চাপের মধ্য দিয়ে চলা ব্যবসা-বাণিজ্যের কাঁধে আরও
চাপানো হচ্ছে করের বোঝা। একদিকে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটে হাঁসফাঁস করছে শিল্প-কারখানা;
আরেকদিকে কম মুনাফায় টিকে থাকা প্রতিষ্ঠানের ওপরও বসছে অতিরিক্ত কর। আগামী ২০২৫-২৬
অর্থবছরের বাজেটে শুল্ক কাঠামোয় বড় ধরনের সংস্কার আনতে যাচ্ছে সরকার। এই সংস্কারের
ফলে দেশীয় শিল্প অতিরিক্ত সুরক্ষা থেকে বের হয়ে আসবে। এতেই বাড়তি চাপে পড়বে স্থানীয়
শিল্প। ফলে উৎপাদন খরচ বাড়বে। এতে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়ও বাড়বে। ২ জুন
সোমবার জাতীয় সম্প্রচার মাধ্যমে উপস্থাপন করা হচ্ছে নতুন অর্থবছরের বাজেট।
বাজেট
প্রণয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো থেকে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা এসব তথ্য
জানা গেছে। সূত্রগুলো জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ)
প্রেসক্রিপশনের পাশাপাশি আগের সরকারের মতোই কর বাড়িয়ে রাজস্ব বাড়ানোর প্রবণতা
দেখা যাচ্ছে আসন্ন বাজেটেও। তারই প্রতিফলন ঘটতে যাচ্ছে আমদানিপণ্যের শুল্কস্তর
পুনর্গঠন ও শুল্কহার বাড়ানো-কমানোর মধ্যে।
জাতীয়
রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে প্রায় ৫০০ ধরনের পণ্যে ২০
শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত আরোপিত সম্পূরক শুল্ক (এসডি) ও নিয়ন্ত্রক শুল্ক
(আরডি) কমানো বা পুরোপুরি তুলে নেওয়া হতে পারে নতুন অর্থবছরের বাজেটে। এ ছাড়া
স্থানীয় শিল্পকে দেওয়া প্রতিরক্ষণ সুবিধা তুলে নেওয়ার অংশ হিসেবে ১৪ ধরনের
শিল্পের কাঁচামাল আমদানির শুল্ক বাড়তে পারে দ্বিগুণ পর্যন্ত। কসমেটিক্স, ডোর লকসহ
২১ ধরনের পণ্যের ন্যূনতম মূল্য দ্বিগুণ পর্যন্ত বাড়তে পারে। ন্যূনতম মূল্য হলো,
আমদানিকারক যে দামেই কোনো পণ্য আমদানি করুক, সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম মূল্যের নিচে
ওই পণ্যের শুল্কায়ন হবে না।
কনজিউমারস
অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, ‘অন্তর্বর্তী
সরকার আগের মতোই মানুষের ওপর করের হার বাড়িয়ে রাজস্ব আদায়ের চেষ্টা করছে। এর
বাইরে আইএমএফেরও রাজস্ব বাড়ানোর দিকে একটা চাপ ছিল। সব মিলিয়ে সরকার আগের ধারাই
অনুসরণ করছে। এতে চাপে পড়বে স্থানীয় শিল্প। ফলে রাজস্ব আহরণ, কর্মসংস্থানের ওপরও
প্রভাব পড়বে। আমরা আশা করেছিলাম, অন্তর্বর্র্তী সরকার স্বতন্ত্রভাবে কিছু একটা
করবে। মানুষের ওপর করের চাপ বাড়বে না। কিন্তু সেই আশায় গুড়েবালি, মানুষ হতাশ।
আমরা দেখছি বিভিন্নভাবে করের বোঝা বাড়ানো হচ্ছে। মানুষের আয় বাড়েনি, খরচের
পাল্লা বাড়ছে। মানুষ আর নিতে পারছে না। কর্মসংস্থানও হচ্ছে না। বিপুল পরিমাণ
বেকার। একদিকে বেকারত্ব বাড়ছে, অন্যদিকে খরচ বাড়ছে।’
স্থানীয়
১৪টি উৎপাদন খাত যেমন বেভারেজ বা পানীয়, এলইডি বাল্ব, ওয়াটার পিউরিফায়ার,
ফ্যান, সিগারেটের কাগজ, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের কাঁচামালে শুল্ক তিনগুণ পর্যন্ত
বাড়তে পারে। প্রভাবিত পণ্যের মধ্যে রয়েছে শিশুদের জন্য ব্যবহৃত মল্ট
এক্সট্র্যাক্ট ও আটাভিত্তিক খাদ্যপণ্য, গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী নারীদের পুষ্টি
উপাদান বা সাপ্লিমেন্ট।
বেভারেজ
কনসেন্ট্রেট আমদানিতে কাস্টমস শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হতে
পারে। সয়া প্রোটিন-ভিত্তিক খাবার ও তামাকশিল্পে ব্যবহৃত সিগারেট পেপারের ওপর
সম্পূরক শুল্ক ৬০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০০ শতাংশ করা হতে পারে। স্যাটিন ফিতা
তৈরিতে ব্যবহৃত ওভেন কাপড়ের ওপরও একই ধরনের শুল্ক বৃদ্ধির প্রস্তাব রয়েছে। তা
ছাড়া, ফ্যান উৎপাদনে ব্যবহৃত নন-অ্যালয়ড
অ্যালুমিনিয়াম
শিট, ওয়াটার পিউরিফায়ারের যন্ত্রাংশ এবং টেলিভিশন তৈরির জন্য ব্যবহৃত এলইডি
বাল্ব ও ওপেন-সেল প্যানেলের ওপরও শুল্ক বাড়তে পারে। এলইডি ল্যাম্পের ওপর শুল্ক ১৫
শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করা হতে পারে। বাণিজ্যিকভাবে আমদানিকৃত সিগারেট
পেপারের ওপর শুল্ক হতে পারে ৩৫০ শতাংশ পর্যন্ত।
সরকার
লিপস্টিক, আই মেকআপ, ম্যানিকিউর পণ্য, ফেস পাউডার, কসমেটিকস, ফেসওয়াশ, খেলনা এবং
বিভিন্ন ধরনের তালাসহ এসব পণ্যের ন্যূনতম কাস্টমস মূল্যও বাড়াতে পারে, যার ফলে
ঘোষিত মূল্যের ওপর ভিত্তি না করে নির্ধারিত মূল্যের ওপর কর পরিশোধ করতে হবে
আমদানিকারকদের।
আরও যেসব
পণ্যের ওপর নতুন বা বাড়তি শুল্ক আসতে পারে, তার মধ্যে রয়েছে তামাক বীজ (২৫
শতাংশ), সয়াবিন মিল (৫ শতাংশ) এবং কাগজ উৎপাদনে ব্যবহৃত কাওলিন ক্লে। গ্রানাইট ও
মার্বেলের ওপর সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪৫ শতাংশ করা হতে পারে।
সিমেন্ট শিল্পে ক্লিংকার আমদানির ওপর নির্ধারিত শুল্ক বাতিল করে ২৫ শতাংশ অ্যাড
ভ্যালোরেম শুল্ক আরোপের প্রস্তাব রয়েছে, যা রাজস্ব বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে।
রেফারেল
হাসপাতালের জন্য আমদানিকৃত চিকিৎসা সরঞ্জামের শুল্ক ১ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০
শতাংশ করা হতে পারে। কম্পিউটার অ্যাক্সেসরিজ আমদানির ওপর চলমান কর রেয়াত বাতিলের
পরিকল্পনাও সরকারের রয়েছে, যার ফলে প্রযুক্তি খাতে খরচ বাড়তে পারে। এসব
পরিবর্তনের লক্ষ্য মূলত বাংলাদেশের এলডিসি উত্তরণকে সামনে রেখে শুল্ক কাঠামোর
যৌক্তিকীকরণের অংশ, যার লক্ষ্য স্থানীয় শিল্পকে অতিরিক্ত সুরক্ষা দেওয়া বন্ধ করে
বাণিজ্যে বৈশ্বিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্য স্থাপন করা।
অন্যদিকে
স্টিলের কাঁচামালে বিদ্যমান কাস্টমস শুল্ক প্রত্যাহার করে, কৌশলে তার চেয়ে প্রায়
৫০ শতাংশ বেশি ভ্যাট ও অগ্রিম আয়কর (এআইটি) মিলিয়ে শুল্ক বাড়ানো হচ্ছে, যার ফলে
প্রকৃত কর বাড়বে ৪০ শতাংশের বেশি।
অর্থ
মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলছে, আইএমএফের শর্তের জালে ১৭২টি পণ্যের সম্পূরক শুল্ক কমানো
হচ্ছে। এ ছাড়া রপ্তানির প্রধান গন্তব্য দেশ যুক্তরাষ্ট্রকে তুষ্ট করতে ১৩৫টি
পণ্যের কাস্টমস শুল্ক কমানোর পরিকল্পনা সরকারের। এতে আমদানিনির্ভরতা বাড়বে।
দেশীয় শিল্পের অসম প্রতিযোগিতায় পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
জানা
গেছে, বড় আঘাত আসছে নির্মাণ উপকরণে। এই খাতের বেশকিছু দরকারি পণ্যে শুল্ক
বাড়ানোর প্রস্তাব থাকছে। যেমন- সিমেন্ট, রড, বার, অ্যাঙ্গল, টাইলস, স্ক্রু, নাট,
বোল্ট ও নির্মাণসামগ্রীর দাম আকাশ ছুঁতে পারে। সিমেন্ট তৈরির মূল উপকরণ ক্লিংকারের
শুল্কায়ন হয় নির্ধারিত মূল্যে। বর্তমানে প্রতি মেট্রিক টনে ৭০০ থেকে ৯৫০ টাকা
কাস্টমস শুল্ক আছে। তবে এখন বাজারমূল্যে নির্ধারণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
তাতে শুল্ক ধরা হয়েছে ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ। ডলারের ঊর্ধ্বমুখী দর ও বাজারের
ওঠানামায় ব্যয়বহুল হতে পারে সিমেন্ট।
রড, বার ও
অ্যাঙ্গেল তৈরির কাঁচামালের ওপর বসানো হয়েছে বাড়তি শুল্কের বোঝা। বিভিন্ন ধরনের
স্ক্রু, নাট ও বোল্ট কিনতে গেলে এখন প্রায় তিনগুণ অর্থ ব্যয় করতে হবে। এসব পণ্যে
মোট করভার ৩৭ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৮৯.৩২ শতাংশ করা হয়েছে। টাইলস ও
নির্মাণসামগ্রীর মূল উপকরণ মার্বেল ও গ্রানাইট বোল্টারের সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ
থেকে বাড়িয়ে ৪৫ শতাংশ করা হচ্ছে। ফলে এর মোট করভার ৮৯.৩২ শতাংশ থেকে বেড়ে হবে
১২৭.৭২ শতাংশ।
স্থানীয়
শিল্প অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়বে এই অজুহাতে জিপসাম বোর্ড ও শিট আমদানিতে
দ্বিগুণ করা হয়েছে সম্পূরক শুল্ক। এখন শুল্কহার হবে ২০ শতাংশ। ঢাকা শহরের অন্যতম
বিরক্তিকর পরিবহন ব্যাটারিচালিত রিকশার দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই
রিকশার ১২০০ ওয়াটের ডিসি মোটরের কাস্টমস শুল্ক ১ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ করা হচ্ছে।
তামাকবীজে আগে শূন্য শতাংশ কাস্টমস শুল্ক থাকলেও এখন তা ২৫ শতাংশ করা হচ্ছে।
সয়াবিন মিলের কাস্টমস শুল্ক শূন্য থেকে ৫ শতাংশ করা হচ্ছে। এই পণ্যগুলোর দাম
বাড়লে ব্যয় বাড়বে সাধারণ মানুষের। বাজেটে উড়োজাহাজের কাস্টমস শুল্ক শূন্য থেকে
১ শতাংশ এবং হেলিকপ্টারে মোট করভার ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩৭ শতাংশ করা হচ্ছে।
বাজেটে
কিছু পণ্যের শুল্ককর কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু এর নেতিবাচক দিকও রয়েছে।
যেমন এসব পণ্যের বেশি আমদানি হলে স্থানীয় শিল্পের মাধ্যমে উৎপাদিত এসব পণ্য আবার
অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে পারে।
পিভিসি
পাইপ, কপার ওয়্যার, মোটরশিল্প, ব্যাটারিশিল্প, লিফটম, এলইডি বাতি, রাইস ব্র্যান
ওয়েল, টায়ার-টিউব দেশে উৎপাদন করা হয়। পিভিসি পাইপ দেশে উৎপাদন করা হলেও এর
উপকরণ আমদানি করতে হয়। এবার উপকরণের আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ
করা হচ্ছে। একই পদক্ষেপ কপার ওয়্যারেও। এই পণ্যের উপকরণ আমদানিতে কাস্টমস শুল্ক
১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
এ ছাড়া
শুল্ক ফাঁকি রোধে কিছু পণ্যের শুল্কহার বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে ফাঁকি
রোধ করা গেলেও ওইসব পণ্যের দামও বাড়বে স্থানীয় বাজারে। দেশে উৎপাদিত কৃষিপণ্যের
ন্যায্য দাম ও নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিতে কৃষিপ্রধান এলাকায় কোল্ড স্টোরেজ
দরকার। তবে উৎপাদনমুখী শিল্প না হওয়ায় রেয়াতি সুবিধায় আমদানি করতে পারছেন না এ
খাতের উদ্যোক্তারা। এবার কোল্ড স্টোরেজের যন্ত্রপাতি ১ শতাংশ কাস্টমস শুল্ক দিয়েই
আমদানি করতে পারবেন উদ্যোক্তারা।