রোকসানা মনোয়ার :বর্ষার আগেই এবার চোখ রাঙাচ্ছে এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু।
ডেঙ্গুর ৪টি ধরনই এখন সক্রিয়। বছরের প্রথম পাঁচ মাসেই দেশজুড়ে আক্রান্ত ছাড়িয়েছে ২
হাজার। দেশে জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রজনন মৌসুম। এবার বর্ষা মৌসুম
শুরু না হতেই আক্রান্ত রোগী আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে, যা গত বছরের প্রথম পাঁচ
মাসের তুলনায় ছয়গুণ বেশি। ফলে আক্রান্ত ও মৃত্যু আরো বাড়ার শঙ্কায় আছে স্বাস্থ্য
অধিদপ্তর। জটিলতা এড়াতে সরকারি ল্যাবে শনাক্তকারী কিট সরবরাহের তাগিদ দিয়েছেন
বিশেষজ্ঞরা। এদিকে, ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে
নতুন চারজন রোগী দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
শুক্রবার (২ জুন) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি
অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো ডেঙ্গুবিষয়ক এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ
তথ্য জানানো হয়।
এতে বলা হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে নতুন চারজন
ডেঙ্গুরোগী বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। নতুন ভর্তি রোগীর দুই জন ঢাকার
বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এবং দুই ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি
হয়েছেন। বর্তমানে সারা দেশে সর্বমোট ৩৩২ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন।
এর মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ২৮৯ জন এবং ঢাকার বাইরে ৪৩ জন ডেঙ্গুরোগী
হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন।
২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২ জুন পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন
হাসপাতালে মোট ২ হাজার ১৩৮ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকায় ১ হাজার
৪৭৯ জন এবং ঢাকার বাইরে ৬৫৯ জন হয়েছেন। একই সময়ে সারা দেশে সর্বমোট ছাড়প্রাপ্ত ডেঙ্গু
রোগী ১ হাজার ৭৯৩ জন। এর মধ্যে ঢাকায় ছাড়প্রাপ্ত রোগী ১ হাজার ১৮০ জন এবং ঢাকার
বাইরে ৬১৩ জন।
বিজ্ঞপ্তিতে আরো জানানো হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু
আক্রান্ত হয়ে কারো মৃত্যু হয়নি এবং এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মোট ১৩ জনের মৃত্যু
হয়েছে। গতকাল শুক্রবার ছুটির দিন হওয়ায় দেশের বেশিরভাগ হাসপাতাল ডেঙ্গুর রিপোর্ট
দেয়নি, তাই সেগুলো শনিবারের রিপোর্টের সঙ্গে সমন্বয় করা হবে।
পরিসংখ্যান বলেছে, ২০২২ সালের প্রথম ৫ মাসে ডেঙ্গু রোগী ছিল
৩১৭ জন। ওই সময়ে এই রোগে কারো মৃত্যুর খবর মেলেনি। তবে এ বছরের প্রথম ৫ মাসেই
আক্রান্ত ১ হাজার ৯২৭ জন। এর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ১৩ জনের। অর্থাৎ গত বছরের একই
সময়ের তুলনায় রোগী বেড়েছে ১৬ গুণ।
সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের ভাইরোলজিস্ট ডা. মো. জাহিদুর
রহমান খান বলেন,
এই সংখ্যা সামনে আরো বাড়বে। কারণ দেশে এখন ডেঙ্গুর চারটি ধরণই
সক্রিয় রয়েছে। তিনি আরো বলেন, প্রতি ১০০ জন ডেঙ্গু রোগীর
মধ্যে মাত্র ২৫ জনের লক্ষণ দেখা যায়। তাই জটিলতা এড়ানো ও সুচিকিৎসায় হাসপাতালে
ভর্তি রোগীদের ডেঙ্গুর ধরণ পরীক্ষা করা দরকার। তবে এজন্য সরকারি হাসপাতালের ল্যাবে
