শহিদুল ইসলাম জি এম মিঠন, সিনিয়র রিপোর্টার :
“আদিবাসী সমাজে নারী-পুরুষের মধ্যে কোন ভেদাভেদ নেই, তারা নিজেরাই সমান মর্যাদা ও অধিকার ভোগ করেন” এমন কথা প্রায়ই শোনা যায়। আদিবাসী সমাজ ব্যবস্থাকে সম-অধিকারের সমাজ ব্যবস্থা হিসেবেও চালিয়ে দেওয়ার চেষ্ঠা করা হয়। আদিবাসীরা যেন সমাজে এক ছোটজাতের জনগোষ্ঠির মানুষ। সেই ধারণাকে বদলে দিতে প্রতিনিয়তই নিজের গোষ্ঠির মানুষদের সম-অধিকার নিশ্চিত করতে ও সমাজের মূলধারায় যুক্ত করার প্রত্যয় নিয়ে কাজ করার মাধ্যমে এগিয়ে যাচ্ছেন আদিবাসী নেত্রী শ্রীমতি জগবতি রানী টপ্পো।
নওগাঁ জেলার বদলগাছী উপজেলার ২নং মথুরাপুর ইউনিয়ন এর লক্ষীকুল গ্রামের মৃত জয়নাত সরদার টপ্পো ও তরুবালা রানী টিপ্পোর মেয়ে আদিবাসী গোষ্ঠির সংগ্রামী নারী হচ্ছেন শ্রীমতি জগবতি রানী টপ্পো। সাত বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে জগবতী রানী টপ্পো ৪র্থ। অভারের সংসারে বেড়ে ওঠা জগবতি গরীব বাবার ঘরে খেয়ে না খেয়ে জীবন জাপন করেছেন।
সে সময় গ্রামে-গঞ্জে নারী শিক্ষার হার ছিল খুবই কম। তিনি ১৯৯৯ ইং সালে এসএসসি পাশ করেন। দারিদ্রতার কারনে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। ২০০০সালে একই গ্রামের শ্রী জতীন্দ্রনাথ তির্কীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হোন। স্বামীর অনুপ্রেরনায় সমাজসেবা মূলক বিভিন্ন কার্যক্রমের সাথে যুক্ত হন তিনি।
জগবতি রানী টপ্পো বলেন, বিয়ের পর স্বামীর অনু প্রেরনায় তিনি ২০০৫ সালে বিএ পাশ করেন। পাশাপাশি সমাজসেবা মূলক কাজে নিজেকে নিয়োজিত করে স্বপ্ন দেখেন ইউনিয়ন পরিষদের “মহিলা মেম্বার” হওয়ার। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে শত বাধা আর বিপত্তিকে উপেক্ষা করে তিনি ২০১১ সালে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সংরক্ষিত সদস্য পদে নির্বাচনে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করে বিজয়ী হতে পারেন না। পরে ২০১৬ সালের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আবারো সংরক্ষিত সদস্য পদে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করেন তিনি কিন্ত আবারো শত ষড়যন্ত্রের কাছে তাকে হার মানতে হয়।
এরপর ২০১৯ সালে জগবতি রানী টপ্পো অপরাজিতা নামক এক প্রকল্পের সাথে যুক্ত হোন। সেখান থেকে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহন করে তার জ্ঞান ও দক্ষতার প্রসার ঘটান। তিনি জনগনের মাঝে সম্পৃক্ততা বাড়াতে সমাজ সেবা মূলক কাজের সাথে লেগেই থাকতেন সব সময়। বাল্য বিবাহ বন্ধ, নারী নির্যাতন প্রতিরোধ, চিকিৎসার জন্য আদিবাসী নারী-শিশুকে উপজেলা থেকে বিভিন্ন সুবিধা নিয়ে দেয়া, আদিবাসী প্রতিবন্ধী শিশুদের ভাতায় নিবন্ধিত করতে সাহায্য করাসহ নানা ধরণের সমাজ সেবামূলক কাজে নিজেকে সব সময় নিযুক্ত রাখেন তিনি। এই সব কাজের মাধ্যমে তিনি নিজের গোষ্ঠিসহ এলাকার সকল মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।
পুনরায় তিনি ইউনিয়ন পরিষদের মহিলা মেম্বার হওয়ার সপ্ন নিয়ে নতুন উদ্যোমে ২০২১ সালের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সংরক্ষিত আসনের সদস্য পদে “তালগাছ” প্রতিক নিয়ে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করেন। নির্বাচনের আগে তাকে বিভিন্ন ভাবে হেনস্থার শিকার করা হয়, পোষ্টার ছিড়ে ফেলা, প্রচার মাইক ভেঙ্গে ফেলা, ভোটের দিন কেন্দ্রে সমর্থকদের মারপিট করা, জোর করে ভোট দেওয়া ইত্যাদি কর্মকান্ড চালানো হয়। এক পর্যায়ে ৩টি কেন্দ্রে ভোট গণনা বন্ধ রাখা হয়। পরে প্রশাসন ও সাংবাদিকদের সহায়তায় ভোট গণনার পরে ২২ হাজার ২৫ ভোট পেয়ে বিজয়ী হোন জগবতী রানী টপ্পো।
লড়াকু জগবতি রানী টপ্পো সব সময় নিজের মোটরবাইকের মতো ছুটে চলেন। একজন প্রান্তিক ও পিছিয়ে পড়া আদিবাসি জনগোষ্ঠির নারী তার অদম্য ইচ্ছে শক্তি দিয়ে মানুষের হৃদয়ে স্থায়ী ঠিকানা গড়তে দিন-রাত গ্রামে গ্রামে ঘুড়ে বেড়াচ্ছেন। সমতার সমাজ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে সমতলের একজন আদিবাসী লড়াকু জগবতি রানী প্রতিনিধিত্ব করছেন। বিশেষ করে সকল স্থানে আদিবাসী নারীর দুরবস্থাকে আড়াল করা হয়। জগবতি রানী সেই চিরায়ত ধারাকে ভেঙ্গে সমতার সমাজ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। পুরুষ তান্ত্রিকতাকে পরাজিত করে সামাজিক অনুশাসন, ধর্ম, অর্থ ও পেশীশক্তিকে মোকাবেলা করে নিজের গোষ্ঠির মানুষসহ দেশের পিছিয়ে পড়া সকল মানুষদের সমাজের মূলধারায় যুক্ত করে তাদের সমঅধিকার নিশ্চিত করা পর্যন্ত জগবতি রানী টপ্পো তার জীবনের শেষ দিনও এই লড়াই চালিয়ে যাওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।
জেলা প্রশাসক মোঃ গোলাম মওলা বলেন, জগবতি রানী টপ্পো সত্যিই সকলের জন্য এক দৃষ্টান্তর। এমন ব্যক্তিদের জন্য সরকারের সার্বিক সহযোগিতা পাওয়ার দুয়ার সব সময় খোলা আছে। এছাড়া জগবতি রানী টপ্পোর পাশে জেলা প্রশাসন রয়েছে। তাকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করার কথাও জানান জেলা প্রশাসক।