মাজহারুল ইসলাম মাসুম : ঢাকার যানজট নিরসনে স্বল্পমেয়াদি ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাগত উদ্যোগের পাশাপাশি পরিবহন পরিকল্পনা ও নগর পরিকল্পনার কার্যকর সমন্বয় প্রয়োজন। পরিকল্পিতভাবে কাজ করা না গেলে যানজট নিরসনে সফলভাবে সব প্রকল্প বাস্তবায় করেও ঢাকার যানজট নিরসন করা যাবে না। যদি না সারা দেশের আঞ্চলিক উন্নয়নের বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে ঢাকামুখী জনস্রোত কমানো না যায়।
মঙ্গলবার সকাল ১১টায় ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) এর আয়োজনে 'স্বাভাবিক ঢাকায় অসহনীয় যানজট : পরিবহন পরিকল্পনা ও নগর পরিকল্পনার প্রেক্ষিত বিশ্লেষণ ও প্রস্তাবনা' শীর্ষক নগর সংলাপে আলোচকরা এই প্রস্তবনা দেন। আলোচনা অনুষ্ঠানে নগর পরিকল্পনা ও পরিবহন পরিকল্পনা সংশ্লিষ্টরা অনলাইন মাধ্যমে যুক্ত হয়ে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেন।
ঢাকা শহরের ট্রাফিক সমস্যা নিরসনে নগরের বাস সার্ভিস এর তাৎপর্য উন্নয়ন নিশ্চিত করা ও বিদ্যমান বাস রুট রেশনালাইজেশন এর উদ্যোগকে অতি দ্রুত প্রস্তাবিত শহরের সকল রুটে সম্প্রসারিত করার বিষয়ে আলোচকরা গুরুত্ব দেন। পাশাপাশি রুট পারমিটবিহীন বাস সার্ভিসসমূহকে চিহ্নিত করে নগরের সমগ্র বাস সার্ভিসকে শৃংখলার মধ্যে নিয়ে আসার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরা হয়।
নাগরিক সংলাপে মেট্রো রেল, নগর পরিবহন বাস সার্ভিসসহ গণপরিবহনের সাথে অন্যান্য পরিবহন মাধ্যম এর সমন্বিত নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা এবং কমিউনিটিভিত্তিক মানসম্মত প্যারাট্রানজিট পরিকল্পনা তৈরি করা ও কমিউনিটি মবিলিটি প্ল্যান প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করবার মাধ্যমে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় শৃংখলা আনা সম্ভব হতে পারে বলে মত দেন বক্তরা। একইসাথে পথচারীদের অগ্রাধিকার দিয়ে পরিবহন পরিকল্পনা করা ও সড়কগুলোর ডিজাইন তৈরি করবার পাশাপাশি সড়কের প্রশস্ততা বাড়ানো কিংবা অন্য কোনো অবকাঠোমো উন্নয়ন এর কারণ দেখিয়ে কোনোভাবেই ফুটপাথ কমানো কিংবা অকার্যকর করে না রাখার বিষয়টি তুলে ধরা হয়।
এ ছাড়া বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার চাহিদা ভিত্তিক নগর পরিবহন চালু করা ও পরিধি বাড়ানোর বিষয়ে পরামর্শ তুলে ধরা হয়। যেমন ছাত্র-ছাত্রীদের বাস সার্ভিস, মহিলাদের বাস সার্ভিস, প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ বাস সার্ভিস, শিল্প শ্রমিক বাস সার্ভিস প্রভৃতি সার্ভিস নগরে পরিচালনার মাধ্যমে নগরের ট্রাফিক ব্যবস্থা একটা পর্যায়ে উন্নত করা সম্ভব। তবে যানজট সমস্যার কার্যকর সমাধান পেতে হলে পরিবহন পরিকল্পনা ও নগর পরিকল্পনার মধ্যে সুষ্ঠু সমন্বয় করতে হবে বলে মনে করেন নগর পরিকল্পনা ও পরিবহন পরিকল্পনা সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
আয়োজক প্রতিষ্ঠান জানান, যানজট ঢাকা মহানগরীর অন্যতম সমস্যা। বিগত দিনগুলোতে বিভিন্ন ধরনের পরিবহন পরিকল্পনা ও নগর পরিকল্পনার নানাবিধ উদ্যোগ এবং যানজট সমাধানে অনেক সড়ক ও অবকাঠামোগত প্রকল্প নেওয়া হলেও এর সুফল তেমন একটা দৃশ্যমান হচ্ছে না। করোনার কারণে বিগত বছরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ বন্ধ থাকলেও স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় স্বাভাবিক সময়ের মতো চালু হবার পর নগরে যানজট বেড়েছে তীব্রভাবে, যা নগর জীবনকে স্তব্ধ করে দিচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে আইপিডি নগর সংলাপের আয়োজন করেছে।
নগর সংলাপের মূল প্রবন্ধে আইপিডি’র পক্ষ থেকে ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, নগরে সুষ্ঠু যোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে সড়ক এলাকার বরাদ্দকৃত ভূমি ২০-২৫ ভাগ হওয়া প্রয়োজনীয় হলেও ঢাকায় ১০ ভাগের ও কম সড়ক বিদ্যমান। এরপরও সেবাসংস্থা, সড়ক সংস্থা ও নগর সংস্থাসমূহের সমন্বয়হীন খোঁড়াখুঁড়ি, অনিয়ন্ত্রিত পার্কিং ও হকার অব্যবস্থাপনার কারণে ঢাকার সড়কগুলো সক্ষমতার ৬০-৭০ ভাগ এর বেশি কার্যকারিতা দেখাতে পারে না। আবার বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে নগর এলাকার জনঘনত্ব ৬০-৮০ জন প্রতি একরে যা অল্প কিছু আরবান ডিস্ট্রিক্ট এ সর্বোচ্চ ১২০ হতে পারে। কিন্তু ঢাকায় জনঘনত্ব একর প্রতি ৩০০-৪০০, কোনো কোনো এলাকায় ৬০০-৭০০ প্রতি একরে। তিনি বলেন, ঢাকার সড়কগুলো তার কার্যকর সক্ষমতার ৬-৭ গুণ ট্রাফিক ধারণ করবার চ্যালেঞ্জের সামনে। পাশাপাশি নগর জনসংখ্যা ৭০ লাখ অতিক্রম করলে ডিজইকোনমিস অফ স্কেল কার্যকর হতে থাকে। অর্থাৎ তখন সড়ক, অবকাঠামো ও অন্যান্য বিনিয়োগ ব্যয় এর তুলনায় নগর তথা রাষ্ট্রের উন্নয়ন এর সুফল অপেক্ষাকৃতভাবে অনেক কমে যায়। ঢাকার ট্রাফিক সমস্যার সমাধানে সমন্বয়হীন প্রকল্প উদ্যোগ চলমান থাকলেও বাস্তবিকভাবে যানজট সমস্যার সমাধান পাওয়াটা খুবই দুরূহ।
মূল প্রবন্ধে আদিল মোহাম্মদ খান আরো বলেন, ঢাকার যানজট সমাধানের দ্রুত স্বস্তি খুজতে গেলে ট্রাভেল ডিমান্ড ম্যানেজমেন্টের (ভ্রমণ চাহিদা ব্যবস্থাপনা) যেমন, স্কুল-কলেজগুলোর সময়সীমা ও ছুটির সূচি, মার্কেটসমূহের খোলা-বন্ধ ও বন্ধের সূচিতে বাস্তবসম্মত পরিবর্তন আনা যেতে পারে। দীর্ঘ মেয়াদে সমাধান খুঁজতে গেলে পরিবহন পরিকল্পনার মূল ভিত্তি হওয়া প্রয়োজন গণপরিবহনকে কেন্দ্র করে হাঁটা-সাইকেল-বাস-কমিউনিটিভিত্তিক প্যারাট্রানজিট ব্যবস্থা তৈরি করা। সাম্প্রতিক আলোচিত জোড়-বেজোড় ভিত্তিক ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবস্থাপনা কার্যকর হবার মূল শর্ত মানসম্মত গণপরিবহন এই নগরে নিশ্চিত না করা পর্যন্ত এই ধরনের ব্যবস্থা ঢাকা শহরে সফলতা পাবার সম্ভাবনা কম।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এর বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) এর প্রকল্প পরিচালক ও ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) এর পরিচালক মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, ঢাকার ভৌত পরিকল্পনা ও যোগাযোগ পরিকল্পনার যথাযথ সমন্বয়ের মাধ্যমে ঢাকাকে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা শৃঙ্খলার মধ্যে আনা সম্ভব। তিনি আরো বলেন, পদ্মা সেতু চালু হয়ে গেলে ঢাকা থেকে মাওয়া পর্যন্ত এলাকার ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা এখনই চূড়ান্ত করে ফেলা দরকার। না হয় এই সেতুকে কেন্দ্র করে ঢাকামুখী অভিগমনের চাপ সামাল দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সড়ক অবকাঠামো নির্মাণ ও পরিবহন পরিকল্পনা না করা গেলে ভবিষ্যতে ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থায় আরো চাপ পড়ে যাবে, যা সামাল দেয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। পাশাপাশি এই পরিকল্পনাবিদ যত্রতত্র বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণের কারণে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে মন্তব্য করে পরিকল্পনামাফিক বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের উপর গুরুত্বারোপ করেন।
ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) এর পরিচালক ও শেলটেক কনসালটেন্টস লিমিটেড এর প্রধান কার্যনির্বাহী কর্মকর্তা পরিকল্পনাবিদ মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম বলেন, সরকারি-বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিকল্পনা ও নীতি বিষয়ক পরামর্শ প্রদান ও গণসচেতনতা তৈরির জন্য আন্তরিকভাবে সামনের দিনগুলোতে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) কাজ করে যাবে। ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা কার্যকর করতে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় প্রস্তাবিত বিদ্যালয়ভিত্তিক জোনিং ব্যবস্থা কার্যকর করবার পাশাপাশি অধিক ব্যয়নির্ভর প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিবর্তে সাশ্রয়ী গণপরিবহন ব্যবস্থা কার্যকর করবার পরামর্শ দেন।
পরিকল্পনাবিদ ড. চৌধুরী মো. জাবের সাদেক, বাংলাদেশ পুলিশ এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (উন্নয়ন) এবং পরিচালক, ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) বলেন, ট্রাফিক মোড়গুলোতে ডিজাইন ও পরিকল্পনাগত সমাধান করা প্রয়োজন। ঢাকা শহরে গাড়ির অনিয়ন্ত্রিত পার্কিং নগর বিশৃংখলার জন্য দায়ী। এক্ষেত্রে পার্কিং ব্যবস্থাপনাকে কার্যকর নীতিমালা ও ব্যবস্থাপনার মধ্যে নিয়ে আসা জরুরি।
ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) এর উপদেষ্টা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ বলেন, ঢাকার ট্রাফিক ও পরিবহন পরিকল্পনায় যতগুলো সম্ভাব্য প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বিবেচনা করা হচ্ছে, সেগুলো যদি সফলভাবে বাস্তবায়ন করা হয়, তাহলেও ঢাকার যানজট নিরসন করা যাবে না। যদি না সারা দেশের আঞ্চলিক উন্নয়নের বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে ঢাকামুখী জনস্রোত না কমানো যায়। ঢাকাতে যেকোনো বড় অবকাঠামো নির্মাণের সম্ভাবনা ব্যয়সমূহের নির্মোহ বিশ্লেষণ করেই ঢাকার ট্রাফিক সমস্যা নিরসনে প্রকল্প প্রণয়ন ও অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে।
ডব্লিউবিবি ট্রাস্ট এর সিনিয়র প্রকল্প ব্যবস্থাপক জিয়াউর রহমান বলেন, ঢাকা শহরে বিগত বছরগুলোতে ব্যক্তিগত গাড়ি ও মোটরসাইকেলের তুলনায় পাবলিক বাস তুলনামূলকভাবে অনেক কম সংখ্যক নগরের রাস্তায় যুক্ত হয়েছে, ফলে যানজট অনিয়ন্ত্রিতভাবে বেড়েছে। ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি যে কেবল যানজট এর কারণ তা নয়, বরং তা পরিবেশকেও মারাত্মকভাবে দূষিত করে । ঢাকা নগর পরিবহনে আরো বাস বাড়ানোর মাধ্যমে এই সার্ভিসকে টেকসই ও ঢাকার ট্রাফিক নিরসনে সাশ্রয়ী ও কার্যকর পরিবহন হতে পারে।
সেভ দ্য চিলড্রেন এর ওবায়দুল ইসলাম বলেন, বিগত বছরগুলোতে ট্রাফিক সমস্যা নিরসনে গৃহীত অধিকাংশ প্রকল্প কতিপয় গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করলে নগরের যানজট নিরসনে কার্যকর সমাধান দিতে ব্যর্থ হয়েছে। তার মূল কারণ সামগ্রিক জনস্বার্থ সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও প্রকল্প বাস্তবায়নে উপেক্ষিত হয়েছে। সড়ক সংক্রান্ত অবকাঠামো নির্মাণে ধূলা দূষণ, পরিবেশ দূষণের মাধ্যমে সামগ্রিকভাবে জনস্বাস্থ্যের যে ক্ষতি হচ্ছে, তা বিবেচনায় নিয়েই প্রকল্প সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত প্রণয়ন করা উচিত।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) এর যুগ্ম সম্পাদক ও পরিবহন পরিকল্পনা বিশেষজ্ঞ রাসেল কবির বলেন, আমাদের সড়ক সংক্রান্ত পরিকল্পনা ও প্রকল্পসমূহ বিদেশি প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে প্রণয়ন করা হয়, অথচ আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক-পরিকল্পনাগত বাস্তবতায় এ ধরনের অনেক উদ্যোগ স্বভাবতই পরবর্তীতে ব্যর্থ বলে প্রতীয়মান হয়। সড়ক কর্তৃপক্ষের প্রস্তাবিত সাবওয়ে পরিকল্পনার সাথে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের শহর নিয়ে ভবিষ্যত পরিকল্পনার রূপরেখার কার্যকর সমন্বয় অনুপস্থিত বলে মন্তব্য করেন এই পরিকল্পনাবিদ।
বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) প্রকল্প এর পরামর্শক পরিকল্পনাবিদ আবু মুসা বলেন, সারা বাংলাদেশে অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলবার বিদ্যমান উদ্যোগকে সফলভাবে পরিচালিত করা গেলে ঢাকার উপর চাপ কমানো সম্ভব। পাশাপাশি ঢাকাকে ঘিরে রিং রোড ও রেডিয়াল রোডসমূহের প্রস্তাবনাসমূহ বাস্তবায়নের মাধ্যমে ঢাকার ট্রাফিক সমস্যার সমাধান কিছুটা সম্ভবপর হতে পারে।
