মনির হোসেন :
‘নীলকুরিঞ্জি’ নামের নীল রঙের এক এক অদ্ভত ফুল ফোটে ভারতের পশ্চিমঘাট পর্বতমালায়। পর্বতমালাটিকে নীলকুরিঞ্জি ফুলের রাজ্যও বলা যায়। গোটা পর্বতের সারি ঢাকা পড়ে যায় এক আশ্চর্য নীল গালিচায়। এই ফুল প্রকৃতির এক বিস্ময়। সারা বছর তো নয়ই, এমনকি প্রতি বছরে কোনও বিশেষ সময়েও এই ফুল ফোটে না। এখানকার আদিবাসীদের কাছে এই ফুল শুভ বার্তার প্রতীক।
প্রতি ১২ বছরে মাত্র একবার ফোটে এই ফুল! এক যুগ পর পর একটি নির্দিষ্ট সময়ে ভারতের তামিলনাড়ু ও কেরালা রাজ্যের নীলগিরি পাহাড়ে এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় নীলকুরিঞ্জি ফুলটি। সত্যিই অবাক করার মতো ব্যাপার, কীভাবে এই ফুল হিসেব কষে ঠিক ১২ বছর পর পর ফুটে ।

কেউ হঠাৎ করে ফুলটিকে দেখলে এর তেমন কোনো বৈশিষ্ট্যই চোখে পড়বে না। লোকজনকে খুব একটা আকর্ষণ করার কথা নয়। কিন্তু মাইলের পর মাইল যখন ফুলে ফুলে ছেয়ে যায়, দেখে মনে হয়, কে যেন নীল-বেগুনি রঙের গালিচা পেতে দিয়েছে।
প্রকৃতির খেয়ালে নিজের মতো করেই বেড়ে উঠে নীলকুরিঞ্জি । কিন্তু যেই ফুলের সময় আসে, অমনি বনের চেহারাটাই পাল্টাতে থাকে। মনে হয়, কে যেন তুলি দিয়ে নীল রঙের ক্যানভাসে ফুলগুলো পরপর এঁকে চলেছেন। কুঁড়ি থেকে ফুল ফোটা পর্যন্ত প্রতিনিয়ত রং বদলাতে থাকে এই ফুলের।
কুড়ি থেকে ধীরে ধীরে এই ফুল যখন ফুটতে থাকে, তখন নীল থেকে নীলচে-বেগুনি ও সবশেষে ফিকে বেগুনি রং ধারণ করে এই ফুল। ফুলের এমন ