কুরবানী ইসলামের বিশেষ ইবাদত। এটা আদম আ.-এর যুগ
থেকে বিদ্যমান ছিল। সূরা মাইদায় (আয়াত ২৭-৩১) আদম আ.-এর দু’সন্তানের
কুরবানীর কথা এসেছে। তবে প্রত্যেক নবীর শরীয়তে কুরবানীর পন্থা এক ছিল না। ইসলামী
শরীয়তে কুরবানীর যে পদ্ধতি নির্দেশিত হয়েছে তার মূল সূত্র ‘মিল্লাতে
ইবরাহীমী’তে বিদ্যমান ছিল। কুরআন মজীদ ও সহীহ হাদীস থেকে তা স্পষ্ট জানা যায়।
এজন্য কুরবানীকে ‘সুন্নতে ইবরাহীমী’ নামে অভিহিত করা হয়।
ফার্সী, উর্দু ও বাংলা ভাষায় ‘কুরবানী’ শব্দটি
আরবী ‘কুরবান’ শব্দের স্থলে ব্যবহৃত হয়। ‘কুরবান’ শব্দটি
মূলধাতু (যার অর্থ হচ্ছে, নৈকট্য) থেকে নির্গত।
তাই আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জনের জন্য শরীয়তসম্মত পন্থায় বান্দা যে আমল করে
তাকে আভিধানিক দিক থেকে তাকে ‘কুরবান’ বলা
যেতে পারে। তবে শরীয়তের পরিভাষায় ‘কুরবান’ শব্দের
মর্ম তা-ই যা উপরে উল্লেখিত হয়েছে।
ইসলামী শরীয়তে এই পারিভাষিক অর্থে দু ধরনের
কুরবানী রয়েছে।
১. যা হজ্বের মওসুমে হজ্ব ও উমরা কারীগণ
নির্ধারিত (মক্কা ও মিনায়) স্থানে আদায় করে থাকেন। এর বিভিন্ন প্রকার
রয়েছে। যথা-‘কিরান’ বা তামাত্তু হজ্ব আদায়কারীর ওয়াজিব কুরবানী, ইফরাদ হজ্বকারীর
নফল কুরবানী, সঙ্গে করে নিয়ে আসা ‘হাদি’ (কুরবানীর
পশু) দ্বারা কুরবানী, হজ্ব আদায়ে অক্ষম হওয়ার কারণে বা কোনো নিষিদ্ধ কর্মের
জরিমানারূপে অপরিহার্য কুরবানী, মানতের কুরবানী কিংবা দশ যিলহজ্বের সাধারণ
কুরবানী।
এ কুরবানীর বিধান মৌলিকভাবে সূরা হজ্ব আয়াত
২৭-৩৭, সূরা বাকারা আয়াত ১৯৬, সূরা মাইদা আয়াত ২, ৯৫-৯৭, সূরা ফাতহ আয়াত ২৫-এ
এসেছে। আর হাদীস শরীফে তা উল্লেখিত হয়েছে বিস্তারিতভাবে।
২. সাধারণ কুরবানী, যা হজ্ব-উমরার সঙ্গে
সম্পৃক্ত নয় এবং যার স্থানও নির্ধারিত নয়। তবে সময় নির্ধারিত। যে তারিখে হজ্ব
আদায়কারীগণ মিনা-মক্কায় কুরবানী করে থাকেন সে তারিখে অর্থাৎ যিলহজ্বের দশ,
এগারো, বারো তারিখে এ কুরবানী হয়ে থাকে। পৃথিবীর সকল মুসলিম পরিবারের জন্য; বরং
প্রত্যেক আকেল-বালেগ মুসলমানের জন্য এই কুরবানীর বিধান এসেছে। তবে কারো জন্য তা
ওয়াজিব, কারো জন্য নফল।
সূরা আনআমের ১৬১-১৬৩ আয়াতে এবং সূরা কাউসারের ২
আয়াতে এই কুরবানী উল্লেখিত হয়েছে। বিস্তারিত বিধি-বিধান রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহতে রয়েছে।
৪. সূরা আনআমে এসেছে-
قُلْ اِنَّنِیْ هَدٰىنِیْ رَبِّیْۤ اِلٰی صِرَاطٍ مُّسْتَقِیْمٍ ۚ۬ دِیْنًا قِیَمًا مِّلَّةَ اِبْرٰهِیْمَ حَنِیْفًا ۚ وَ مَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِیْنَ۱۶۱ قُلْ اِنَّ صَلَاتِیْ وَ نُسُكِیْ وَ مَحْیَایَ وَ مَمَاتِیْ لِلّٰهِ رَبِّ الْعٰلَمِیْنَۙ۱۶۲ لَا شَرِیْكَ لَهٗ ۚ وَ بِذٰلِكَ اُمِرْتُ وَ اَنَا اَوَّلُ الْمُسْلِمِیْنَ۱۶۳
‘আপনি বলে দিন, আমার প্রতিপালক
আমাকে পরিচালিত করেছেন সরল পথের দিকে-এক বিশুদ্ধ দ্বীনের দিকে, অর্থাৎ একনিষ্ঠ
ইব্রাহীমের মিল্লাত (তরীকা), আর তিনি
মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। আপনি বলুন,
নিঃসন্দেহে আমার সালাত, আমার নুসুক, আমার জীবন, আমার মৃত্যু সবকিছুই রাববুল আলামীন
আল্লাহর জন্য। তাঁর কোনো শরীক নেই। আমাকে এই আদেশই করা হয়েছে, সুতরাং
আমি হলাম প্রথম আত্মসমর্পণ কারী।’
এ আয়াতে ‘নুসূক’ শব্দটি
বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এটি ‘নাসীকাহ’ শব্দের বহুবচন, যার অর্থ, আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিলের জন্য
আল্লাহর নামে জবাইকৃত পশু। আর কুরবানীর স্থানকে আরবী ভাষায় এবং শরীয়তের
পরিভাষায় ‘মানসাক’ বলা হয়। দুটো শব্দের মূল ধাতু অভিন্ন। আরবী ভাষার যেকোনো
অভিধানে এবং লুগাতুল কুরআন, লুগাতুল হাদীস ও লুগাতুল ফিকহের যেকোনো নির্ভরযোগ্য
কিতাবে ‘নুসুক’ শব্দের উপরোক্ত অর্থ পাওয়া যাবে।
(দেখুন : ‘আসসিহাহ’ খ.
৪ পৃ. ১৬১২; লিসানুল আরব খ. ১৪ পৃ. ১২৭-১২৮; তাজুল আরূস খ. ৭ পৃ. ২৮৭; আলমুফরাদাত
ফী গারীবিল কুরআন পৃ. ৮০২; আননিহায়া ফী গারীবিল হাদীসি ওয়াল আছার খ. ৫ পৃ. ৪৮;
মাজমাউ বিহারিল আনওয়ার খ. ৪ পৃ.৭১৪-৭১৫; আলমিসবাহুল মুনীর ফাইয়ুমী পৃ. ৩১১;
আলমুগরিব, মুতাররিযী খ. ২ পৃ. ৩০০)
উপরোক্ত আয়াতের অর্থ পরিষ্কার। আল্লাহ তাআলা
হযরত ইবরাহীম আ.কে যে বিশুদ্ধ তাওহীদ ও সরল পথের সন্ধান দিয়েছিলেন তা রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিও নাযিল করেছেন এবং আদেশ করেছেন যে, বলুন,
আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মরণ সব আল্লাহ তাআলার জন্য।
সূরা বাকারার ১৯৬ নং আয়াতেও ‘নুসূক’ শব্দ
এই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
উল্লেখ্য আরবী ভাষায় ‘নুসুক’ ইবাদত
অর্থেও ব্যবহৃত হয়। এজন্য ইবাদতকারীকে ‘নাসেক’ ও
ইবাদতের পদ্ধতিকে ‘মানসাক’ বলা হয়। উল্লেখিত আয়াতে ‘নুসুক’ শব্দের
অর্থ যদি ইবাদতও করা হয়, তবুও তাতে কুরবানী অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। কেননা কুরবানীও
একটি ইবাদত। রাসূল কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদুল আযহার কুরবানীকে
একাধিক হাদীসে ‘নুসুক’ বলেছেন। কুরবানীর পশু যবেহ করার যে দুআ হাদীসে এসেছে তাতেও ওই
আয়াত রয়েছে। পূর্ণ হাদীস লক্ষ করুন।
জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত,
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদের দিন দু’টি
দুম্বা যবেহ করেছেন। যবেহর সময় সেগুলোকে কিবলামুখী করে বলেছেন-
اِنِّیْ وَجَّهْتُ وَجْهِیَ لِلَّذِیْ فَطَرَ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضَ حَنِیْفًا وَّ مَاۤ اَنَا مِنَ الْمُشْرِكِیْنَ اِنَّ صَلَاتِیْ وَ نُسُكِیْ وَ مَحْیَایَ وَ مَمَاتِیْ لِلّٰهِ رَبِّ الْعٰلَمِیْنَ لَا شَرِیْكَ لَهٗ ۚ وَ بِذٰلِكَ اُمِرْتُ وَ اَنَا اَوَّلُ الْمُسْلِمِیْنَ ، بِسْمِ اللهِ وَاللهُ أَكْبرُ، اَللّهُمَّ مِنْكَ وَلَكَ عَنْ مُحَمَّدٍ وَّأُمَّتِهِ.
-সুনানে আবু দাউদ ৩/৯৫, হাদীস : ২৭৯৫; মুসনাদে
আহমদ ৩/৩৭৫ হাদীস : ১৫০২২; সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস : ২৮৯৯
কুরবানীর শুরুতে তাঁর এই আয়াত ও দুআ পড়া থেকে
যেমন প্রমাণ হয় কুরবানী খালিছ ইবাদত তেমনি একথাও প্রমাণ হয় যে, উল্লেখিত
আয়াতে ‘নুসুক’ শব্দের অর্থ ঈদুল আযহার কুরবানী অথবা কুরবানী তাতে অবশ্যই
শামিল রয়েছে।
অন্য আয়াতটি হল সূরা কাউসারের দ্বিতীয় আয়াত। ইরশাদ
হয়েছে-
اِنَّاۤ اَعْطَیْنٰكَ الْكَوْثَرَؕ۱ فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَ انْحَرْؕ۲ اِنَّ شَانِئَكَ هُوَ الْاَبْتَرُ۠۳
এখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লামকে এবং তাঁর মাধ্যমে গোটা উম্মতকে সালাত (নামায) ও নাহ্র (কুরবানীর)
আদেশ দেওয়া হয়েছে। ‘নাহর’ শব্দের মূল অর্থ উট যবেহ করা, তবে সাধারণ ব্যবহারে যেকোনো পশু
যবেহ করাকেই ‘নাহর’ বলে। আয়াতে এমন যবেহ উদ্দেশ্য, যা ইবাদত হিসেবে
করা হয়। সেটা হচ্ছে হজ্ব ও উমরার কুরবানী এবং ঈদুল আযহার সাধারণ কুরবানী।
এ কুরবানীর সময় তিন দিন : যিলহজ্বের দশ, এগারো
ও বারো তারিখ। তবে উত্তম হল দশ তারিখ। সাধারণত এ তারিখেই অধিকাংশ কুরবানী হয়ে
থাকে। এজন্য দশ যিলহজ্বের ইসলামী নাম ‘ইয়াওমুন নাহর’।
-সহীহ বুখারী হাদীস ৫৫৫০
আয়াতে নামাযের যে আদেশ এসেছে তাতে ঈদের নামাযও
শামিল রয়েছে। উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলা যে বিধান দান করেছেন তা পালন করার
পদ্ধতি নবীজী তাঁর সুন্নাহর মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন। একটি হাদীস লক্ষ
করুন।
সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম ও অন্যান্য হাদীসের
কিতাবে বহু সনদে বর্ণিত হয়েছে যে, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম ঈদুল আযহার দিন নামায পরবর্তী খুতবায় বলেছেন, এই দিনের প্রথম কাজ হল
সালাত আদায় করা এরপর নহর (কুরবানী) করা। যে সালাত আদায়ের পর নুসুক (কুরবানী) করল
তার নুসুক পূর্ণ হল এবং সে মুসলিমদের পথ অনুসরণ করল। আর যে সালাতের আগে যবেহ করল
সেটা তার গোশতের প্রয়োজন পূরণ করবে, কিন্তু ‘নুসুক’ হিসেবে
গণ্য হবে না।
এই হাদীস বহু সহীহ সনদে বিভিন্ন হাদীসের কিতাবে
উল্লেখিত হয়েছে। কোথাও বিস্তারিতভাবে, কোথাও সংক্ষিপ্তভাবে।
(দেখুন : সহীহ বুখারী, হাদীস, ৯৫১, ৯৫৫, ৯৬৫,
৯৬৮, ৫৫৪৫, ৫৫৪৬; সহীহ মুসলিম হাদীস ১৯৬১, ৪, ৬, ৭; মুসনাদে আহমদ ৪/২৮১-২৮২, ৩০৩;
জামে তিরমিযী হাদীস ১৫০৮, সুনানে নাসায়ী হাদীস ৪৩৯৪-৪৩৯৫; সহীহ ইবনে হিববান হাদীস
৫৯০৭, ৫৯১০, ৫৯১১)
এই হাদীসে সূরাতুল কাউসারের ব্যাখ্যা নবী
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমল থেকে পাওয়া গেল, যার সারমর্ম এই যে, ‘সালাত
আদায় করুন’ শব্দে ঈদের নামায এবং ‘কুরবানী করুন’ শব্দে
ঈদুল আযহার কুরবানীও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। একথাও স্পষ্ট হয়ে গেল যে, ঈদুল আযহার
কুরবানী হচ্ছে নুসুক, যা সূরা আনআমের ১৬২ নং আয়াতে উল্লেখিত হয়েছে। এর উদ্দেশ্য
গোশত ভক্ষণ করা বা গোশতের প্রয়োজন পূরণ করা নয়। এটা একটা ইবাদত। তবে কুরবানী
হয়ে যাওয়ার পর আল্লাহ তাআলা সে পশুর গোশত কুরবানীদাতার জন্য হালাল করেছেন এবং দশ
যিলহজ্ব থেকে মোট চার দিন রোযা রাখতে নিষেধ করে যেন তাঁর মেহমানদারী কবুল করার
আদেশ দিয়েছেন।
ঈদুল আযহা মুসলমানদের আনন্দের দিন। আরাফা দিবসের
ব্যাপক মাগফিরাত, আল্লাহর দরবারে কুরবানী পেশ করার সৌভাগ্য এবং আল্লাহর দরবারে
কবুল হওয়া কুরবানী থেকে মেহমানদারী লাভ ওই আনন্দের কারণ। বলাবাহুল্য, এই তাৎপর্য
অনুধাবন করার জন্য অন্তরে প্রয়োজন ঈমানের মিষ্টতা এবং খালিক ও মালিকের মহববত ও
ভালোবাসা। বস্ত্তবাদী ও যুক্তিপূজারী হৃদয় দুঃখজনকভাবে এ নিয়ামত থেকে শূন্য।
সুন্নাহর আলোকে কুরবানী
কুরবানী বিষয়ক ‘সহীহ’ ও ‘হাসান’ হাদীস
একত্র করা হলেও একটি দীর্ঘ কিতাব তৈরি হতে পারে। এখানে আরো কয়েকটি হাদীস পেশ
করছি।
১. উম্মে সালামা রা. থেকে বর্ণিত, নবী
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে কুরবানীর ইচ্ছা রাখে সে যেন
যিলহজ্বের চাঁদ দৃষ্টিগোচর হওয়ার পর থেকে কুরবানী করা পর্যন্ত তার নখ, চুল
ইত্যাদি কর্তন না করে।
-সহীহ মুসলিম হাদীস ১৯৭৭/৩৯-৪২; তিরমিযী হাদীস
১৫২৩; আবু দাউদ, হাদীস ২৭৯১; নাসায়ী হাদীস ৪৩৬২-৪৩৬৪, সহীহ ইবনে হিববান হাদীস
৫৮৯৭, ৫৯১৬, ৫৯১৭
২.আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. থেকে বর্ণিত এক দীর্ঘ
হাদীসে এসেছে যে, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে
দ্বীন বিষয়ে জানতে এসেছিল। ফিরে নিয়ে যাওয়ার সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ডাকলেন এবং বললেন, ‘আমাকে ইয়াওমুল আযহার আদেশ করা
হয়েছে (অর্থাৎ, এ দিবসে কুরবানী করার আদেশ করা হয়েছে।) এ দিবসকে আল্লাহ এ
উম্মতের জন্য ঈদ বানিয়েছেন। লোকটি বলল, আমার কাছে যদি শুধু পুত্রের দেওয়া একটি
দুধের পশু থাকে আমি কি তা-ই কুরবানী করব? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম বললেন, না, বরং তুমি সেদিন তোমার মাথার চুল কাটবে (মুন্ডাবে বা ছোট
করবে) নখ কাটবে, মোচ কাটবে এবং নাভির নিচের চুল পরিষ্কার করবে। এটাই আল্লাহর কাছে
তোমার পূর্ণ কুরবানী বলে গণ্য হবে।
-মুসনাদে আহমদ ২/১৬৯; হাদীস ৬৫৭৫; সহীহ ইবনে
হিববান হাদীস ৭৭৩, ৫৯১৪; আবু দাউদ হাদীস ২৭৮৯; নাসায়ী হাদীস ৪৩৬৫
৩. আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যার সামর্থ্য আছে তবুও সে
কুরবানী করল না (অর্থাৎ কুরবানী করার সংকল্প তার নেই) সে যেন আমাদের ঈদগাহের কাছেও
না আসে।’ -মুসনাদে আহমদ ২/৩২১; মুসতাদরাক হাকিম ৪/২৩১, হাদীস ৭৬৩৯
৪. আলী রা. বলেন, ‘আমাদেরকে
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আদেশ করেছেন আমরা যেন (কুরবানী পশুর)
চোখ ও কান ভালো করে দেখে নিই এবং কান কাটা বা কান ফাড়া ও কানে গোলাকার ছিদ্র করা
পশুর দ্বারা কুরবানী না করি। -মুসনাদে আহমদ ১/৮০; ১০৮, ১৪৯; সহীহ ইবনে খুযাইমা
হাদীস ২৯১৪-২৯১৫; আবু দাউদ হাদীস ২৮০৪; নাসায়ী হাদীস ৪৩৭৩-৪৩৭৪
৫. বারা ইবনে আযিব রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘চার ধরনের পশুর দ্বারা কুরবানী
করা যায় না। যে পশুর চোখের জ্যোতি ক্ষতিগ্রস্ত, যে পশু অতি অসুস্থ, যে পশু খোঁড়া
আর যে পশু অতি শীর্ণ।’ -মুয়াত্তা মালিক ২/৪৮২; সহীহ ইবনে হিববান হাদীস ৫৯১৯; নাসায়ী
হাদীস ৪৩৭০-৪৩৭১; তিরমিযী হাদীস ১৪৯৭
৬. আম্মাজান আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানী করার জন্য একটি দুম্বা আনতে বললেন, যার
শিং রয়েছে, যার পা কালো, পেটের চামড়া কালো এবং চোখ কালো। এ রকম একটি দুম্বা আনা
হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আয়েশা, আমাকে ছুরি দাও।
আরো বললেন, একটি পাথরে ঘষে ধারালো করে দাও। তিনি ধারালো করে দিলেন। নবী
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুম্বাটি মাটিতে শায়িত করলেন। এরপর বিসমিল্লাহ
বলে যবেহ করলেন এবং বললেন-
‘ইয়া আল্লাহ! মুহাম্মাদের পক্ষ থেকে, মুহাম্মাদের পরিবারের পক্ষ থেকে
এবং মুহাম্মাদের উম্মতের পক্ষ থেকে কবুল করুন।’ -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৬৭,
সহীহ ইবনে হিববান হাদীস ৫৯১৫; আবু দাউদ হাদীস ২৭৯২
অন্য হাদীসে এসেছে যে, কুরবানীর পশু যবেহ করার
সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দুআ পড়েছেন-
بِسْمِ اللهِ اَللّهُمَّ مِنْكَ وَلَكَ، اَللّهُمَّ عَنْ مُحَمَّدٍ.
‘আল্লাহর নামে। ইয়া আল্লাহ! তোমার নিকট থেকে এবং তোমার উদ্দেশ্যে।
ইয়া আল্লাহ! মুহাম্মাদের পক্ষ থেকে কবুল করুন।’ -আলমুজামুল কাবীর, তবারানী
হাদীস ১১৩২৯; মাজমাউয যাওয়াইদ ৪/২১
নবীজীর কথায়-‘ইয়া আল্লাহ! তোমার নিকট থেকে
এবং তোমারই উদ্দেশ্যে’ চিন্তা-ভাবনা করলে খুব সহজেই বোঝা যায়, কুরবানীর হাকীকত কী।
আল্লাহ-প্রদত্ত রিযক এবং আল্লাহর নেয়ামত আমরা লাভ করেছি আর আল্লাহর হুকুমে তা
কুরবানী রূপে তাঁর দরবারে পেশ করার সৌভাগ্য লাভ করেছি। আবার তা আল্লাহ তাআলার পক্ষ
থেকে মেহমানদারী হিসেবে গ্রহণ করার নির্দেশনা পেয়েছি।
অতএব পূর্ণ তাওহীদ ও ইখলাসের সঙ্গে নবী
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহ অনুযায়ী কুরবানী করা কর্তব্য।
কুরবানী নামায-রোযার মতো ফরয আমল নয়, তবে অন্যান্য সুন্নতে মুয়াক্কাদার চেয়ে
অধিক গুরুত্বপূর্ণ ওয়াজিব আমল। সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত যে, রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিয়মিত কুরবানী করেছেন, কোনো বছর বাদ দেননি
(আল ইসতিযকার, ইবনে আব্দিল বার ১৫/১৬৩-১৬৪) কখনো
কখনো কুরবানী করার জন্য সাহাবীদের মধ্যে কুরবানীর পশু বণ্টন করেছেন। -সহীহ বুখারী
হাদীস ৫৫৫৫
হযরত আলী রা.কে আদেশ করেছেন যেন (ইন্তেকালের
পরেও) তাঁর পক্ষ থেকে কুরবানী করা হয়। হযরত আলী রা. প্রতি বছর নিজের কুরবানীর
সঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকেও কুরবানী করতেন।
-মুসনাদে আহমদ হাদীস ৮৪৩, ১২৭৮, আবু দাউদ হাদীস ২৭৮৭
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগ
থেকে আজ পর্যন্ত উম্মতের মধ্যে এই ইবাদত ‘তাওয়ারুছ’ ও ‘তাওয়াতুরে’র
সঙ্গে চলমান রয়েছে এবং প্রতিবছর ‘শিয়ার’রূপে
(ইসলামের একটি প্রকাশ্য ও সম্মিলিতভাবে আদায়যোগ্য ইবাদত হিসেবে) তা আদায় করা
হয়েছে।