
ইসলাম প্রচারমুখী ধর্ম। বিশ্বের যে প্রান্তেই ইসলামের পদচারণা হয়েছে সেখানেই ধর্মটি ধর্মান্তরিতদের মধ্যে দ্রুত সমপ্রসারিত হয়েছে। ঐতিহাসিক অবিভক্ত বাংলায়ও একই ঘটনা ঘটেছিল। উপনিবেশ আমলে ১৮৭২-এ সর্বপ্রথম লোকগণনায় দেখা গেল, সারা বাংলায় মুসলমানদের সংখ্যাভিত্তিক অনুপাত ৪৮ ভাগ। তথ্যটি তখন বিস্ময় সৃষ্টি করলেও তার যুক্তি ও প্রমাণভিত্তিক ব্যাখ্যা ছিল। সারা উপমহাদেশের মধ্যে বাংলায় অধিবাস ছিল সামাজিকভাবে বঞ্চিত ও নিগৃহীত অধিক মানুষের; তারাই ইসলামের উদার ও কল্যাণমুখী আবেদনে সাড়া দিয়ে ধর্মান্তরিত হয়েছিল। কেন এবং কীভাবে এ ব্যাপক ধর্মান্তরণ হয়েছিল তা ইতিহাসের এক চমকপ্রদ বিতর্কের বিষয়। যেমন পশ্চিমের অনেক গবেষক বলতে চেয়েছেন, ইসলাম বিস্তৃত হয়েছে মুসলিম শাসকদের তরবারির জোরে। কিন্তু লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, দিল্লি ও আগ্রা ছিল দোর্দণ্ড মুসলিম প্রতাপের কেন্দ্র, কিন্তু যেখানে ধর্মান্তরিত মুসলমান মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশও ছিল না। অন্যদিকে তুলনামূলকভাবে বাংলায় মুসলিম শাসন ছিল দুর্বল। সেকারণে অধ্যাপক পিটার হার্ডি যথার্থই বলেছেন, Those
who argue that Indian Muslims were forcibly converted generally failed to
define either force or conversion&_ leaving us to presume that a society
can and will change its religious identity simply because it has a sword at its
neck।
তাহলে বাংলায় ইসলাম-বিস্তৃতির ব্যাখ্যা কী? প্রথমত, ইতিপূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে ইসলামের অন্তর্লীন মানবতাবাদী আবেদনের কথা। দ্বিতীয়ত এবং প্রধানত, এমন ইসলামের ধারক, বাহক ও প্রচারক সুফিদের অবদান। সুফিবাদী ইসলামের দুটো মৌল বক্তব্য বা ধারণা আছে। এক, ইন্নামাল আমানু বিন্ নিয়্যাত। অর্থাৎ মনোবাঞ্ছার ওপর ধার্মিকতা বা ঈমান নির্ভরশীল। আরো উল্লেখ্য, এমন ইসলামে অন্তরের শুচিতা বড়; এবং তার সঙ্গে সংযোজিত হবে আবশ্যকীয় আচার-আনুষ্ঠানিকতা, তবে যা কখনই আচার-অনুষ্ঠানসর্বস্বতায় পর্যবসিত হবে না। দুই, মান আরাফা নাফসাহু ফাকাদ আরাফা রাব্বাহু- নিজকে জানলে স্রষ্টাকে চেনা হয়।
অনুপুঙ্খ বিচারে বাংলায় ইসলামের আবির্ভাব, প্রচার ও প্রসার মুসলিম রাজনৈতিক শক্তি থিতুকরণে পাটাতন হিসেবে কাজ করেছে। অন্যভাবে বললে ইসলামের গতিময় ব্যাপ্তি রাজশক্তি বিকাশের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছিল। বাহ্যিক আনুষ্ঠানিকতাসর্বস্ব নয়, বরং অন্তর্লীন প্রণোদনায় প্রাণিত উদারপন্থী ইসলাম প্রচারিত হয়েছিল এমন ইসলামী মননসমৃদ্ধ সুফিকুল দ্বারা। তাদের মানবিক প্রণোদনা-উৎসারী ইসলামী আবেদন স্থানীয় বিভিন্ন ধর্মানুসারী মানুষের মধ্যে সহজ ও ক্রমবর্ধমান গ্রাহক পেয়েছিল। অতীতের আচার-অনুষ্ঠানক্লিষ্ট ধর্মে বীতশ্রদ্ধ স্থানীয় হিন্দু (নমশূদ্র), বিশেষ করে ধর্মের কারণে সমাজচ্যুত ও সংক্ষুব্ধ আমজনতা যেন উদারপন্থী ও মানবিক ইসলামের মধ্যে এক অচলায়তন ভাঙার ইঙ্গিত পেয়েছিল।
ইসলাম প্রচারধর্মী হলেও বাংলায় ধর্মটির প্রচারকৌশল ও পদ্ধতি যে মানবিক অনুভূতিসমৃদ্ধ ছিল তা বিশেষ আলোচনার দাবি রাখে। বাংলায় মুসলমানরা ক্ষমতা দখল করেছিল তেরো শতকের শুরুতে; কিন্তু সুফিবাদী ইসলামের আগমন হয়েছিল আট শতকেই। অর্থাৎ মুসলিম রাজনৈতিক বিজয়ের পূর্বসূরি হিসেবে কাজ করেছিল ধর্মবিজয়। এটাও তো বলা অত্যুক্তি হবে না যে, রাজনৈতিক বিজয়পূর্ব ধর্মবিজয় রাজনৈতিক বিজয়ের পথ সুগম করেছিল।
পারসিক সুফিদের ইসলাম প্রচার-কৌশলের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল সংশ্লেষণমূলক (syncretic) দৃষ্টিভঙ্গি। ইসলাম গ্রহণের সময় স্থানীয় ধর্মান্তরিতদের ঐতিহ্যবিচ্যুত হতে হয়নি। কারণ ধর্মপ্রচারক সুফিরা তা করতে বলেননি। ফলে বাংলার সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে ইসলাম হয়েছে সংশ্লেষণবাদী। সুতরাং স্থানীয়দের পক্ষে ইসলামে ধর্মান্তরণ সহজ হয়েছিল। উল্লেখ্য, খোদ আরবেই ইসলাম স্থানীয় অনেক ঐতিহ্যকে আত্মস্থ করে বিকশিত হয়েছিল। উপরন্তু লক্ষণীয়, বিশ্বের যে প্রান্তেই ইসলাম সমপ্রসারিত হয়েছে সেখানেই অভিন্ন ঘটনা ঘটেছে। ধর্ম প্রচারের এমন পদ্ধতি নিঃসন্দেহে শুধু বিচক্ষণই নয়, মনস্তাত্ত্বিকভাবে মানবিকও বটে।
অন্যদিকে সুফি-সাধক পরিচালিত তিনটি প্রতিষ্ঠান বাংলায় ইসলাম প্রচারে পরিপূরক ভূমিকা পালন করেছিল। প্রথম প্রতিষ্ঠানটি ছিল লঙ্গরখানা। লঙ্গরখানায় ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সব অন্নহীন মানুষকে সমাদরে এবং বিনামূল্যে আপ্যায়িত করা হতো। অর্থের জোগান আসতো মুসলিম শাসকদের রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে। এ ব্যবস্থার ফলে সবচে’ বেশি উপকৃত হয়েছিল কট্টর হিন্দুত্ববাদী সেন শাসনে (১১৬১-১২০৪) নিগৃহীত ও জাতিভেদ প্রথার শিকার হয়ে সমাজচ্যুত নমশূদ্ররা। জাত-পাতের পার্থক্যহীন সব মানুষের এমন সম্মিলন ছিল বাংলায় দৃষ্টান্তরহিত। বলা যায়, এক ধরনের সামাজিক বিপ্লবই ঘটে গিয়েছিল। আর এমন বিপ্লব যারা আস্বাদন করেছিল সেই স্থানীয়রা এমন এক উপলব্ধিতে প্রাণিত হয়েছিল যে, নতুন ধর্ম ইসলাম সামাজিকভাবে সমতাবাদী (socially egalitarian), যা বৌদ্ধ ধর্মে থাকলেও কট্টর হিন্দুত্বে ছিল না। কাজেই নিম্নবর্গের হিন্দু অভাজনদের কাছেই ইসলামের আকর্ষণ ছিল বেশি; এবং তারাই কালক্রমে মুসলমান সমাজের গরিষ্ঠ অংশ হয়েছিল। অবশ্য কিছু সংখ্যক বৌদ্ধও পরিস্থিতির চাপে মুসলমান হয়েছিল।
