আরিফ রহমান, সিনিয়র সাংবাদিক :
কুমারী পূজা হলো তন্ত্রশাস্ত্রমতে অনধিক ষোলো বছরের কুমারী মেয়ের পূজা। বিশেষত দুর্গাপূজার অঙ্গরূপে এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়।
শাস্ত্রমতে কুমারী পূজার উদ্ভব হয় বানাসুর বধ করার মধ্য দিয়ে। গল্পে বর্ণিত রয়েছে, বানাসুর এক সময় স্বর্গ-মর্ত্য অধিকার করায় বাকি বিপন্ন দেবগণ মহাকালীর শরণাপন্ন হন। সে সকল দেবগণের আবেদনে সাড়া দিযে় দেবী পুনর্জন্মে কুমারীরূপে বানাসুরকে বধ করেন। এরপর থেকেই মর্ত্যে কুমারী পূজার প্রচলন শুরু হয়।
পৌরাণিক কাহিনী আমাদের জানায় প্রাগৈতিহাসিক তামিল যুগের অধিপতি ছিলেন রাক্ষস বানাসুর। তিনি ছিলেন অত্যন্ত শক্তিশালী রাজা। বানাসুর তপস্যা অনুশীলন করেছিলেন এবং ভগবান ব্রহ্মার কাছ থেকে বর পেয়েছিলেন যে তাঁ মৃত্যু কেবল একটি কিশোরী যুবতীর দ্বারাই হতে পারে।
এই শক্তিশালী বর পেয়ে বানাসুর নির্ভীক হয়ে যান এবং সমগ্র বিশ্বকে ধ্বংস করতে থকেন। বানাসুর ভগবান ইন্দ্রকে জয় করে তাকে সিংহাসন থেকে উৎখাত করেন। তিনি সেখান থেকে সমস্ত দেবতাদের বিতাড়িত করেন। বিশ্বের মৌলিক প্রাকৃতিক উপাদান, অগ্নি, জল, বায়ু সমন্বয়হীন হয়ে মহাবিশ্বে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে।
বানাসুরকে বধ করতে এবং প্রকৃতির ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে ভগবতী নিজেকে আর্যাবর্তের দক্ষিণ প্রান্তে কুমারী রূপে প্রকাশ করেন। এক কুমারী কিশোরী হিসাবে শিবের প্রতি তার অগাধ ভক্তি ছিলো তার।
ঘটনাপ্রবাহে ভগবান শিব কুমারী দেবীকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন। বিয়ের সব আয়োজন করা হয়ে। ভগবান শিব বিয়ের জন্য শুচিন্দ্রাম থেকে যাত্রা শুরু করেন। বিবাহের মুহুর্ত (মুহুর্তম বা শুভ সময়) ছিল ভোরবেলা ব্রাহ্ম মুহুর্তে।
এদিকে ঋষি নারদ বুঝতে পেরেছিলেন কুমারী দেবীই বানাসুরকে হত্যা করতে পারেন। তাই এই বিয়েকে বাধা দিতে তিনি মোরগের শব্দ করে শিবের কাছে ভুল তথ্য পাঠান যে সূর্য ইতিমধ্যে উদিত হয়েছে এবং শুভ সময় অতিবাহিত হয়েছে। শুভ মুহূর্ত পেরিয়ে যাওয়ায় বিয়ে বাতিল হয়।
কুমারী ভগবান শিবের জন্য অপেক্ষা করতে করতে একসময় বুঝতে পারেন শিব আর আসবেন না। অসহ্য অপমান, যন্ত্রণা, শোক এবং ক্রোধের তিনি সবকিছু ধ্বংস করতে থাকেন। অবশেষে কুমারী দেবী একটানা তপস্যা শুরু করেন।
বহু বছর পরে বানাসুর একদিন তপস্যারত কুমারীকে দেখে তাকে অপহরণ করার চেষ্টা করেন। ক্রুদ্ধ কুমারী বানাসুরকে বধ করেন।
নিজের মৃত্যুর কয়েক মুহূর্ত আগে বানাসুর বুঝতে পেরেছিলেন যে এই কুমারিই হচ্ছেন সর্বশক্তিমান আদি পরাশক্তি। তিনি দেবীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
পুরোহিতদর্পণসহ বহু ধর্মীয়গ্রন্থে কুমারী পূজার পদ্ধতি এবং মাহাত্ম্য বিশদভাবে বর্ণিত হযে়ছে। বর্ণনানুসারে কুমারী পূজায় কোন জাতি, ধর্ম বা বর্ণভেদ নেই। দেবীজ্ঞানে যে-কোন কুমারীই পূজনীয়। এজন্য এক থেকে ষোলো বছর বয়সী যে কোনো কুমারী মেয়ের পূজা করা যায়।
কুমারী পূজার দার্শনিক তত্ত্ব হলো- নারীতে পরমার্থ দর্শন ও পরমার্থ অর্জন। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যে ত্রিশক্তির বলে প্রতিনিয়ত সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় ক্রিয়া সাধিত হচ্ছে, সেই ত্রিবিধ শক্তিই বীজাকারে কুমারীতে নিহিত। কুমারী প্রকৃতি বা নারী জাতির প্রতীক ও বীজাবস্থা। তাই কুমারী বা নারীতে দেবীভাব আরোপ করে তার সাধনা করা হয়।