বাংলাদেশে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবনায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ডিজিটাল মুদ্রা চালুর বিষয়টি পরীক্ষা করার প্রস্তাব দিয়ে বলেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে এই মুদ্রা চালুর জন্য এর সম্ভাব্যতা যাচাই করবে সরকার। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডিজিটাল মুদ্রা চালুর মূল উদ্দেশ্য হলো ভার্চুয়াল লেনদেনের অর্থ আদান-প্রদান সহজ করা এবং স্টার্ট-আপ ও ই-কমার্স ব্যবসাকে উৎসাহ দেওয়া। এসব কারণেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডিজিটাল মুদ্রা চালু নিয়ে একটি ফিজিবিলিটি স্টাডি করা হবে বলে বাজেট ভাষণে জানিয়েছেন তিনি।
ডিজিটাল মুদ্রা আসলে কী : বিশ্বে ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ক্রিপ্টোকারেন্সি বা ভার্চুয়াল মুদ্রা। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বিটকয়েন, লাইটকয়েন, এথেরিয়াম, রিপলের মতো ভার্চুয়াল মুদ্রার লেনদেন হচ্ছে। যদিও বাংলাদেশে এগুলো বৈধ নয়। ডিজিটাল এসব মুদ্রা লেনদেন হয় ভার্চুয়ালি অর্থাৎ টাকা বা কাগজের নোটের মতো এগুলো দৃশ্যমান নয়। তবে এখন যেসব ক্রিপ্টোকারেন্সি আছে সেগুলোর কার্যত কোনো কর্তৃপক্ষ নেই এবং যেকোনো জায়গা থেকে যেকোনো ব্যক্তি যেকোনো সময় এর লেনদেন করতে পারেন। অর্থাৎ পুরো বিষয়টি হয় যেকোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। যদিও কোনো কোনো দেশ এখন খতিয়ে দেখছে যে, ক্রিপ্টোকারেন্সিকে কীভাবে একটি মনিটরিংয়ের আওতায় আনা যায়। ২০০৯ সালে প্রথম ডিজিটাল মুদ্রা হিসেবে এসেছিল বিটকয়েন এবং এক পর্যায়ে এই বিটকয়েনের দাম ৬০ হাজার ডলারও ছাড়িয়েছিল। কিন্তু এর লেনদেন, বিনিময় হার এবং আইনগত ভিত্তি না থাকায় বড় বড় প্রতারণার ঘটনাও ঘটছে এসব মুদ্রা নিয়ে।
এ কারণেই এখন আলোচনায় এসেছে যে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে ডিজিটাল মুদ্রা ইস্যু করা যায় কি না।
ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস বিশেষজ্ঞ তহুরুল হাসান বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে কাগজের নোট বা মুদ্রা সরবরাহ করে তা ভল্টে বা মার্কেটে মানুষের পকেটে থাকে এবং সেটি দেখা যায়। কিন্তু ডিজিটাল মুদ্রা এমন দৃশ্যমান হবে না। অনেকটা বিকাশ বা নগদে যেমন ডিজিটাল ওয়ালেটে টাকা থাকে ডিজিটাল মুদ্রাও তেমনি থাকবে। তবে নগদে বা বিকাশে যেমন ক্যাশ টাকাটা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বা এজেন্টকে দিয়ে আনাতে হয়- এখানে তা হবে না। এখানে শুরু থেকেই সব ডিজিটাল হবে।
অর্থাৎ হয়তো কেন্দ্রীয় ব্যাংক ১০০ টাকা ইস্যু করবে। এর মধ্যে ৭০ টাকা কাগজের নোট আর বাকি ৩০ টাকা ডিজিটাল। এখন কেউ যেমন কাগজের নোট সংগ্রহ করে পকেটে রাখতে পারবে তেমনি ওই ৩০ টাকা থেকে ডিজিটাল মুদ্রা নিয়ে তার অ্যাকাউন্ট বা ডিজিটাল ওয়ালেটে রাখতে পারবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিভাগের শিক্ষক ড. সুবর্ণ বড়ুয়া বলেন, ক্রিপ্টোকারেন্সির বাজার আপ-ডাউন করে কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডিজিটাল মুদ্রা ইস্যু করলে সেটি টাকার মতোই ব্যবহার হবে। তিনি বলেন, কাগজের নোটের মতো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডিজিটাল মুদ্রার একটি অ্যাসেট ব্যাকআপ থাকবে। অর্থাৎ বাজারে আসা টাকার বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যেমন রিজার্ভ বা সোনা থাকে তেমনটি হবে ডিজিটাল মুদ্রার ক্ষেত্রেও।
লেনদেন কীভাবে করা যাবে : ডিজিটাল মুদ্রা কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইস্যু করলেও এর জন্য একটি ইকো সিস্টেম দরকার হবে বলে মনে করেন তহুরুল হাসান। অর্থাৎ টাকার মতোই সব কাজে সব জায়গায় এই ডিজিটাল মুদ্রা দিয়ে পণ্য বা সেবা ক্রয় বিক্রয়ের সুযোগ থাকতে হবে। প্রত্যন্ত এলাকার একজন মুদি দোকানিকেও সেটি গ্রহণের জন্য প্রস্তুত করতে হবে। অর্থাৎ এটা হবে কাগজের নোটের মতো সার্বজনীন। শুধু ব্যবহারটা হবে ডিজিটাল পদ্ধতিতে। সুবর্ণ বড়ুয়া অবশ্য বলেন, বাংলাদেশে বিকাশকে গ্রহণ করাতেই ১০ বছর লেগেছে। তাই ডিজিটাল মুদ্রার ক্ষেত্রে দরকার হলে আরো সময় নিতে হবে।
