়ে কমুনিটির অনেকের আপত্তি আছে, ক্ষোভ আছে। কারো ক্ষোভ- ইমাম সাহেব কেনো রাজনৈতিক আলাপ করেন! ধর্মের নামে কেনো রাজনীতি করেন! তিনি কেনো বিএনপি- আওয়ামীলীগের সমালোচনা করেন!
ব্যবসায়ীদের ক্ষোভ- তিনি কেনো হালাল-হারামের ওয়াজ করেন! নিয়মমাফিক জবাই না করা পশুর মাংস মুসলিমদের জন্য হারাম, ইমাম সাহেবের এমন ওয়াজের প্রভাব পড়ে মাংসের বাজারে।
মদ ব্যবসায়ীদের ইনকাম হারাম, মদের দেশে বাস করে তিনি কেনো এমন ওয়াজ করবেন!
তিনি কেনো বাচ্চা মেয়েদেরও হিজাব পরতে উৎসাহিত করেন!
তিনি কেনো নারীদের বেপর্দা চলাফেরার ওয়াজ এই দেশে করেন!
তিনি কেনো মসজিদ কমিটিতে কমিউনিটি নেতাদের জায়গা দেন না, কেনো নেতাদের কথা বলতে দেন না, কেনো সামনের কাতারে জায়গা রাখেন না, কেনো নেতাদের 'তোয়াজ' করেন না!
স্থানীয় কমিউনিটিতে এমন সব ক্ষোভ দানা বাঁধতে বাঁধতে এতো বড় হয়েছে যে- তা এখন ইতালির সংসদে গিয়ে পৌঁছেছে।
এরমধ্যে বহুবার আরিফ মাহমুদকে নিয়ে স্থানীয় পত্রিকায় লেখালেখি হয়েছে, সংবাদ প্রকাশ হয়েছে। আমাদের কমিউনিটির অনেকেই সংবাদমাধ্যমগুলোকে তথ্য দিয়েছে- ইমাম সাহেব উগ্রবাদ ছড়ান, ইমাম সাহেব মৌলবাদী, ইমাম সাহেব নারী বিদ্বেষী, ইমাম সাহেব যা বলেন- তা ইসলামে নেই, ইত্যাদি।
আরিফ মাহমুদ শুধু বাংলাদেশের রাজনীতির সমালোচনা করেই ক্ষ্যান্ত হন না, তিনি ইতালীয় রাজনীতিকদেরও কড়া সমালোচনা করেন। যা অনেকটা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রকাশ করে মিডিয়াগুলো এবং এতেই গাত্রদাহ শুরু হয় ইতালির ডানপন্থী রাজনীতিকদের।
ইতালির সরকারি দল ফ্রাতেল্লি দি ইতালিয়ার একজন প্রভাবশালী সিনেটর- কিছুদিন আগে আরিক মাহমুদকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি স্ট্যাটাস লেখেন। তিনি আরিফ মাহমুদকে উগ্রবাদী, জঙ্গিবাদী, ইতালির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ মানুষ হিসাবে উল্লেখ করেন। তাকে ইতালি থেকে বহিষ্কারের দাবি জানান। এমনকি তার যদি ইতালির নাগরিকত্ব থাকে তাও বাতিলের দাবি জানান সিনেটর।
১ জুলাই তারিখে সরকারি দলের অন্য দুজন সিনেটর সংসদে লিখিত প্রশ্ন তুলেছেন- তারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে জানতে চেয়েছেন, ভেনিসের মসজিদটি এখনো বন্ধ করা হয়নি কেনো? (মসজিদটি কার্যত বন্ধ) ইমাম আরিফ মাহমুদ ইতালিতে উগ্রবাদ ছড়ান, ইতালির সরকারী দলকে 'ফ্যাসিবাদী' বলেন, প্রধানমন্ত্রী মেলোনিকে কটাক্ষ করেন, লেগা নেতা সালভিনি কে তিরস্কার করেন, নারী অধিকারের বিরুদ্ধে কথা বলেন, তার বিরুদ্ধে এখনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি কেনো? সকল ডকুমেন্ট বাতিল করে, তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়নি কেনো?
সংসদে এই আলোচনার পর ইতালির মিডিয়াগুলোয় ঝড় উঠেছে, আরিফ ঝড়। কড়া ভাষায় লেখালেখি, সংবাদ প্রচার চলছে সংবাদ মাধ্যমগুলোয়। অথচ ইতালির আইনে রাজনীতিকদের কটাক্ষ করা, সমালোচনা করা, অপরাধ হিসেবে গণ্য হয় না। যেমন, গতকাল এক ইতালীয় বন্ধুর পোস্ট পড়লাম- 'তোমার যদি পায়খানা না আসে, তুমি সালভিনির কথা চিন্তা করো!
রাজনীতিকদের এমন বা এর চেয়ে অনেক শক্ত সমালোচনা আমরা অহরহ দেখি। সেগুলো নিয়ে কোনো শোরগোল না হলেও আরিফ মাহমুদের বেলায় হয়েছে। কারণ তিনি একজন আলেম, একজন ইমাম। বুক ফুলিয়ে 'ইসলাম' প্রচার করেন।
ইতালীয় সংবাদ মাধ্যম বা রাজনৈতিক পাড়ায় এমন আলোচনা হওয়া মোটেও অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু আমাদের বাংলাদেশী কমিউনিটিতে কি হচ্ছে? মিথ্যা, বিভ্রান্তিকর, গুজবে ভরে ফেলা হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া, কিন্তু কেনো? এতে কি লাভ হচ্ছে আমাদের?
আরিফ মাহমুদ মেম্বরে দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক সমালোচনা করেন, হালাল হারাম বুঝে বাজার থেকে মাংস কিনতে বলেন, মসজিদে কারো নেতাগিরি বরদাস্ত করেন না, এগুলোই তার অপরাধ?
একজন আরিফ মাহমুদকে থামিয়ে দিলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে?