হাজার বছরের চলে আসা বাঙ্গালিদের কিছু ঐতিহ্যবাহী জিনিস যা আমরা সেই প্রাচীন কাল হতে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করে আসছি। এই ঐতিহ্যবাহী জিনিস গুলি হাজার বছরের বাংলার সংস্কৃতির এক একটি উপাদান ও বাঙ্গালী সংস্কৃতি – ঐতিহ্যর ধারক যা গ্রাম বাংলার গৃহস্থের সচ্ছলতা ও সুখ সমৃদ্ধির প্রতিক হিসাবে প্রচলিত ছিল। আজ এই আধুনিক যুগে আধুনিক পণ্যের কাছে , আধুনিক কলা কৌশলের নিকট মার খেয়ে আস্তে আস্তে বিলুপ্তির পথে। যতই দিন যাচ্ছে ততই যেন মানুষের জীবনে এটে সেটে বসছে আধুনিকতার ধারা । তাই এই দুর্বলতাকে পাশকাটিয়ে আমাদের সংস্কৃতিকে আমাদেরই লালন করতে হবে। তা না হলে তখন হয়ত আমাদের নতুন প্রজন্ম এই ঐতিহ্য থেকে একবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে।
নিচে কিছু গ্রামবাংলার হারিয়ে যাওয়া জিনিষের নাম উল্লেখ করা হলো।
১। ঢেঁকি:
ও ধান ভানিরে ঢেঁকিতে পাড় দিয়া- আমাদের ঢেঁকি শিল্প-গ্রাম বাংলার বৌ ঝিদের সেই ধান চাল ভাঙ্গার ঢেঁকিতে পাড় দেওয়ার ছবি যেন ফুটে ওঠে এ গানটিতে।ঢেকি আমাদের এই বাংলার ইতিহাস ঐতিহ্যেরই একটি অংশ। আজকাল গ্রামের বাড়িগুলিতেও খুব কম পরিমান ঢেঁকিই চোখে পড়ে অথচ একদিন ঢেঁকি ছাড়া একটি বাড়িও কল্পনা করা কঠিন ছিলো। চাল ডাল মসলা ঢেঁকিতে ভানতো বাড়ির বৌ ঝিয়েরা। আজ ঢেঁকিতে ছাটা শস্যের বদলে এসেছে মিলে ছাটা চাল, ডাল মসলা। তাই আর আজকাল গ্রামের বাড়িগুলোতে ঢেঁকিতে পাড় দেবার ধুপধাপ শব্দও শোনা যায়না । ছাটা চালের কদর এখনও কমেনি কারন ঢেঁকি ছাটা চালের উপরের আবরন বা খোসা অন্নু থাকে যাতে প্রচুর পরিমান ভিটামিন রয়েছে। ঢেঁকি চালাতে সাধারনত দুজন লোকের প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রে সাধারনত মহিলারাই চালায় ঢেঁকি।
২। ইঁদারা বা পাতকুয়া-
বহু প্রাচীন বাড়িগুলিতে আজও দেখা পাওয়া যায় মজে যাওয়া কুয়া বা ইঁদারার। আজকালকার ছেলেমেয়েরা সেসব হয়তো টম এ্যান্ড জেরীর কার্টুনে জেরীকে কুয়া থেকে দড়ি দিয়ে টমের টেনে তুলবার দৃশ্য ছাড়া আর কোথাও দেখেইনা। প্রাচীনকালে মানুষ যখন ডোবা ও নদীর অপরিশুদ্ধ পানি পান করতো তখনকার বিজ্ঞানীরা অনেক গবেষণাকার্য সম্পন্ন করে কূপের জন্ম দেন। জমিদাররা ইঁদারাথেকে প্রাপ্ত পানিকে আরও পরিশুদ্ধ করতে ইঁদারার মধ্যে পাইপ লাগিয়ে পানি উত্তোলন করতো। এই কারনেই পুরানো জমিদার বাড়িতে বহু পুরোনো কুয়ার দেখা আজও মিলে। পর্যায়ক্রমে মানুষ যখন সভ্য, সুশিক্ষিত ও জ্ঞান বিজ্ঞানে সমৃদ্ধশালী হলো তখন নলকূপের সৃষ্টি হলো
৩। শিকা ছেড়া ও গ্রামবাংলার শিকা-
