মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ চলছে। এক শ্রেণির দালাল টাকার বিনিময়ে তাদের অনুপ্রবেশে সহযোগিতা করছে।
স্থানীয়দের হিসাবে, গত একমাসে কক্সবাজারের টেকনাফ,
উখিয়া ও বান্দরবানের
নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম সীমান্তের
বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে ১৫ থেকে ২০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে
অনুপ্রবেশ করেছে।
তবে টেকনাফ উপজেলা প্রশাসনের মতে, এ সংখ্যা আট থেকে নয় হাজার। সংখ্যা যাই হোক, ফের নতুন করে রোহিঙ্গা
অনুপ্রবেশের কারণে স্থানীয়দের
মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে।
সীমান্ত এলাকার লোকজন বলছে, মিয়ানমারের রাখাইনের
মংডু শহরে দেশটির সরকারি বাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ) লড়াই তীব্র হয়ে উঠেছে। মংডু টাউনশিপ
ঘিরে এ লড়াইয়ে আবারও রোহিঙ্গাদের জীবন হুমকির মুখে পড়েছে।
প্রাণভয়ে ভিটেমাটি ফেলে গত একমাস ধরে মংডু ও আশপাশের
এলাকা থেকে দলে দলে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে
ঢুকে পড়ছে। এমনকি অনুপ্রবেশের আশায় সীমান্তের
ওপারে জড়ো হয়েছে আরও অন্তত ৬০ হাজার রোহিঙ্গা।
অভিযোগ উঠেছে, বর্তমানে
টেকনাফ সীমান্ত দিয়েই বেশির ভাগ রোহিঙ্গা
অনুপ্রবেশ করছে। রোহিঙ্গারা
কাঠের নৌকায় করে নাফ নদী পার হয়ে দালালদের সহযোগিতায়
টেকনাফে ঢুকছে। এরপর তারা টেকনাফ ও উখিয়ার বিভিন্ন রোহিঙ্গা
শিবিরে ঢুকে পড়ছে। অনেকে টেকনাফে বিভিন্ন
বাসাবাড়িতেও আশ্রয় নিচ্ছে।
সীমান্তে বিজিবি ও কোস্ট গার্ডসহ প্রশাসনের
কড়া নজরদারির মধ্যেই আবারও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের
ঘটনায় উদ্বিগ্ন স্থানীয়রা।
কক্সবাজার রোহিঙ্গা প্রতিরোধ
কমিটির সভাপতি ও সুশাসনের জন্য নাগরিক
(সুজন) কক্সবাজারের সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান বলেন, ১২ লাখ রোহিঙ্গার বোঝায় এমনিতেই
হিমশিম খেতে হচ্ছে, এ অবস্থায় নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ
উদ্বেগের।
অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সরকার কঠোর অবস্থানে না গেলে ভবিষ্যতে আরও কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি
হতে হবে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় ৬০-৬৫ হাজার রোহিঙ্গা
সীমান্ত ঘেঁষা বাসিন্দারা
বলছেন, গত এক মাসে ১৮ থেকে ২০ হাজার রোহিঙ্গা
অনুপ্রবেশ করেছে। এমনকি বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের জন্য মংডু ও আশপাশের
সীমান্তে আরও ৬০-৬৫ হাজার রোহিঙ্গা
জড়ো হয়েছে বলে দাবি করছেন তারা।
সীমান্তের একাধিক সূত্র বলছে, টেকনাফের জাদিমোরা,
দমদমিয়া, কেরুনতলি, বরইতলি,
নাইট্যংপাড়া, জালিয়াপাড়া, নাজিরপাড়া,
মৌলভীপাড়া, নয়াপাড়া, সাবরাং,
শাহপরীর দ্বীপ, জালিয়াপাড়া,
মিস্ত্রিপাড়া, ঘোলারচর, খুরেরমুখ,
আলীর ডেইল, মহেষখালীয়াপাড়া, লম্বরী,
তুলাতলি, রাজারছড়া, বাহারছড়া
উপকূল, উখিয়ার বালুখালী,
ঘুমধুম সীমান্তসহ অন্তত ৩০টি পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটছে। মংডুর উত্তরের প্যারাংপুরু
ও দক্ষিণের ফাদংচা এলাকায় জড়ো হয়ে থাকা রোহিঙ্গারা দালালদের
সহায়তায় অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালাচ্ছে।
স্থানীয়রা জানান, এক শ্রেণির দালাল চক্র রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে পাঁচ লাখ কিয়াত (বার্মিজ নোট) বা বাংলাদেশি ২০ হাজার টাকা নিয়ে সীমান্ত
পার করিয়ে দিচ্ছে।
রোহিঙ্গাদের সংগঠন আরাকান সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের
চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জুবায়ের
বলেন, জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গা
সংকট সমাধানে কার্যকর
ভূমিকা নিতে পারছে না। এতে নতুন করে আরও রোহিঙ্গা
অনুপ্রবেশ ঘটছে।
তিনি বলেন, রাখাইনের
দখল নিয়ে জান্তা বাহিনী ও আরাকান আর্মির যুদ্ধের কারণে সেখানে নতুন সংকটে পড়েছে রোহিঙ্গারা। অনেক রোহিঙ্গা মারা যাচ্ছে।
এসব বন্ধে আন্তর্জাতিক
মহলের কঠোর হস্তক্ষেপ
জরুরি।
রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের বিষয়টি স্বীকার করে টেকনাফের
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা
(ইউএনও) আদনান চৌধুরী বলেন, বিজিবির কঠোর নজরদারির পরও অনুপ্রবেশ
ঠেকানো যাচ্ছে না। গত এক মাসে আট-নয় হাজারের
মতো রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ
করেছে। অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে বিজিবি ও কোস্ট গার্ডের টহল বাড়ানো হয়েছে।
অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গাদের
আশ্রয় দেওয়ার সিদ্ধান্ত
হয়নি
২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমারের
সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে পড়ে বাংলাদেশে অন্তত আট লাখ রোহিঙ্গা
আশ্রয় নেয়। সাত বছরে কাউকেই ফেরত নেয়নি মিয়ানমারের জান্তা সরকার। সম্প্রতি চীনের মধ্যস্থতায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কার্যক্রম
শুরু হলেও রাখাইনের
যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে তা থেমে যায়।
নতুন করে রোহিঙ্গাদের
আশ্রয় দেওয়া যাবে না বলে জানিয়েছেন
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। গত রোববার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে
সাংবাদিকদের তিনি বলেন, জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা নতুন আগতদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশকে অনুরোধ করেছিল, যা সরকার দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে।
৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত
আট হাজার রোহিঙ্গা
বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে বলে জানান তিনি। উপদেষ্টা বলেন, আমরা ইউএনএইচসিআরকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছি, আমাদের পক্ষে আরও রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়া সম্ভব নয়।
অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গারা
টেকনাফ ও উখিয়ার বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরে ঠাঁই নিয়েছে বলে জানিয়েছেন
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি)
মোহাম্মদ মিজানুর রহমান।
তিনি বলেন, নতুন আসা রোহিঙ্গারা বিভিন্ন
ক্যাম্পে আত্মীয়-স্বজনদের
ঘরে অবস্থান করছে। এর মধ্যে অনেকেই গুলিবিদ্ধ ও আহত রয়েছে। তাদের চিকিৎসার
সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। তবে নতুনদের আবাসন নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত
হয়নি।
উখিয়া, টেকনাফ ও নোয়াখালীর ভাসানচরসহ ৩৩টি রোহিঙ্গা শিবিরে বসবাস করছে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা। এর মধ্যে প্রায় আট লাখ রোহিঙ্গা ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের
পরে আসে।
মংডু টাউনশিপ ঘিরে তীব্র লড়াই
গত ফেব্রুয়ারির শুরু থেকে বাংলাদেশ সীমান্তে
আরকান আর্মির সঙ্গে সরকারি বাহিনীর লড়াই শুরু হয়। আরাকান আর্মি ইতোমধ্যে রাখাইনের
৮০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণের
পাশাপাশি বাংলাদেশ সীমান্তের
সবকটি সীমান্তচৌকি দখলে নিয়েছে। এখন রোহিঙ্গা
অধ্যুষিত মংডু টাউনশিপ
ও আশপাশের এলাকায় যুদ্ধ চলছে।
এ যুদ্ধে রোহিঙ্গাদের
ঘরবাড়িও জ্বালিয়ে দিচ্ছে আরকান আর্মি। এমনকি তারা মংডু টাউনশিপের
পাশের পাঁচটি গ্রাম সুধাপাড়া, মংনিপাড়া, সিকদারপাড়া,
উকিলপাড়া ও নুরুল্লাপাড়া দখল করে অন্তত ৫০-৬০ হাজার রোহিঙ্গাকে
উচ্ছেদ করেছে। মংডু ও আশপাশের গ্রামগুলোতে
তিন লাখের বেশি রোহিঙ্গার বসবাস রয়েছে।
রোহিঙ্গারা জানায়, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের
পরও মংডু এলাকায় বসবাসরত রোহিঙ্গাদের সমস্যা হয়নি। কিন্তু এখন তাদেরও উচ্ছেদ করা হচ্ছে। এমন যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ফের বাংলাদেশে
আশ্রয় খুঁজছে তারা।