
বুমেরাং শব্দটির কথা মনে পড়ে গেল। ইতিহাস থেকে জানা যায় বুমেরাং শব্দটি অস্ট্রেলিয়ার নিউসাউথ ওয়েলসের একটি আঞ্চলিক ভাষা থেকে এসেছে। বুমেরাং একখণ্ড বক্রাকৃতি কাঠ, যা অস্ত্র হিসেবে বা খেলার জন্য ব্যবহৃত হয়। কোনো একটি লক্ষ্যবস্তুকে উদ্দেশ্য করে এটি ছুড়ে মারলে সেটি আবার নিজের কাছে ফিরে আসে।
এটি কোনো জাদুবিদ্যা নয়। পদার্থবিজ্ঞানের একটি মৌলিক নীতি মেনে এটি কাজ করে। তবে বুমেরাংয়ের সঙ্গে মানুষের কর্মের ফলাফলের একটা যোগসূত্র থাকতে পারে। যেটি মটিভেশনের একটি থিওরির সঙ্গে মেলানো যেতে পারে। বি এফ স্কেনার তাঁর বিহেভিয়ার মডিফিকেশন থিওরিতে বলেছেন, ভালো কাজের ফলাফল ভালো হয়, মন্দ কাজের ফলাফল মন্দ হয়। এর মানে দাঁড়াচ্ছে, মানুষ মন্দ কিছু করলে সেটা বুমেরাং হয়ে তার কাছে ফিরে আসে। ভালো কাজের ফলাফলও বুমেরাং হয়ে ভালো ফলাফলের জন্ম দেয়। আপাতদৃষ্টিতে যে মানুষ অবৈধভাবে অর্থ-সম্পদ গড়ে তুলছে তাকে সুখী মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে সে সুখী নয়। হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের অধ্যাপক ও সহলেখক মাইকেল নরটনও ‘হ্যাপি মানি : দ্য সায়েন্স অব স্মার্টার স্পেনডিং’ বইয়ের ভাবনাটা অনেকটা একই রকম।
বইটির এক জায়গায় বলা হয়েছে, ‘আসলে সুখকে পাশে রেখে আমরা অর্থ দিয়ে কিছু কিনি না। বরং আমরা আমাদের সুখকে পণ্যের মধ্যে স্থানান্তর করতেই অর্থ ব্যয় করি। যেটি আসলে মূল্যহীন। ড. ম্যাডিলিন লিভিনের দ্য প্রাইস অব প্রিভিলেজে দেখানো হয়েছে কিভাবে সময়ের সঙ্গে মূল্যবোধের পরিবর্তনের কারণে মানুষ ক্রমেই অর্থের দিকে ঝুঁকেছে। উনিশ শ ষাটের দশক ও সত্তরের দশকের প্রারম্ভে কেন ছাত্র-ছাত্রীরা কলেজে যায়, এ প্রশ্ন করা হলে তাদের বেশির ভাগই উত্তর দিত শিক্ষিত হয়ে ওঠা ও জীবন সম্পর্কে জ্ঞান বৃদ্ধি করার জন্যই তারা কলেজে যায়। খুব কমসংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী বলত, অনেক অর্থ উপার্জন করার জন্য তারা কলেজে যায়। কিন্তু উনিশ শ নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে মানুষের মূল্যবোধের পরিবর্তন লক্ষণীয়। এ সময় ছাত্র-ছাত্রীদের কেন তারা কলেজে যায়, এই প্রশ্ন করা হলে বেশির ভাগ ছাত্র-ছাত্রীই উত্তর দিত অনেক অর্থ উপার্জন করার জন্য তারা কলেজে যায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ ইতিবাচক মূল্যবোধকে বিসর্জন দিয়ে নেতিবাচক মূল্যবোধ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। নেতিবাচক ভাবনা কখনো ইতিবাচক ফলাফলের জন্ম দিতে পারে না।
এ কারণে কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে এই মূল্যবোধের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অবসাদ, আত্মহত্যা এবং অন্যান্য মানসিক সমস্যার হার হঠাৎ করে অনেকটাই বেড়ে গিয়েছিল। মূল্যবোধের কেন এমন পরিবর্তন ঘটল? আমাদের লোভ? মানবিক শক্তির চেয়ে টাকার শক্তির আধিপত্য? সৃজনশীল ও উদার দৃষ্টিভঙ্গির বদলে সংকীর্ণ ও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি? দেশপ্রেম ও দেশের স্বার্থের চেয়ে নিজ স্বার্থ ও গোষ্ঠী স্বার্থকে প্রাধান্য? বিশ্বাসঘাতকতা? মুখ ও মুখোশ? দীনতা? দৃশ্যমান শক্তি? দৃশ্যমানের ভেতরের অদৃশ্যমান শক্তি? চেনা শক্তির অচেনা সম্পর্ক? দেয়ালের পর দেয়াল? মানুষের অভিনয়? মানুষ যা না সেটা প্রমাণের চেষ্টা? খেলার পেছনের খেলা? প্রকৃতির প্রতি অনাচার? পেশিশক্তি? হয়তো কোনোটাই না কিংবা সবগুলো? হয়তো জানা-অজানা অনেক কিছু।
যা আমরা জানি-বুঝি কিন্তু বলতে গেলেই থমকে যায়। এই প্রতিবন্ধকতাগুলো যদি মানবিক মূল্যবোধের উৎকর্ষের পথে প্রতিবন্ধকতা বা দেয়াল হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তবে সে দেয়াল ভাঙতে হবে। এক দিন বা দুই দিনে হয়তো তা হবে না। তবে দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা ও মানবিক আচরণের নানা দিক বিশ্লেষণ করে এই প্রাচীর ভাঙতেই হবে? সে ভাবনা হোক আমাদের সবার। শিক্ষাক্ষেত্রে মানবিক আচরণ উন্নয়নের বিষয়টিকে যুক্ত করলে ইতিবাচক ফলাফল আসতে পারে। তবে সেটি হতে হবে ধারাবাহিক ও মানুষের বেড়ে ওঠার সঙ্গে সম্পৃক্ত।