শিকা গ্রাম বাংলায় গ্রামীণ বধূদের নিপুণ হস্তশিল্পের একটি শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। শিকার ছিল বহুমুখী ব্যবহার। পল্লী বধূরা শিকায় ঝুলিয়ে রাখতো সংসারের বিভিন্ন জিনিস। মাঝে মাঝে রঙিন শিকেয় ঘরের মাঝে নতুন হাঁড়িপাতিল ও অন্যান্য জিনিস সারি সারি ভাবে ঝুলিয়ে রাখতো। বর্তমানে শিকার প্রচলন নেই বললেই চলে।
৪ । কুপি বাতি :
কুপি বাতি এখন যেন শুধুই স্মৃতি, আধুুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে গ্রাম বাংলার কুপি বাতি যেন নিভে গেছে। এক কালে গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে কুপি বাতি ছিল, যা এখন খুব কম চোখে পড়ে। গ্রাম বাংলার সেই অতি প্রয়োজনীয় কুপি আজ এক প্রকার বিলীন হয়ে গেছে।
অমাবশ্যার রাতে মিটি মিটি আলো জ্বালিয়ে গ্রামের মানুষের পথচলার স্মৃতি এখনো সৃষ্টিশীলদের কাছে টানে। একটা সময় ছিলো যখন গ্রাম বাংলার আপামর জনসাধারণের অন্ধকারে অলোক বর্তিকার কাজ করতো কুপি।
সামর্থ অনুযায়ী মানুষ কুপি কিনে ব্যবহার করতেন। বাজারে সাধারণত ছোট ও বড় দুই ধরণের কুপি পাওয়া যেত।
কিন্তু বর্তমানে গ্রামে বিদ্যুতের ছোঁয়ায় কুপির কদর যেন হারিয়ে গেছে। বিদ্যুৎ না থাকলেও অজপাড়াগাঁতেও মানুষ ব্যবহার করছেন সৌর বিদ্যুৎ সহ বিভিন্ন প্রকার চার্জার।
৫।খড়ম:(পাদুকা)
বর্তমান আধুনিকতার ছোঁয়ায় কাঠ নির্মিত পাদুকা খড়ম এখন শুধুই স্মৃতি। এককালে সমগ্র দেশের মানুষই ছিলো খড়ম নির্ভর। কিন্তু বর্তমানে এ শিল্পটি হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে।
বর্তমানে চামড়া, রেকসিন, প্লাস্টিক, কাপড় ইত্যাদি দিয়ে তৈরি জুতা (পাদুকা) মানুষের পায়ে শোভা বর্ধন করে। বিগত কয়েক বছর ধরে বার্মিস জুতায় ছেয়ে গেছে । অথচ ৭০’র দশক পর্যন্ত গ্রাম বাংলায় অনেক জনপ্রিয় ছিল এই খড়ম পাদুকা। জানা যায়, কাঠ দিয়ে তৈরি খড়ম পরিবেশবান্ধব।
কুপি তৈরির কারিগর বা মিস্ত্রি শংকর দাস বলেন,আগে আমাদের ব্যাপক চাহিদা ছিল।আমাদের কাছে বিভিন্ন নঁকশার কূপি বানানোর অর্ডার আসতো।আমরা সুন্দর সুন্দর ;কুপিবাতি বানাতাম।এখন আর সেই কুপিবাতির ক্রেতা নাই।যার কারনে আমরাও পেশা পরিবর্তন করে নতুন পেশায় নেমে পড়েছি”।
প্রাচীন ঐতিহ্য নিয়ে কথা বলতে গেলে, আমতলী উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের সত্তর আশি বছরের বৃদ্ধা নারীরা বলেন, গ্রাম বাংলার পুরনো জিনিসের কথা বলতে গেলে আমাদের ছেলের বউ মারা হা করে তাকিয়ে থাকেন। নাতিনাতনিরা কৌতূহল ও গল্প হিসেবেই মনে করেন। আমরা আগে ঢেঁকি ধান নিতাম, হাড়ি পাতিল রাখার জন্য শিকা ছেড়া বুম তাম সন্ধ্যা হলে হারিকেন কুপি জ্বালাতন। এখন তো সব আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে।