শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী ঃ
হয়তো আমাদের বোঝার মধ্যেই একটা অস্পষ্টতা থেকে যায়। এ অস্পষ্টতাই অনেক সময় মানুষকে মৃত্যু পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায়। সময় এখানে একটা মহামূল্যবান উপাদান হিসেবে কাজ করে। সময়ের বোঝাটা সময়ে বুঝতে না পারাটাই ‘আমি অন্ধের দেশে চশমা বিক্রি করি’-এর মতো। ১৯৩১ সালের একটা ঘটনা মনে পড়ল।
কৌতুক অভিনেতা চার্লি চ্যাপলিন আইনস্টাইনকে আমন্ত্রণ জানান তার একটি শো দেখার জন্য। তখন চ্যাপলিনের ‘সিটি লাইটস্’ সিনেমার প্রদর্শনী চলছিল। শো-এর পরে তারা দুজন শহরের পথ ধরে হেঁটে যাচ্ছিলেন, তখন চ্যাপলিন আইনস্টাইনকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘সবাই আমাকে সহজেই বোঝে, এজন্যই আমার এত জনপ্রিয়তা। কিন্তু মানুষ আপনাকে কেন এত পছন্দ করে বুঝলাম না।’ আইনস্টাইন সহাস্যে জানালেন, ‘কেউ আমাকে সহজে বুঝতে পারে না বলেই আমার এ জনপ্রিয়তা।’
তাহলে মানুষ যাকে সহজে বোঝে আর যাকে বোঝে না, তারা দুজনই কি জনপ্রিয় হয়? বোঝা না বোঝার এ ঘোরের মধ্যেই মানুষকে বোঝার গভীর তত্ত্বটা অনেকটা এক টুকরো আলোর মতো ছড়িয়ে থাকে। মানুষের মধ্যে মহানুভবতা থাকলে সময় মানুষের মধ্যে বোধশক্তি তৈরি করে। কিন্তু মানুষের মধ্যে মহানুভবতা না থাকলে সময় তখন অপেক্ষা করে।
সে অপেক্ষা কতটা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে, তা অনেকটা অনিশ্চিত। কারণ সময় তখন নিজেকে আড়াল করে, নিরুদ্দেশ হয়। যাযাবর হয়। কেউ সময়ের এ রহস্যকে ভেদ করতে পারে না। তবে চার্লি চ্যাপলিন আইনস্টাইন-এর ‘কেউ আমাকে সহজে বুঝতে পারে না বলেই আমার এ জনপ্রিয়তা’ এ উত্তরটার ভেতরের অর্থ বুঝতে পেরেছিলেন। আত্মজীবনীতে তাই চ্যাপলিন লিখছেন, আইনস্টাইনকে তার ঘরোয়া ‘আলপাইন জার্মান’দের মতোই লেগেছিল। তবে চমৎকার অনুভূতিসম্পন্ন, হাসিখুশি আর বন্ধুত্বপূর্ণ ছিলেন আলবার্ট।
তিনি খুব শান্ত ও ভদ্র। তবে এসব ছাপিয়ে ফুটে উঠেছিল আইনস্টাইনের গভীর ও অনন্য সংবেদনশীল মনের পরিচয়। চ্যাপলিনের ধারণা, এ সংবেদনশীল মনই আইনস্টাইনের অনন্য সাধারণ পাণ্ডিত্যের আধার।
আইনস্টাইনের সংবেদনশীল মনের পাণ্ডিত্য সবার পক্ষে বুঝে উঠাটা হয়তো কঠিন ছিল; কিন্তু তিনি যে কিছু একটা করে পৃথিবীর চিন্তাধারা বদলে ফেলতে পেরেছেন, সেটি সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা সহজাত কৌতূহল তৈরি করতে পেরেছিল। মানুষের এ কৌতূহল থেকে আইনস্টাইন মানুষের কাছে সাধারণ থেকে অসাধারণ মানুষে পরিণত হয়েছিলেন। সাধারণ মানুষ আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বকে না বুঝলেও তার চিন্তার শক্তিকে বুঝতে পেরেছিল। যেটি সে সময় নীরবে, নিভৃতে আইনস্টাইনকে মানুষের কাছে জনপ্রিয় করে তুলেছিল।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর আর রাজা রামমোহন রায় সে সময় সমাজ যা বিশ্বাস করত, তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস দেখিয়েছেন। রাজা রামমোহন রায় যেমন ‘সতীদাহ প্রথা’ বন্ধের সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। অন্যদিকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরও বাল্যবিবাহ ও কৌলীন্য প্রথা বন্ধে এবং বিধবা বিবাহ চালু করতে সমাজ সংস্কারের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করেছিলেন। সমাজ এগুলোকে সে সময় জীবনের অপরিহার্য অংশ ও নৈতিকতা বলে প্রচার করেছিল।
গতানুগতিক ধারার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সে সময় ঈশ্বরচন্দ্র ও রাজা রামমোহন রায় সমাজের কাছে ভিলেন বলে পরিগণিত হলেও আজকের সময় ও সমাজ তাদের মহানায়কে পরিণত করেছে। সে সময়ের সমাজের পশ্চাৎপদ ধারণার মানুষদের কেউ মনে না রাখলেও ঈশ্বরচন্দ্র ও রাজা রামমোহন রায়কে সময় এখনো মনে রেখেছে। এটাই সময়ের ধর্ম।
ইতিবাচক দিকগুলো যতই পুরনো হোক না কেন, তাতে যদি মানবিক ধারণার নান্দনিকতা থাকে; তবে তার আলো কখনো নিভে যায় না। প্রযুক্তির আভিজাত্যের রঙ মেখে দারুণ এ সময়ে আমরা কতটুকু মানুষকে বোঝার চেষ্টা করেছি, কতটা করছি; সে বুঝতে পারার শক্তিটাই কেমন, যা ‘বোঝা’ হয়ে ঝুলে পড়েছে কোনো একটা আস্থাহীনতার জায়গায়! যাদের আমরা ভালো বলছি, তারাই হয়তো খারাপ। আবার যাদের আমরা খারাপ বলছি, তারাই হয়তো ভালো। এ এক গোলক ধাঁধা। সময়ের পরীক্ষা। যে পরীক্ষাটা সময় নেয়। উত্তরটাও সময় দেয়।
তবে সময়ের টমটম ঘোড়ায় চড়ে মানুষের সম্পর্কগুলো কেমন যেন অগোছালো, আলগা, ফসকা গেড়োর মতো হয়ে গেছে। মা, বাবা, ভাই, বোনের সম্পর্কগুলো কেমন যেন অচেনা হয়ে পড়েছে। আপন প্রাণের টানটায় কেমন যেন ঘুণে ধরেছে। মরিচা পড়েছে। সময়টা কি তবে অচেনা হয়ে গেল! মায়া-মমতা সব নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল! সেই পুরনো দিনের সম্পর্কের মখমলটা বিবর্ণ সুতার রক্তে যেন পচে গেছে। মা ছুটছে হাই সোসাইটিতে নিজের বড়ত্বের প্রমাণ দিতে; বাবা ছুটছে অবৈধ টাকার পিছনে।
অনৈতিকতাকে নৈতিক বানানোর রঙ-রূপ-রসে ছেলেমেয়েরা উচ্ছন্নে গেছে। মাদক আর ভোগবাদী দুনিয়াতে তারা ডুব দিয়েছে। না আছে মন, না আছে মানবিকতা, না আছে জীবনবোধ। সব মিছে খেলা হয়ে কাদামাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। বন্ধুতে-বন্ধুতেও আর চাকচিক্য নেই, আছে স্বার্থের রুগ্ন দেহ। লোভ, কামনা, বাসনা। বন্ধুর মধ্যে আর সেই মায়ার বন্ধন নেই, জাদুকরী চিন্তার শক্তি নেই। সবাই কাঁচা পয়সার তেলেসমাতিতে বেসামাল হয়ে দড়ি টানাটানির প্রতিযোগিতায় নেমেছে। মানুষের ভেতর এখন আর কিছু নেই।
আছে কেবল অস্তিত্বহীন কিছু হাড় ও কংকাল। তবুও জীবন, তবুও সময় কখনো ভুল করে না। সময় সময়ের মতো করে জেগে উঠে। যেমন সময় কখনো ডানা মেলে উড়াল দেয়, আবার কখনো ডানাটা খুলে নেমে আসে মাটির পৃথিবীতে। সময়কে মানুষ যদি বুঝতে পারে, মানুষও সময়কে তখন বুঝে; যা একদিন বাস্তব হয়ে স্বপ্নের সময় হয়। সময়ের পরীক্ষাটা খুব কঠিন বরফের মতো। কখনো এটা পানি, কখনো জলীয়বাষ্প, আবার কখনো বরফ। কখনো গন্তব্যহীন।
রোমান সম্রাট নিরোর কথা মনে পড়ছে। নিরোকে নিয়ে সবচেয়ে প্রচলিত কথাটি হলো-রোম যখন পুড়ছিল, নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিল। এটা সত্য না মিথ্যা ছিল, সে বিচারের ভার সময়ের হাতে। কারণ সময় সর্বদাই বেঁচে থাকে, কিন্তু মানুষ সময়ের গর্ভে হারিয়ে যায়। রোমান সম্রাট নিরো ইতিহাসের সবচেয়ে নির্মম ও পাগলাটে ধাঁচের শাসক ছিলেন। কথিত আছে, নিরোর মা নিরোকে ক্ষমতায় বসালেও তিনি তার মাকে হত্যা করেন। ক্ষমতার উন্মুক্ততায় নিরোর হত্যার শিকার হয়েছেন তার সৎভাই ও স্ত্রীরা।
বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ওপর তার দমন-পীড়নের কাহিনী এখনো মানুষের মুখে মুখে। একটা আবেগতাড়িত শিল্পমনস্কতা তার মধ্যে বিদ্যমান ছিল। নিরো থিয়েটার করতে খুব পছন্দ করতেন। তিনি বীণা জাতীয় বিশেষ একটি বাদ্যযন্ত্র বাজাতেন, গান গাইতেন, কবিতা লিখতেন এবং মঞ্চে অভিনয়ও করতেন। সম্রাট নিরোর শাসনকালের প্রথম পাঁচ বছর তার জনপ্রিয়তা ছিল ঈর্ষণীয়। এ সময়টা রোমান জনগণের জন্য ‘স্বর্ণযুগ’ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। সময় তাকে মানুষের রাজা বানিয়েছিল। সময়ের ভয়ংকর নিষ্ঠুরতা আবার তাকে পথের মাটিতে ছুড়ে মেরেছে। এটা তো সময়ের খেলা, সময়ের নাটক। সেনাবাহিনী ও সিনেট তাকে ‘জনগণের শত্রু’ হিসেবে ঘোষণা করে। নিরোকে যেখানেই পাওয়া যাবে, সেখানেই তাকে হত্যা করার আদেশ জারি হয়। বিশাল রাজপ্রাসাদে থাকা সম্রাট নিরো গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে পালিয়ে বেড়াতে থাকেন। কিন্তু সেটা আর কতক্ষণ? রক্ষীরা তার গন্তব্যের খোঁজ পেয়ে যখন অগ্রসর হচ্ছিল, তখন তিনি আত্মহত্যা করেন।
মৃত্যুর আগে তিনি ‘কোয়ালিস আর্টিফেক্স পেরেও’ বলে চিৎকার করছিলেন। কী অদ্ভুত! সময় যেটা তাকে উচ্চারণ করতে প্ররোচিত করেছিল, সেটার অর্থ ছিল বহুমাত্রিক। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য অর্থ হিসেবে যা বিবেচনা করা হয়, তা হলো- ‘আমার মৃত্যুর সময়ে আমি কী দারুণ এক শিল্পী’, ‘আমার সঙ্গে কী এক শিল্পীর মৃত্যু হচ্ছে’ অথবা ‘আমি একজন বণিকের মতো মারা যাচ্ছি।’ কী বিচিত্র সময়ের রং বদলানোর জাদু; যার অস্থিমজ্জার পচনশীলতায় মানুষ একসময় পচে যায়। কখনো সময়ের সম্মোহনী জাদুতে মানুষ প্রাণশক্তি ফিরে পায়।