শরিফুল হাসান, অভিভাষণ বিশ্লেষক :
এ যেন নাটক-সিনেমার কোন দৃশ্য! দীর্ঘ ২৫ বছর পর বাবার সঙ্গে সন্তানদের দেখা। সন্তানের সঙ্গে বাবার। ওপরওয়ালার কাছে কৃতজ্ঞতা। কৃতজ্ঞতা গণমাধ্যমসহ আপনাদের সবার প্রতি। কৃতজ্ঞতা ব্র্যাকে আমাদের সব সহকর্মীকে। দেশে ফেরার পর যে মানুষটি পরিবারই খুঁজে পাচ্ছিলেন না অবশেষে চট্টগ্রামের হালিশহর এলাকা থেকে আমরা তাঁর পরিবারের সন্ধান পেয়েছি। আজ বিকেলে আবুল কাশেম নামের ওই বৃদ্ধকে তাঁর পুত্র ও কণ্যাসহ পরিবারের সদস্যদের কাছে আমরা হস্তান্তর করতে পেরেছি।
আপনারা যারা আমার আগের স্ট্যাটাস দেখেছেন তারা জানেন, গত শুক্রবার দিবাগত রাতে সৌদি আরব থেকে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমেছিলেন এই বৃদ্ধ। কিন্তু তিনি নিজের ঠিকানা বলতে পারছিলেন না। তাঁর কাছে পাসপোর্টও ছিলো না। অনেক কিছু ভুলে গিয়েছেন। ইমিগ্রেশন পুলিশের তথ্য অনুযায়ী এই বৃদ্ধ সম্ভবত শুক্রবার দিবাগত রাতে জেদ্দা থেকে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমেছেন। তাঁর কাছে কোন পাসপোর্ট ছিল না। তিনি ট্রাভেল পাস নিয়ে এসেছেন।
বিমাবন্দরের এপিবিএনর সহকারী পুলিশ সুপার আবদুল হান্নান রনি আমাদের ব্র্যাকের মাইগ্রেশন ওয়েলফেয়ার সেন্টারের ম্যনেজার আল আমিন নয়ন ভাইকে ফোন দিয়ে ঘটনা জানান। আমাদের সহকর্মী শাকিল বিমানবন্দরে গিয়ে বিমানবন্দরের উল্টো দিকে ব্র্যাকের মাইগ্রেশন ওয়েলফেয়ার সেন্টারে নিয়ে আসেন। শনিবার থেকে তিনি সেখানেই ছিলেন।
আমাদের সেন্টারে আসার পর আমাদের সাইকোসোসাল কাউন্সিলর মাহমুদা ও মাশকুরা দীর্ঘক্ষণ তাঁর সঙ্গে কথা বলেন। আমাদের কাউন্সিলিরা জানান, শারিরীকভাবে সুস্থ মনে হলেও তিনি ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রংশ রোগে আক্রান্ত। এ কারণেই তিনি সঠিকভাবে তাঁর ঠিকানা বলতে পারছিলেন না। তবে তিনি জানাচ্ছিলেন তাঁর নাম আবুল কাশেম। আমাদের ব্র্যাকের মাইগ্রেশন ওয়েলফেয়ার সেন্টারের ম্যনেজার আল আমিন নয়ন, কেস ম্যানেজার রায়হান, ঢাকা সেন্টারের ম্যানেজার অনোয়ার ভাই, নয়ন ভাই, আখি আপা, নজরুল ভাই, নীলা আপাসহ সবাই লোকটার যত্ন নিতে থাকেন।
শুনলে অবাক হবেন তাকে যখন পাই তিনি শারীরিকভাবেও অসুস্থ। কয়েকবার তিনি মলমূত্র ত্যাগ করে ভাসিয়েছেন। আমাদের সহকর্মীরা নিজের বাবার মতো করে খেয়াল রেখেছেন। এর আগেও এই ধরনের ঘটনা আমারও আগেও পেয়েছি। প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক, এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ, সিভিল এভিয়েশনসহ সবার সহযোগিতায় আমরা অতীতেও এ ধরনের কাজ করেছি। তবে এবার কোনভাবে আগাবো ঠিক নিশ্চিত ছিলাম না। বুঝতে পারছিলাম না কীভাবে লোকটাকে তাঁর পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেব।
আমি চট্টগ্রামে বড় হয়েছি এবং চট্টগ্রামের ভাষা নিজে গিয়ে যখন লোকটার সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বললাম। চট্টগ্রামের ভাষা শুনে কাশেম চাচা আমাকে বোধহয় তাঁর আত্মীয় ভেবেছিলেন। তাই তিনি অনেক কথা বলতে থাকলেন। তিনি জানালেন তাঁর বাবার নাম নাম ফজেল আহমেদ। মা সাবানা। স্ত্রীর নাম বলছেন আমেনা।
তবে নিজের ঠিকানা তিনি কখনো বলছেন চট্টগ্রামের নয়াবাজার। কখনো রাউজানের পাহাড়তলী ইউনিয়নের গরিশংকরহাটের কথাও বলছেন। আবার বলছেন, চট্টগ্রামের নতুন বাজার হালিশহরের কাছে, ঈদগাহের মাঠ বউ বাজার এলাকায় তাঁর ছেলের তরকারির দোকান আছে। আমরা তাঁর বাড়ি কোথায় নিশ্চিত হতে না পারলেও ভাষা শুনে এটুকু বুঝতে পেরেছিলাম তার বাড়ি চট্টগ্রাম অঞ্চলে।
আবুল কাশেম দাবি করছিলেন, তাঁর ৬ মেয়ে ও ৩ ছেলে রয়েছে। তাঁর তিন ছেলের নাম মান্নান, নূর হাসান, এনামুল হাসান। এর মধ্যে নূর হাসানের তরকারির দোকান আছে। ছোট ছেলে এনামুল হাসান দুবাই থাকেন। মান্নান সৌদি থাকেন বলে দাবি তাঁর। ৮-১০ জন নাতি নাতনি আছেন। কিন্তু যেহেতু দীর্ঘ ২৫ বছর দেশে নেই সঠিকভাবে সব বলতে পারছিলেন না। সৌদি আরবের বাংলাদেশ দূতাবাসের সঙ্গে আমি কথা বলেছি। কথা বলেছি পুলিশের বিশেষ শাখায়। কিন্তু তাঁর কোন পরিচয়পত্র না কাগজ পাচ্ছিলাম না যেটি তাঁর ঠিকানা নিশ্চিত করে।
আমি তখন পুরো ঘটনা জানিয়ে দুদিন অগেই ফেসবুকে পোস্ট দেই। অসংখ্য মানুষ পুরো ঘটনা শেয়ার করেছেন। যেহেতু তিনি চট্টগ্রামের ভাষায় কথা বলছিলেন কাজেই আমরা চট্টগ্রামের পুলিশসহ নানা সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করি। আমরা তাঁর পরিবারের সন্ধানে গণমাধ্যম কর্মীদের সহায়তা চাই। অনেকেই তাঁর বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ করেন। এরপরও আমরা পরিবারের সন্ধান পাচ্ছিলাম না।
বিকল্প ভাবছিলাম তখন। ওই বৃদ্ধ কখনো চট্টগ্রামের হালিশহর, কখনো হাটহাজারী, নয়াবাজারসহ বেশ কিছু ঠিকানা বলছিলেন। তিনি যখন যেসব এলাকার কথা বলছিলেন আমাদের চট্টগ্রামের ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের কর্মীরা সেসব এলাকায় গিয়ে খোঁজ নিচ্ছিলেন। ওই বৃদ্ধ বলছিলেন চট্টগ্রামের নয়াবাজার এলাকায় তাঁর ছেলে তরকারি বিক্রি করে। তখন একটা বিকল্প চিন্তা শুরু করলাম সেই পুরোনো আমলের চিন্তা। আমাদের চট্টগ্রাম টীমকে বললাম পরিবারের সন্ধান চাই শিরোনামে ছবিসহ শত শত পোস্টার বানানা। চট্টগ্রামে বিলি করে বেড়ান।
আমাদের চট্টগ্রামের সহকর্মী মং, আনিকা, নানজীবাসহ সবাই এরপর চট্টগ্রাম শহরের হালিশহর, নয়াবাজার, বউবাজার, ঈদগাহ, পাহাড়তলী সহ আরো বেশ কয়েকটি স্থানে দেয়ালে দেয়ালে আমরা পোস্টার লাগান। আমরা বিশ্বাস রেখেছিলাম গণমাধ্যমকর্মীসহ সবার সহযোগিতায় আমরা তাঁর পরিবারকে খুঁজে বের করবোই। এসব পোস্টার দেয়ালে লাগানো ও বিতরণ করার পর গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে চট্টগ্রামের আমাদের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ২৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র (২৫নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর) আব্দুস সবুর লিটন ও তাঁর সহযোগী মুন্না যোগাযোগ করেন। তিনি জানান, পোস্টারের ছবির লোকটিকে তিনি চিনতে পেরেছেন।
এরপর আমাদের চট্টগ্রামের সাইকোসোসাল কাউন্সিলর নানজীবা ও আরেক সহকর্মী মং তাঁর অফিসে যান। তাঁদের সহযোগিতায় আমরা তাঁর ছেলে সবজি ব্যবসায়ী জনাব নূর হাসানের খোঁজ পাই। পরবর্তীতে কাউন্সিলর অফিসে নুর হোসেনকে আসতে বলে বুঝতে পারি জানতে পারি আবুল কাশেম তাঁর বাবা। আমরা এরপর তাঁর বাড়িতে যাই। তাঁর জাতীয় পরিচয়পত্র দেখেও আমরা বিষয়টি নিশ্চিত হই।
নুর হাসানের কাছ থেকে আমরা পরিবারের বাকি সদস্যদের সঙ্গেও কথা বলি। দুবাইতে থাকা তাঁর এক ছেলের সঙ্গেও কথা বলি। এরপর বৃদ্ধ আবুল কাশেমের ছোট মেয়ে রুমা বেগম ও তার স্ত্রী আমেনা বেগমের সাথে ঢাকা থেকে ভিডিও কলে কথা বলিয়ে দেই। এ সময় যে আবেগঘণ পরিবেশের সৃষ্টি হয় সেটি ভাষায় বলা কঠিন। এরপরই আমাদের লোকজনের সঙ্গে পরিবারের সদস্যরা তাকে নিতে ঢাকায় রওয়ানা হন। আজকে সকালে তাঁরা ঢাকায় এসে পৌঁছান।
আজকে উত্তরায় ব্র্যাক মাইগ্রেশন ওয়েলফেয়ার সেন্টারে যখন বাবার সঙ্গে ছেলে-মেয়েদের দেখা হলো যেন স্বর্গ দেখলাম নিজ চোখে।আবুল কাশেমের বড় ছেলে নূর হাসান বাবাকে ফিরে পেয়ে কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, ব্র্যাকসহ আপনাদের সবার কাছে কৃতজ্ঞতা। অনেকদিন ধরে বাবার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ছিল না। আমরা জানতাম না তিনি সৌদি আরবের কোথায় আছেন। তিনি যে দেশে এসেছেন সেটাও আমরা জানতাম না। পোস্টার দেখে ও স্থানীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে ব্র্যাকের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হেয়। আমরা তার পরিবারের সদস্য হয়েও যা করতে পারিনি ব্র্যাক আমার বাবার জন্য তার চেয়ে বেশি কিছু করেছে।
দীর্ঘদিন পর পরিবারকে পেয়ে আবুল কাশেম তাঁর সন্তানদের বারবার জড়িয়ে ধরছিলেন। তাঁকে নিতে আসা কন্যা পারভীন আক্তার বলেন, আমার বাবা যখন ২৫ বছর আগে সৌদি আরবে যায় অমার ছোট বোন রূমা তখন মায়ের পেটে। বাবার সঙ্গে আমাদের স্মৃতি খুব কম। আমরা এখন বাবাকে ফেরত পেলাম। আমাদের অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন।
পরিবারকে হস্তানের সময় এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জিয়াউল হক, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থাপক স্কোয়াড্রন লিডার মোঃ রাসেল তালুকদার, সহকারী পুলিশ সুপার আব্দুল হান্নান রনি এবং হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের সহকারী পরিচালক মোঃ ফখরুল আলম উপস্থিত ছিলেন। আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ। আমরা যা করছি আপনাদের সবার সহযোগিতায় করতে পেরেছি।
আমি এই সুযোগে আমাদের ব্র্যাকের সব সহকর্মীকে ধন্যবাদ জানাই। ধন্যবাদ গণমাধ্যমকে। ধন্যবাদ আপনাদের সবাইকে। ১৭ কোটি মানুষের এই দেশে ঠিকানাহীন একজন মানুষকে তাঁর পরিবারের কাছে পৌঁছানোর কাজটি কতো কঠিন সেটা আমরা যারা এমন কাজ করি তারাই বুঝতে পারি। কিন্তু আপনাদের সবার সহযোগিতায় অসম্ভব সেই কাজটাও আমরা করতে পেরেছি।