অসততা ও অন্যায়ের ফলাফল যে ভালো হয় না ফেসবুক থেকে সংগৃহীত গল্পটি থেকে সে শিক্ষা আমরা গ্রহণ করতে পারি। ইন্টারভিউ টেবিলের স্যার কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর ভারী গলায় বললেন—বাহ! তোমার সার্টিফিকেট তো বেশ ভালো! তোমাকে আর প্রশ্ন করতে চাচ্ছি না। ধরে নাও তুমি চাকরিটি পেয়ে গেছ। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে বড় স্যারকে উপহার হিসেবে পাঁচ লাখ টাকা দিতে হবে। এক সপ্তাহের মধ্যে টাকাটা জমা করে দাও। তারপর তোমার নিয়োগ হবে। ছেলেটি ইন্টারভিউ রুম থেকে বের হয়ে বাড়িতে এসে তার বাবাকে জানাল, পাঁচ লাখ টাকা না হলে তার চাকরিটা হবে না। গ্রামের সহজ-সরল বাবা নিজের ছেলের চাকরির জন্য ভিটাবাড়ি বিক্রি করে পাঁচ লাখ টাকা জোগাড় করলেন। তারপর বড় স্যারকে উপহার হিসেবে পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে ছেলেটি চাকরি পেয়ে গেল।
আজ বড় স্যারের ছেলের জন্মদিন। বাড়িতে বিশাল পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। তিনি বাড়িতে ঢুকেই তার ছেলের নাম ধরে ডাকতে শুরু করলেন। ছেলে কাছে আসতেই বড় স্যার ‘হ্যাপি বার্থডে মাই সান’ বলতে বলতে ছেলের হাতে পাঁচ লাখ টাকার বাইকের চাবি তুলে দিলেন। বাইক পেয়ে ছেলেটি খুশিতে আত্মহারা হয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার দিয়ে বলল, আমার বাবা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা। বড় স্যারের ছেলে আজ বাইক নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছে ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার বেগে রাজপথে ছুটে চলেছে বাইক। হঠাৎ ট্রাকের সঙ্গে ধাক্কা—সব কিছু থেমে গেল।
বড় স্যারের ছেলেকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হলো। হাসপাতালের বড় ডাক্তার সাহেব জানালেন, আপনার ছেলের অবস্থা ভালো না, খুব জটিল একটা অপারেশন করাতে হবে। হাসপাতালের কাউন্টারে ১০ লাখ টাকা জমা করে দিন। বড় স্যার কোনো উপায় না দেখে মেয়ের বিয়ের জন্য ব্যাংকে জমিয়ে রাখা টাকাটা কাউন্টারে জমা করে দিলেন। বড় ডাক্তার সাহেব আজ খুব খুশি। তিন-চার লাখ টাকার অপারেশনের জন্য ১০ লাখ টাকা নিয়েছেন, পুরোটাই লাভ। খুশিতে তিনি তাঁর একমাত্র মেয়ের জন্য স্বর্ণের নেকলেস কিনে বাসায় ফিরলেন। বাসায় ঢুকেই তিনি তাঁর কলেজপড়ুয়া মেয়েকে মামণি মামণি বলে ডাকতে শুরু করলেন।
ডাক্তার সাহেবের বউ কাঁদতে কাঁদতে বললেন, তাঁদের মেয়ে এখনো বাসায় ফেরেনি। বড় ডাক্তার সাহেব তাঁর মেয়েকে অনেক খোঁজাখুঁজি করলেন, কোথাও কোনো খোঁজ না পেয়ে তিনি যখন দিশাহারা হয়ে পড়লেন, ঠিক তখনই অপরিচিত এক নম্বর থেকে ফোন এলো। ফোনেও ওই প্রান্ত থেকে জানাল, আপনার মেয়ে আমাদের কাছে, মেয়েকে ফেরত পেতে হলে মুক্তিপণ হিসেবে ২০ লাখ টাকা দিতে হবে। কথাটা শুনে বড় ডাক্তার সাহেবের স্ত্রী স্ট্রোক করলেন। এ ঘটনা থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার তা হলো মানুষকে তার কর্মের ফল ভোগ করতেই হয়। কাজেই যেকোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে মানুষকে তার ইতিবাচক ও নেতিবাচক ফলাফলগুলো বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে।
মানুষকে তার মানবিক আচরণ দ্বারা পরিচালিত হতে হবে। দানবিক আচরণ বা অন্য কোনো নেতিবাচক শক্তির আচরণ দ্বারা মানুষ প্রভাবিত হলে তার ফলাফল কখনো শুভকর হয় না। মানুষ তার বিবেক দ্বারা তাড়িত হোক, ভেতরের ঘুমন্ত সত্তাকে জাগিয়ে তুলুক, তবেই মানুষ তার কর্মের মাধ্যমে নিজে যেমন সমৃদ্ধ হবে, সমাজও তেমনি মানুষের দ্বারা সমৃদ্ধ হবে।
---শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরীর ফেসবুক থেকে