সরবরাহ করতে হবে শনাক্তকারী কিট। রোগটির টিকা ও ওষুধ না থাকায় ডেঙ্গু প্রতিরোধের কোনো
বিকল্প নেই বলেছেন এই বিশেষজ্ঞ।
এছাড়া সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে মানুষকে সচেতন থাকার
আহ্বান জনিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও নানা
দিকনির্দেশনা দিয়েছে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে। কীটতত্ত্ববিদ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের
মতে, এ রোগে
আক্রান্ত রোগী যদি কোমরবিডিটি বা দীর্ঘমেয়াদি জটিল রোগে আক্রান্ত হয়, তাদের মৃত্যুঝুঁকি বেশি থাকে। ডেঙ্গু রোগের বিস্তারকে সংশ্লিষ্টদের
সমন্বয়হীনতা ও দায়িত্বে অবহেলাকে দুষছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। যেহেতু রোগটি
সারাবছর ধরেই ছড়াচ্ছে, তাই এটি নিয়ন্ত্রণ করতে হলে এডিস মশা
নিধন কর্মসূচি সারাবছর অব্যাহতভাবে রাখতে হবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ (প্রাণিবিদ্যা বিভাগ) অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, সম্প্রতি হওয়া বৃষ্টিপাত এর মূল কারণ হতে পারে। অনেক জায়গায় পাওয়া যাচ্ছে এডিস মশার লার্ভা। এর মধ্যে রয়েছে বহুতল ভবনের ছাদ, পার্কিংয়ের জায়গা, নির্মাণাধীন ভবনের বেজমেন্ট। বাড়িতে জমিয়ে রাখা পানিতেও জন্ম নিচ্ছে ডেঙ্গু মশা। তিনি আরো বলেন, ডেঙ্গু নিধনে সঠিকভাবে কর্ম পরিচালনা করলে এ রোগের বিস্তার রোধ করা সম্ভব। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ও ডেঙ্গু টেস্টকারীদের ডেঙ্গু ধরা পড়লে তাদের বসবাসের স্থান যাচাই করে হটস্পট নির্ধারণ করতে হবে।
এরপর সে সব জায়গায় ডেঙ্গু মশার বিস্তার
রোধ করতে হবে। বিশেষ করে উড়ন্ত মশারা ডেঙ্গু ছড়ায়। তাই এই হটস্পট নির্ধারণ করে
দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে মশা নিধনে জনসম্পৃক্ততা ও ঝুঁকিপূর্ণ
এলাকাগুলোয় ফগিং করে উড়ন্ত এডিস মশা নিধন কর্মসূচি জরুরি। কবিরুল বাশার আরো বলেন,
এ বছর জুন মাসের শেষ দিকে ঈদুল আজহার ছুটিতে মানুষজন ঢাকা থেকে
গ্রামে যাবে। এই সময়ে শহর থেকে ডেঙ্গুর প্রকোপ গ্রামেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাই ঢাকার
বাইরে আঞ্চলিক শহর ও গ্রামে ডেঙ্গু নিধনে ব্যবস্থা নিতে হবে।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দুই সিটি করপোরেশনের
সঙ্গে কাজ করছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক
নাজমুল ইসলাম। তিনি বলেন,
এবছর অন্য বছরের তুলনায় মৌসুম শুরুর আগেই আক্রান্ত রোগী বেশি। তাই
আগের চেয়ে এবার ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি হওয়ার আশঙ্কা আছে। এরই মধ্যে অনেক রোগী
আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে আসছেন। তাই ডেঙ্গু প্রতিরোধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।
সাধারণ মানুষকে সচেতন থাকতে হবে।
এদিকে, ডেঙ্গুর প্রকোপে ডেঙ্গু শনাক্তকরণ পরীক্ষায়
অতিরিক্ত খরচ যাতে না হয়, সেজন্য মূল্য উল্লেখ করেছে স্বাস্থ্য
অধিদপ্তর। ডেঙ্গু শনাক্তের পরীক্ষার ফি বাবদ সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা নিতে পারবে
বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলো। এর বেশি নেওয়া হলে ওই হাসপাতালের বিরুদ্ধে
ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে সরকারি হাসপাতালগুলোয় ডেঙ্গু শনাক্তের পরীক্ষার ফি ১০০
টাকা।