রোকসানা মনোয়ার ঃ
বাংলাদেশে প্রবেশে করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষার নেগেটিভ সনদ দেখানোর নিয়ম বাতিল করার বিষয়ে খুব শিগগিরই বৈঠকে বসতে যাচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও সিভিল এভিয়েশন। সূত্র জানিয়েছে, এতদিন বাংলাদেশে ঢুকতে ও বের হতে করোনার আরটিপিসিআর নেগেটিভ সনদ প্রয়োজন হতো। যেহেতু এখন করোনা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে তাই সনদ দেখানোর নিয়ম বাতিলের সিদ্ধান্ত নিতে পারে সরকার।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন না থাকায় এখন পর্যন্ত যেকোনো দেশ থেকে যাতায়াতের ক্ষেত্রে কোভিড-১৯ আরটিপিসিআর টেস্ট সনদ যাত্রীদের কাছে থাকতে হয়। তবে কয়েকটি দেশ ইতোমধ্যে করোনা টেস্ট ছাড়াই বাংলাদেশে বিমান চলাচল শুরু করেছে। তাই এখন আরটিপিসিআর টেস্ট তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্তের দিকে হাঁটছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও সিভিল এভিয়েশন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেসব দেশে করোনা শনাক্ত কম বা করোনা নিয়ন্ত্রণে আছে সেসব দেশের সঙ্গে বিনা আরটিপিসিআর টেস্টে যাতায়াত শুরু করতে পারে বাংলাদেশ। তবে যেসব দেশে করোনা এখনো নিয়ন্ত্রণে নেই তাদের সঙ্গে চলাচলে আরটিপিসিআর টেস্ট নিয়ম বহাল রাখতে হবে।
ইউরোপ-আমেরিকা, জার্মানি ও ইতালিসহ বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে এখনো ঢুকতে বাধ্যতামূলক কোভিড টেস্ট করতে হয়। এমনকি এসব দেশের নাগরিকদের ভ্রমণে সাবধানতা ও নিষেধাজ্ঞা জারি করা আছে। কোন কোন দেশে নাগরিকরা ভ্রমণ করতে পারবেন তারও একটি তালিকা দেওয়া আছে অনেক দেশে। করোনার যে পরিস্থিতি তাতে এই সব দেশের চেয়ে বাংলাদেশে ভয়াবহতা অনেক কম। বিশ্বে এখনো প্রতিদিন ২০ থেকে ২২ লাখ মানুষ করোনা আক্রান্ত হচ্ছে। আর বাংলাদেশে করোনা শনাক্তের সংখ্যা কমছে।
থাইল্যান্ডে এখন পর্যটন ভিসা উন্মুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু এই দেশটিতে ৪৮ ঘণ্টার কোভিড টেস্ট রিপোর্ট নিয়ে যাওয়ার পর আবার টেস্ট করতে হয়। এরপর পাঁচ দিনের মাথায় আবারও টেস্ট করতে হয়। ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে করোনা টেস্টের বিষয়টি তুলে নিয়েছে। মালদ্বীপে প্রাপ্তবয়স্ক যারা করোনা টিকার ডোজ সম্পন্ন করেছে তাদের জন্য উন্মুক্ত করেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে কোভিড-১৯ জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি টিকা নিয়ে বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের করোনা টেস্ট ছাড়াই বাংলাদেশে প্রবেশের অনুমতি দেওয়ার সুপারিশ করেছে। সুপারিশে আরও বলা হয়েছে, যারা বাংলাদেশের বাইরে যেতে চান তাদেরও করোনার আরটিপিসিআর টেস্ট বাধ্যতামূলক করার দরকার নেই।
সুপারিশে আরও বলা হয়েছে, যাদের দুই ডোজ ভ্যাকসিন নেওয়া আছে তাদের দেশে আসার ক্ষেত্রে আরটিপিসিআর টেস্টে না রাখলেও চলবে। তবে যারা দুই ডোজ ভ্যাকসিন নেননি তাদের ৭২ ঘণ্টার মধ্যে করোনার আরটিপিসিআর টেস্ট অবশ্যই করাতে হবে। আর যেসব দেশে করোনা টেস্ট তুলে দেওয়া হয়েছে তাদের দেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে আরটিপিসিআর টেস্ট তুলে দিতে পারে বাংলাদেশ। তবে যেসব দেশে এখনো আরটিপিসিআর টেস্ট বাধ্যতামূলক সেসব দেশে ঢুকতে ও সেসব দেশ থেকে আসতে আরটি পিসিআর টেস্ট নিয়ম রাখা যেতে পারে।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এএসএম আলমগীর বলেন, 'পৃথিবীতে আমরা আকাশপথে যে যাতায়াত করি ৪৮ বা ৭২ ঘণ্টার করোনা নেগেটিভ রিপোর্ট নিয়ে, এগুলোর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। একটা নিয়মের মধ্যে থাকা দরকার তাই এগুলো করা হয়। কিন্তু রিপোর্ট নেগেটিভ আসার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে যে আপনি আক্রান্ত হবেন না এমন কোনো নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবেন না।'
তিনি বলেন, অনেক দেশ করোনা আরটিপিসিআর টেস্ট তুলে নিয়েছে। কিন্তু এর সঙ্গে এমন কিছু নিয়ম যুক্ত করে দিয়েছে যা আরও ঝামেলা বাড়িয়েছে। সে সব দেশে সংশ্লিষ্ট বিভাগে গিয়ে প্রতিদিন দেখা করতে হয়। চার দিন পাঁচ দিন পর টেস্ট করতে হয়। এসব ঝামেলার চেয়ে আরটিপিসিআর টেস্টের নিয়ম থাকাই ভালো। এতে ঝামেলা কম।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের বিষয়টি কিছুটা ভিন্ন। এখানে করোনার সংক্রমণ কমছে। এমনকি ইউরোপ-আমেরিকার চেয়েও অনেক ভালো আছে। যেহেতু এখানে সংক্রমণ কমতির দিকে আছে আরও কিছুদিন পর এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে কর্তৃপক্ষ। এখন সংক্রমণ আটের নিচে। এটি এক বা দুই শতাংশে নেমে গেলে বাইরে থেকে আসা যাত্রীদের বিষয়ে ও বাইরে যেতে ইচ্ছুক যাত্রীদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে সরকার।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর বলেন, 'আকাশপথে ও বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে যারা বাংলাদেশে আসছেন তাদের এখনো করোনার আরটিপিসিআর নেগিটিভ সার্টিফিকেট লাগছে। এটা এখনই উইথড্রো করার সুযোগ আমাদের হাতে নেই। কারণ সংক্রমণ কিন্তু এখনো হাতের নাগালে আসেনি। তাই আমরা একটু দেরি করতে চাইছি। করোনার সংক্রমণ পাঁচের নিচে বেশ কয়েকদিন ধরেই আছে। করোনা টেস্ট উইথড্রো করার সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে।'
তিনি আরও বলেন, ইউরোপ-আমেরিকা বা উন্নত অনেক রাষ্ট্রের চাইতে আমরা অনেক ভালো আছি। তাদের দেশে এখনো মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন। আক্রান্তের সংখ্যাও অনেক বেশি। সেই অনুপাতে আমাদের দেশে সংক্রমণ ও মৃতু্য অনেক কম। তাই আমরাও চিন্তা করছি বিদেশে যাতায়াতে করোনার আরটিপিসিআর টেস্ট বন্ধ করার কথা। কিন্তু সেটি এখনই নয়। আরও কিছু দিন পর। আগামী সপ্তাহে সবার সঙ্গে আমরা বৈঠক করব। বৈঠকের পর সিদ্ধান্ত।'
সিভিল এভিয়েশন চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মোফিদুর রহমান বলেন, 'আমরা চাইলেই সবার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ কোভিড নেগেটিভ রিপোর্ট ছাড়া শুরু করতে পারি না। এজন্য অনেক কিছু বোঝার ও দেখার আছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইনও আমাদের ফলো করতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে আমাদের বৈঠক করতে হবে। তাদের ওপর সব কিছু নির্ভর করে।'
তিনি আরও বলেন, 'আমাদের দেশে এখন যারা আসতে চান তাদের মধ্যে দশ বছরের নিচের বাচ্চাদের কোভিড নেগেটিভ রিপোর্ট লাগে না। কিন্তু আমাদের দেশ থেকে আমেরিকা গেলে দুই বছরের ওপরের বাচ্চাদেরও কোভিড নেগেটিভ রিপোর্ট দেখাতে হয়। তাই কোন দেশ কীভাবে চায় সেটাও দেখার বিষয় আছে। আমরা যে দেশ যেভাবে চায়, তাদের সঙ্গে সেভাবেই কাজ করব। ইচ্ছা করলেই আমাদের মতো করে সব কিছু চালানো যাবে না।'
সিভিল এভিয়েশন চেয়ারম্যান আরও বলেন, 'আমরা চাইলে এখন ফ্লাইটও বাড়াতে পারি। কিন্তু তা এখন করছি না স্বাস্থ্য বিধির কারণে। এমনিতেই আমাদের মধ্যপ্রাচ্য ফ্লাইটের কারণে অনেক যাত্রী হচ্ছে। স্বাস্থ্যবিধি পরিপূর্ণরূপে মানার জন্য আমরা ফ্লাইট বাড়াচ্ছি না। যেহেতু মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমাদের রেমিট্যান্স আসে তাই আমরা তাদের সঙ্গে আকাশপথ একটু বেশি উন্মুক্ত রেখেছি।'
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. আবুল জামিল ফয়সাল বলেন, 'বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের দেশে আগমনের ক্ষেত্রে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করছে তা খুবই ভালো। এভাবে আর কতদিন। তাছাড়া সবাই কম-বেশি করোনার ভ্যাকসিন নিয়ে নিয়েছেন। তাদের সঙ্গে আমাদেরও তাল মিলিয়ে চলতে হবে। না হলে আমরা অনেকখানি পিছিয়ে যাব। তাই বিশ্বের সবাই যা করবে আমাদেরও তাই করতে হবে।'
তিনি আরও বলেন, 'যেভাবে সংক্রমণ কমছে ও মৃতু্য কমে গিয়েছে তাতে আমরা ভালো দিকে যাচ্ছি। আমাদের সংক্রমণের হার পাঁচের নিচে আশা করছি কয়েকদিনের মধ্যেই চলে আসবে। তাই সবার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ আরও স্মুথ করতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে যে দেশে করোনার প্রকোপ বেশি তাদের সঙ্গে আমাদের সতর্কভাবে যোগাযোগ রক্ষা করতে হবে।