ইসলাম প্রচার-সহায়ক দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠানটি ছিল খানকাহ। লঙ্গরখানা ছিল সামাজিক ইসলামের বাস্তব দৃষ্টান্ত; আর খানকাহ তাত্ত্বিক ইসলামের প্রশিক্ষণকেন্দ্র। সুফিরা ছিলেন প্রশিক্ষক। লঙ্গরখানায় হার্দিকভাবে তৃপ্ত উন্নতজীবন প্রত্যাশী শোষিত-বঞ্চিত মানুষ খানকাহ-এ গিয়ে যে আগ্রহী ও ঐকান্তিক প্রশিক্ষণার্থী হবে সেটাই ছিল স্বাভাবিক। এ দুটো প্রতিষ্ঠানই তাদের ইসলামে দীক্ষা গ্রহণের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করেছিল। এমন পরিপ্রেক্ষিতে বাংলায় সুফি-প্রয়াসলগ্ন ইসলাম-বিস্তৃতির বাস্তবানুগ ব্যাখ্যার জন্য একটি উদ্ধৃতির সাহায্য গ্রহণ করা যেতে পারেঃ The foremost consideration appears to be an intent to find a
refuge where there would not be a social stratification and discrimination as
these people had been going through under the Senna rule; and Islam appeared to
be a refuge of such specification. Moreover, there had been clear material
considerations uppermost in the psyche of the converts and the background to
which was the way which the Sufis welcomed these people first by the
Langerhans, and then Khanna (দ্রষ্টব্য Syed Anwar Husain, Human Rights in Bengal:
Atash Dipankar to Sufis)।
বাংলায় ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করা তৃতীয় প্রতিষ্ঠানটি ছিল দরগাহ। দরগাহে সমাবেশ হতো সব ধর্মের মানুষের, যে রীতি আজও চালু আছে। দেখা যায় যে, ক্রমাগতভাবে দরগাহ খানকাহ-র স্থান দখল করে নিয়েছে। দরগাহ-র এমন প্রাধান্যের সূচনা বাংলায় হুসেইন শাহী শাসনামলে (১৪৯৩-১৫৩৮)। তবে দরগাহ-এ কিছু ইসলামি চেতনাপরিপন্থী আনুষ্ঠানিকতাও দৃশ্যমান হয়েছিল, যার রেশ আজও দেখা যায়।
বরেণ্য ইতিহাসবিদ অধ্যাপক আবদুল করিম মন্তব্য করেছেন, Bengal, not to speak of the big cities but even not a small
city or a hamlet will be found where the Dervishes have not come and settled। অর্থাৎ বাংলার বড়-ছোট সব শহর এমন কী গ্রামেও তারা পদার্পণ করেছিলেন, এবং স্থায়ীভাবে থেকে গিয়েছিলেন। কাজেই বাংলার সমগ্র ভূখণ্ড জুড়েই তারা ইসলাম প্রচার করেছিলেন। মুসলমান রাজশক্তি ইসলাম প্রচারে সুফিদের সহায়ক হয়েছিল, কিন্তু এমন শক্তির প্রভাবে ইসলাম বিস্তৃত হয়নি। বাংলায় ইসলামের আলো ছড়িয়েছিলেন সুফিরাই।