পরিবেশ
অধিদপ্তরের কোনো ছাড়পত্র ছাড়াই চলছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (ঢামেক)। স্বাস্থ্যসেবা
প্রতিষ্ঠানটিতে নেই কোনো তরল বর্জ্য শোধনাগার বা ইটিপি প্লান্ট। পরিবেশ অধিদপ্তরের
প্রতিবেদন বলছে, ঢামেকের তরল বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে ঢাকার জীববৈচিত্র্যের আধার হিসেবে
খ্যাত বুড়িগঙ্গা। শুধু ঢামেক নয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়সহ (বিএসএমএমইউ)
২২০টি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের তরল বর্জ্য দূষিত করছে রাজধানীর খাল ও নদ-নদীগুলোকে।
দূষণকারী হাসপাতালের তালিকায় নাম
রয়েছে শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট অ্যান্ড হসপিটাল, ২৫০ শয্যার টিবি
হাসপাতাল, ইনফেকশাস ডিজিজেস হসপিটাল, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ক্যান্সার রিসার্চ
অ্যান্ড হসপিটাল, কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতাল, কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি
হাসপাতালের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর। পরিবেশ অধিদপ্তর নিয়মিত চিঠি দিলেও হাসপাতালগুলো
তরল বর্জ্য নির্গমন কমাচ্ছে না।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের পক্ষ
থেকে পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছে ঢাকা জেলার নদ-নদী, খাল-বিল দূষণকারীদের তালিকা চাওয়া
হয় ২০২১ সালের নভেম্বরে। এক মাস পর পরিবেশ অধিদপ্তর ঢাকার খাল ও নদ-নদী
দূষণকারীদের তালিকা নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে। এতে প্রাথমিকভাবে দূষণের ২৮০টি
উৎস চিহ্নিত করা হয়। সেখানে দেখা যায়, শিল্পবর্জ্যের পাশাপাশি রাজধানীর হাসপাতালের
তরল বর্জ্যও দূষণের একটি বড় উৎস। প্রতিবেদনে উল্লিখিত ২৮০টি উৎসের মধ্যে ২২০টিই
ছিল হাসপাতাল।
রাজধানীর হাসপাতালগুলোর তরল
বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে বুড়িগঙ্গা নদী, তুরাগ নদ, বালু নদ, রামপুরা খাল, কল্যাণপুর
খাল, বেগুনবাড়ি খাল, ভাটারা খাল, হাজারীবাগ খাল, রামচন্দ্রপুর খাল, বাড্ডা খাল,
আদি বুড়িগঙ্গা ও রূপনগর খাল। দূষণকারী হাসপাতালের মধ্যে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল
কলেজ হাসপাতাল, এসপিআরসি জেনারেল হাসপাতাল, ঢাকা মহানগর হাসপাতাল, ঢাকা মহানগর
শিশু হাসপাতাল, ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতাল, তাকওয়া স্পেশালাইজড
হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, শাহাবুদ্দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা
কমিউনিটি হাসপাতাল, মেডিলাইফ স্পেশালাইজড হাসপাতাল, কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতাল,
ঢাকা শিশু হাসপাতাল, গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল ইত্যাদির নাম উল্লেখযোগ্য।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের
পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘আমাদের
হাসপাতালের বর্জ্য চিকিৎসা বর্জ্যের শর্তগুলো মেনে সুষ্ঠুভাবে ব্যবস্থাপনা করা হয়।
আমরা কোনোভাবেই নদী বা খালে বর্জ্য ফেলি না। আর ইটিপির প্রয়োজন শিল্প-কারখানায়। হাসপাতালে
প্রয়োজন হয় বলে আমার জানা নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর
সরকারি হাসপাতালগুলোয় ইটিপি নেই বললেই চলে। পরিবেশ অধিদপ্তরের একটি সূত্র জানিয়েছে,
সরকারি হাসপাতালে ইটিপি বা ছাড়পত্র নেয়ার বিষয়ে সংস্থাটির পক্ষ থেকে কড়াকড়ি করা হয়
না। মূলত হাসপাতাল বিবেচনায় এ বিশেষ ছাড় দেয়া হয়। যদিও সংস্থাটির মনিটরিং অ্যান্ড
এনফোর্সমেন্টের পরিচালক মোহাম্মাদ মাসুদ হাসান পাটোয়ারীর দাবি, হাসপাতালে ইটিপি
স্থাপনের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়েই দেখা হচ্ছে। অভিযান চালিয়ে কয়েকটি হাসপাতালকে
জরিমানা করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের উদ্যোগের পর এখন অনেক হাসপাতালই
ইটিপি স্থাপন করছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, বেসরকারি
হাসপাতালে ইটিপি স্থাপনের বিষয়ে তারা জোরালোভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এর পরও ইটিপি আছে
এমন বেসরকারি হাসপাতালের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য নয়। তবে সরকারি হাসপাতালের ক্ষেত্রে
ছাড় দেয়ার অভিযোগ মানতে রাজি নন মোহাম্মাদ মাসুদ হাসান পাটোয়ারী। তিনি বলেন, ‘আমরা
মূলত অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে থাকি। সরকারি হাসপাতালের বিষয়ে কোনো অভিযোগ আমরা
পাইনি।
হাসপাতালগুলো গুরুত্বপূর্ণ সেবা
দিচ্ছে—এ অজুহাতে নদী-খাল দূষণের মতো পরিবেশ বিপর্যয় ডেকে আনে এমন কাজগুলো
হালকা করে দেখার কোনো সুযোগ নেই বলে মত দিয়েছেন রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের
(আরডিআরসি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ। তিনি বলেন, ‘পরিবেশ অধিদপ্তর
এক্ষেত্রে দুটি কাজ করবে। প্রথমে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও বেসরকারিভাবে যারা ইটিপি সার্ভিস
দেয় তাদের নিয়ে একসঙ্গে বসবে। তাদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবে।
এরপর একটা নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেবে। ওই সময়ের মধ্যে যদি ইটিপি স্থাপন না করে
কিংবা ছাড়পত্র না নেয় তাহলে অভিযান চালিয়ে বিদ্যুৎ-পানি ও গ্যাস লাইন বিচ্ছিন্ন
করে দেবে।
একসময় রাজধানীর ভেতর দিয়ে
প্রবাহিত হয়েছে বেশ কয়েকটি বড় নদী। কারওয়ান বাজারের নড়াই ও পুরান ঢাকার দোলাই নদী
খুব দ্রুতই পরিণত হয়েছে ঝিল ও খালে। অপরিকল্পিত নগরায়ণে হারিয়ে গেছে অনেক খাল ও
উল্লেখযোগ্য নদ-নদী।
ঢাকাকে বাঁচাতে হলে বিদ্যমান
জলাশয়গুলো রক্ষার তাগিদ দিয়েছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান
নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, ‘হাসপাতাল হলো মানুষের সুস্থ হওয়ার
জায়গা। কিন্তু সে হাসপাতালই যদি রাজধানীর ধুঁকে ধুঁকে টিকে থাকা জলাশয়গুলো দূষিত করে
তাহলে মানুষ যাবে কোথায়? এসব দূষণের কারণে আজ আমাদের খাওয়ার পানিও নষ্ট হয়েছে। এখন
পানি আনতে হয় মেঘনা থেকে। হাসপাতালের ডিসচার্জ করা পানি খেয়ে মানুষ তো আবার হাসপাতালেই
যাবে। এভাবে চলতে পারে না। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর ঢামেক বা সরকারি বড় হাসপাতালগুলোর
তরল বর্জ্যে নদী দূষণের বিষয়টি মেনে নেয়া যায় না।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু
পরির্তনমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘আমরা হাসপাতালের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার
নীতিমালা নিয়ে আরো ডিটেইল কাজ করছি। নীতিমালা করে দেব। এগুলো বাস্তবায়ন করবে স্থানীয়
সরকার মন্ত্রণালয় ও সিটি করপোরেশন।