নাগরিক সংলাপে ঢাকার ট্রাফিক সমস্যার টেকসই সমাধানের জন্য ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) বেশ কিছু প্রস্তাবনা তুলে ধরেন। যার মধ্যে রয়েছে নগরের বাস সার্ভিস এর তাৎপর্যপূর্ণ উন্নয়ন নিশ্চিত করা। বিদ্যমান বাস রুট রেশনালাইজেশন এর উদ্যোগকে অতি দ্রুত প্রস্তাবিত শহরের সকল রুটে সম্প্রসারিত করা। রুট পারমিটবিহীন বাস সার্ভিসসমূহকে চিহ্নিত করে নগরের সমগ্র বাস সার্ভিসকে শৃংখলার মধ্যে নিয়ে আসা। গণপরিবহন সার্ভিসসমূহ যেমন- মেট্রো রেল, নগর পরিবহন বাস সার্ভিস প্রভৃতি পরিবহনসমূহের সাথে অন্যান্য পরিবহন মাধ্যম এর সমন্বিত নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা। কমিউনিটিভিত্তিক মানসম্মত প্যারাট্রানজিট পরিকল্পনা তৈরি করা ও কমিউনিটি মবিলিটি প্ল্যান প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা। পথচারীদের অগ্রাধিকার দিয়ে পরিবহন পরিকল্পনা করা ও সড়কগুলোর ডিজাইন তৈরি করা। সড়কের প্রশস্ততা বাড়ানো কিংবা অন্য কোন অবকাঠোমো উন্নয়ন এর কারণ দেখিয়ে কোনভাবেই ফুটপাথ কমানো কিংবা অকার্যকর না করা। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার চাহিদা ভিত্তিক নগর পরিবহন চালু করা ও পরিধি বাড়ানো, যেমন- ছাত্র-ছাত্রীদের বাস সার্ভিস, মহিলাদের বাস সার্ভিস, প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ বাস সার্ভিস, শিল্প শ্রমিক বাস সার্ভিস প্রভৃতি।
গণ পরিবহনের পর্যাপ্ত উন্নয়ন সাধনের মাধ্যমে নগরে রাইড শেয়ারিং সার্ভিস এর উপর নির্ভরতা কমিয়ে আনা। অযান্ত্রিক বাহন পরিকল্পনা প্রণয়ন এর মাধ্যমে রিকশা ও অন্যান্য অযান্ত্রিক বাহনসমূহকে শৃংখলার মধ্যে নিয়ে আসা। বাসস্টপগুলো সুনির্ধারিত করার মাধ্যমে যত্রতত্র যাত্রী-উঠানো নামানো বন্ধের মাধ্যমে রুটসমূহের কার্যকারিতা বাড়ানো। সেবা সংস্থাগুলোর উন্নয়ন ও সংস্কার কাজ এর যথাযথ সমন্বয় এর মাধ্যমে বিদ্যমান রাস্তাগুলোর সর্বোচ্চ কার্যকারিতা নিশ্চিত করা। পার্কিং ব্যবস্থাকে শৃংখলার মাধ্যমে আনার মাধ্যমে অবৈধ পার্কিং বন্ধ করা ও যত্রতত্র পার্কিং কিংবা রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবার বিষয়ে যথাযথ আইন প্রয়োগ করা। হকার ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা প্রণয়ন এর মাধ্যমে রাস্তা ও ফুটপাথসমূহের কার্যকর সক্ষমতা বাড়ানো। বিভিন্ন অফিস ও সংস্থাসমূহ কর্তৃক ব্যক্তিগত গাড়িক্রয়ের প্রণোদনা দেবার বিদ্যমান সংস্কৃতি বন্ধ করে বিভিন্ন রুটে অফিস বাস চালু করবার উদ্যোগ করার জন্য নীতি কাঠামো তৈরি করা।
ঢাকার আশপাশের অঞ্চলসমূহের সাথে দ্রুত যোগাযোগ বৃদ্ধি করার উদ্দ্যেশ্যে কমিউটার ট্রেন বাড়ানো এবং বৈশ্বিকভাবে কার্যকর লাইট রেল ট্রানজিট (এলআরটি) তৈরীর উদ্যোগ গ্রহণ। পরিবহন ব্যবস্থার মানোন্নয়নে উচ্চাভিলাষী প্রকল্পের দিকে না ঝুঁকে আমাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা ও সংগতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে পরিকল্পনা, প্রকল্প ও উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা। বহুতল