কাগজের নোট কি থাকবে না : এখন মুদ্রা আছে তিন ফরম্যাটে- কাগজের মুদ্রা, ই-মানি (মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস), ক্রিপ্টোকারেন্সি (বিটকয়েনের মতো ভার্চুয়াল মুদ্রা)। এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো নিজেদের মুদ্রা ডিজিটাল ফরম্যাটে আনলে সেটি হবে বৈধ ডিজিটাল মুদ্রা।
যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডিজিটাল মুদ্রা কখনো চালু হলে তার আগে অনেক প্রশ্নের জবাব খুঁজতে হবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে। কিন্তু সেই ডিজিটাল মুদ্রা এলে কাগজের মুদ্রা থাকবে না- এমনটি কেউই মনে করছেন না। সুবর্ণা বড়ুয়া বলেন, দেশের সব মানুষের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই এবং যাদের নেই তারা কীভাবে ডিজিটাল মুদ্রা পাবেন? কাগজের মুদ্রা বিদায় হবে বলে মনে হয় না। বরং দুটিই সমান্তরালভাবে চলতে হতে পারে। যাতে করে মানুষ ডিজিটাল মুদ্রা নগদে রূপান্তর করতে পারে সেই সুযোগও থাকতে হবে। তহুরুল হাসানও জানান, কাগজের মুদ্রা সহজে বিদায় হবে না। বরং ডিজিটাল মুদ্রা করার আগে বাজার ও মানুষকে ব্যাপকভাবে প্রস্তুত করতে হবে, যা খুবই সময়সাপেক্ষ হতে পারে।
ঝুঁকি কোথায় : সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো ডিজিটাল মুদ্রা হ্যাক হলে মানুষ কী সেই অর্থ আর ফেরত পাবে কিংবা ডিজিটাল ওয়ালেট থেকে টাকা চুরি হলে তার নিয়ন্ত্রণ কীভাবে হবে? বাংলাদেশে করোনাকালে সরকার উপবৃত্তির যে টাকা মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে দিয়েছে সেই টাকা অনেক শিক্ষার্থীর অগোচরে অন্যরা তুলে নিয়েছে বলে অভিযোগ আছে। সাইবার অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তানভীর হাসান জোহা বলেন, ডিজিটাল মুদ্রার ক্ষেত্রেও বড় চ্যালেঞ্জ হবে সাইবার নিরাপত্তার বিষয়টি।
ডিজিটাল মুদ্রার ব্যবহারের জন্য মানুষ ইন্টারনেটে যুক্ত হবে ও পাবলিক নেটওয়ার্কে থাকবে। কিন্তু সেখানে সাইবার নিরাপত্তা কতভাবে লঙ্ঘিত হতে পারে সেটি আগে যাচাই করে দেখতে হবে। অন্যদিকে ড. সুবর্ণ বড়ুয়া বলেন, ডিজিটাল ওয়ালেট বা লেনদেনের বিষয়টি প্রযুক্তিগতভাবে দেখভাল করাটাও চ্যালেঞ্জের বিষয় হবে এবং সবাইকে নিজের ওয়ালেট ব্যবহার সম্পর্কে জানতে হবে। এগুলো নিয়ে সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন থাকতে হবে। প্রসঙ্গত, বিকাশ বা নগদের পাসওয়ার্ড বা পিন গোপন না রাখার কারণেও অনেকে অ্যাকাউন্ট হ্যাক হয়ে টাকা উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
কোনো দেশে কি ডিজিটাল মুদ্রা চালু হয়েছে : ডিজিটাল কারেন্সি নিয়ে সম্প্রতি এক ওয়েবিনার উপস্থাপনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেম ডিপার্টমেন্টের অতিরিক্ত পরিচালক শাহ মোহাম্মদ জিয়াউল হক জানিয়েছেন যে ক্যারিবিয়ান দ্বীপ বাহামা ও নাইজেরিয়া ডিজিটাল মুদ্রা চালু করেছে। অন্যদিকে চীন পাইলট প্রজেক্ট শেষ করে সব প্রস্তুত করলেও এখনো ডিজিটাল মুদ্রা ইস্যু করেনি। আবার যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের মতো কিছু দেশ ক্রিপ্টোকারেন্সিকে মুদ্রা হিসেবে স্বীকৃতি না দিলেও অ্যাসেট হিসেবে মর্যাদা দিয়েছে। তবে বাংলাদেশে কারেন্সি ও অ্যাসেট- কোনোভাবেই এটি বৈধ নয়।
তবে ঘানা ও জ্যামাইকা শিগগিরই ডিজিটাল মুদ্রা চালু করতে যাচ্ছে। সুইডেন পাইলট সম্পন্ন করেছে কিন্তু চালু করেনি। ক্যানাডা পাইলট করে এখনই চালু না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং তারা নতুন করে এ নিয়ে গবেষণা করবে বলে জানিয়েছে।
ডিজিটাল মুদ্রায় কী লাভ হবে : শাহ মোহাম্মদ জিয়াউল হকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে টাকা ছাপানো ও নিয়মানুযায়ী নষ্ট বা ব্যবহার অযোগ্য টাকা ধ্বংস করতে গত বছরেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ হয়েছে। টাকা ছাপানোর পর বিতরণেও হয়ে থাকে বিপুল খরচ। ডিজিটাল মুদ্রা চালু হলে এসব খরচ বেঁচে যাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর। এ ছাড়া সব ধরনের পেমেন্ট এবং যেকোনো লেনদেন ডিজিটাল পদ্ধতিতে সম্পন্ন করা যাবে বলে সাধারণ মানুষেরও লেনদেনজনিত ব্যয় কমবে।