দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েই চলছে। পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। ঢাকার বাইরে এখন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী বেশি পাওয়া যাচ্ছে। চলতি মৌসুমে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে এমন আশঙ্কা ছিল বছরের শুরু থেকেই। সেই আশঙ্কাকে বাস্তবতায় রূপ দিয়ে দেশে ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। ২০০০ সাল থেকে শুরু করে পরবর্তী আরও ২৩ বছরে সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী জুলাই মাস পর্যন্ত এত বেশি সংখ্যক রোগীর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর তথ্যও এর আগে পাওয়া যায়নি কোনো বছর। ২০২২ সালে দেশে সর্বোচ্চ ২৮১ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার তথ্য জানানো হলেও চলতি বছরের শুধুমাত্র জুলাই মাসেই মারা গেছেন ২০৪ জন।
দেশে ডেঙ্গু সংক্রমণের যে পরিসংখ্যান তাতে দেখা যায়, আগস্ট, সেপ্টেম্বর মাসেই এর মাত্রা বাড়তে থাকে। তবে ২০২৩ সালে অক্টোবর মাস পর্যন্ত আতঙ্ক ছড়িয়েছে ডেঙ্গু।
চলতি মৌসুমে জানুয়ারি মাস থেকে শুরু হওয়া ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে থাকে জুনে। পরবর্তীতে জুলাই মাস পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর পরিসংখ্যানকে ভয়ঙ্কর হবে বলছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ জুনের তুলনায় সাত গুণের বেশি মানুষ জুলাইয়ে আক্রান্ত হয়। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জুলাই মাস ভয়ঙ্কর। তবে এটা আরও ভয়াবহ রূপ নিবে আগস্ট মাসে। এরপরে এখনো বাকি সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাস। এমন অবস্থায় মশা নিধন কর্মসূচি সফলভাবে পরিচালনা করা না গেলে পরিস্থিতি ভালো হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই।
কীটতত্ত্ববিদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, এবছর মে মাসে যখন বৃষ্টি শুরু হলো, তখন কমিউনিটিতে এডিস মশার ঘনত্ব বাড়তে শুরু করে। জ্যামিতিক হারে এডিস মশা বেড়ে গেছে। এখন জুলাই শেষ। আগস্ট ও সেপ্টেম্বর আমাদের জন্য বেশ শঙ্কার। এবার মৃত্যুতে এবং ডেঙ্গু আক্রান্তের হার বাংলাদেশি ইতিহাস ছাড়িয়ে যাবে। বাংলাদেশে ২০০০ সাল থেকে ডেঙ্গু শুরু হয়েছে জানিয়ে কবিরুল বাশার বলেন, প্রতি বছর ডেঙ্গু জ্বরে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। এবার লক্ষ্য করছি- সবচেয়ে খারাপ অবস্থা। এর পেছনে কারণ কী? আমরা যদি একটু পেছনের দিকে লক্ষ্য করি দেখবো, ফিল্ড লেভেলে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে যত ডেঙ্গু হয়েছে, দেখবেন আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে। ২০২১ সাল পর্যন্ত এ দু’টি মাসের একটি মাসে ডেঙ্গু পিক ছিল। ২০২১ সালে দেখেছি অক্টোবর মাস পর্যন্ত ডেঙ্গু ছিল। এরপর এবার দেখলাম নভেম্বর, ডিসেম্বর পার হয়ে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত ডেঙ্গু চলে আসছে। এ জানুয়ারিতেও ৫০০’র মতো ডেঙ্গু রোগী ছিল। এটা বাংলাদেশের ইতিহাসে ছিল না।
ঢাকা শহরে ‘লাইট পলিউশনের’ কারণে এডিস মশা এখন দিনে হোক বা রাতে সব সময় কামড়ায় জানিয়ে কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার বলেন, লাইট পলিউশনের বিষয়টি আমরা তিন বছর ধরে গবেষণা করে প্রমাণ করেছি। এ পলিউশন নিয়ে পৃথিবীর কোথাও কথা হয় কিনা জানি না। লাইট পলিউশন কিন্তু একটা বিশাল বড় পলিউশন। এ কারণে এডিস মশা তার আচরণে পরিবর্তন করেছে। এই পরিবর্তনকে টার্গেট করে আমাদের এডিস মশার নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নিতে হবে। মশক নিধন কার্যক্রম আরও জোরদার করতে হবে। তিনি বলেন, মশা জন্মানোর তথ্য ও উপাত্ত বিশ্লেষণ করে যারা মশার নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে আছেন তারা টার্গেট করে মশার নিধন করতে হবে। এডিস মশা যেখানে হয় সেখানে টার্গেট করে আমাদের তা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা করতে হবে। যেখানে হয়তো আমরা পারছি না, কেন পারছি না, সেটা বের করতে হবে। এতদিন আমরা মশার জন্য ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে চেপে ধরেছি। কিন্তু এখন আমরা দেখছি সারা দেশে মশা ছড়িয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশের উপশহর, উপজেলাতে ডেঙ্গু ছড়িয়ে গেছে। কেউ জানে না কেন উপজেলাতে ডেঙ্গু হচ্ছে। সে গবেষণাটা কে করবে, সে গবেষণার ফাইন্ডিং কে দেবে সেটি রাষ্ট্রকে ভাবতে হবে। এটা ভাবলে আমাদের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাটাকে আরও জোরদার করবে বলে জানান কবিরুল বাশার। তিনি বলেন, যখন থেমে থেমে বৃষ্টি হয়, তখন এডিস মশার ঘনত্ব বাড়ে। ভারী বর্ষণ হলে এডিস মশার ডেনসিটি কমবে। এখন থেমে থেমে বৃষ্টিটাই আমাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. জাহিদুর রহমান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সারা বিশ্বেই হঠাৎ তাপদাহ বা অতিবৃষ্টি হচ্ছে। তাই সারা বছরই ডেঙ্গু থাকবে। তবে বর্ষার শুরু এবং শেষে এর প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি থাকবে। তাই জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু পরিস্থিতি হয়ে উঠে ভয়ঙ্কর। আগস্ট মাসে আরও বাড়তে পারে ডেঙ্গুর প্রকোপ।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)-এর উপদেষ্টা এবং সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু সংক্রমণ উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে থাকবে। এরপর ধীরে ধীরে কমবে। যে হারে তাপমাত্রা বাড়ছে, সংক্রমণ আগস্টে শীর্ষে পৌঁছানোর আশঙ্কা রয়েছে। এবারের সংক্রমণকে ডেঙ্গুর দ্বিতীয় ঢেউ বলা যায়। কারণ গত বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি নভেম্বর-ডিসেম্বরের পর একটু কম ছিল। চলতি বছর মার্চ থেকে বাড়তে শুরু করে।
ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে খ্যাতিমান মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, ২০২২ সালে ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ ছিল। সে সময় আক্রান্ত ছিল ৬২ হাজারের বেশি এবং মারা যায় ২৮১ জন। তবে এবার সেটাও ছাড়িয়ে যাবে মনে হচ্ছে। আক্রান্ত ও মৃত্যুর যে হিসাব আসছে, প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি। ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, অনেকের ঘরেই জ্বরের রোগী আছে, চিকিৎসা নিচ্ছে না। ঘরে থেকেই ভালো হয়ে যাচ্ছে। সেগুলো তো রিপোর্টে আসে না।
তবে এভাবে যদি বাড়তে থাকে অবস্থা আগামী এক থেকে দুই মাসে আরও খারাপের দিকে যাবে। যত আক্রান্ত হবে মৃত্যুর ঝুঁকি অনেক বেড়ে যাবে। ডেঙ্গু রোগীর জন্য রক্তের তেমন দরকার নেই জানিয়ে এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, ডেঙ্গু হলে আবার অনেকে রক্ত দেয়ার জন্য অস্থির হয়ে যায়। তবে রক্ত দেয়ার দরকার নেই ডেঙ্গু মশার জন্য। রক্ত তখনই লাগে যখন রোগীর রক্তপাত হয়। সেখানে চিকিৎসক চাইলে রক্ত দিতে পারে। কিন্তু ডেঙ্গু হলেই যে ব্লাড দিতে হবে এমনটা না। ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে খুব বেশি প্লাটিলেট প্রয়োজন হয় না। যারা মারা যায় তারা প্লাটিলেট কমের জন্য মারা যায় না। অনেকে মারা যায় প্লাজমা লিকেজের ফলে। শরীর থেকে লিকুইড চলে যায়। যেমন প্রেসার কমে যায়, প্রস্রাব হয় না, কিডনি ফেইলিউর, লিভার ফেইলিউর শকে চলে যায়। আর রোগীরা এসব কারণে মারা যায়। এ কারণে অযথা প্লাটিলেট নিয়ে চিন্তিত হবেন না। বেশির ভাগ ডেঙ্গু রোগের প্লাটিলেট বা রক্ত লাগে না।