ভবন নির্মাণ ও বিভিন্ন প্রকল্প প্রণয়ন এর পূর্বে নির্মোহ ট্রাফিক ইম্প্যাক্ট এসেসমেন্ট (পরিবহনগত প্রভাব বিশ্লেষণ) নিশ্চিত করা। এজন্য প্রয়োজনীয় আইন ও নীতি কাঠামো প্রণয়ন করা। পরিকল্পনা প্রণয়ন এর সময় এলাকাভিত্তিক জনসংখ্যা নির্ধারণ এর পাশাপাশি এলাকাভিত্তিক ট্রাভেল ডিমান্ড এর প্রক্ষেপণ এর মাধ্যমে এলাকাভিত্তিক যানবাহন ধারণ ক্ষমতা নির্ণয় এর মাধ্যমে পরিবহন পরিকল্পনা প্রণয়ন । পরিবহন পরিকল্পনা এবং ভূমি-ব্যবহার ও ভৌত পরিকল্পনার মধ্যে কার্যকর সমন্বয় সাধন এর উদ্যোগ গ্রহণ। বিষয়গুলোকে সুনির্দিষ্ট একটি সংস্থার অধীনে নিয়ে আসার জন্য সরকারি প্রচেষ্টা জরুরি। বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার প্রস্তাবনা অনুযায়ী, স্কুল জোনিং, কমিউনিটি কার পার্কিং, প্রস্তাবিত অযান্ত্রিক পরিবহন নেটওয়ার্ক, অগ্রাধিকারমূলক বাইসাইকেল লেন প্রস্তাবনাসমূহের আশু বাস্তবায়নের জন্য কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা। বহুমাধ্যমভিত্তিক সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলবার জন্য সড়কপথ, রেলপথ ও জলপথ এর কার্যকর সমন্বয় তৈরি করা।
এসটিপির প্রস্তাবনা অনুযায়ী নগরের সকল রেল ক্রসিং সমূহকে গ্রেড সেপারেটেড ব্যবস্থায় নিয়ে যাওয়া। সড়ক ব্যবস্থাপনা ও ট্রাভেল ডিমাণ্ড ম্যানেজমেন্ট (পরিবহন চাহিদা ব্যবস্থাপনা)’কে প্রাধিকার দিয়ে পরিবহন ব্যবস্থা সাজানো। জনঘনত্ব পরিকল্পনা ও ঢাকার পরিকল্পনা ও উন্নয়ন ব্যবস্থাপনার সঠিক পরিকল্পনাগত কৌশল নির্ধারণের মাধ্যমে ঢাকার জনসংখ্যাকে আর বাড়তে না দিয়েপরিবহন ব্যবস্থার উপর চাপ কমানো। ট্রাফিক সিগন্যালিং ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার মানোন্নয়ন নিশ্চিত করা। ট্রানজিট ওরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্ট পরিকল্পনা প্রণয়ন এর সময় আমাদের আর্থ-সামাজিক-পরিকল্পনাগত প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে পরিকল্পনা প্রণয়ন।
ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) মনে করে পরিবহন আইন, মহাপরিকল্পনা ও ভূমি ব্যবহার প্রস্তাবনাসমূহের ক্ষেত্রে আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও আইনের শাসন নিশ্চিত করবার পাশাপাশি পরিবহন পরিকল্পনা ও নগর পরিকল্পনা সংশ্লিষ্ট সকল সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানসমূহের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা এবং দেশের উন্নয়নের বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে ঢাকার ওপর চাপ কমানোর মাধ্যমে ঢাকার ট্রাফিক সমস্যার কার্যকর ও টেকসই সমাধান করা সম্ভব। এক্ষেত্রে স্বল্পমেয়াদি ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাগত উদ্যোগের পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনাগত সমাধানের কার্যকর বাস্তবায়নে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।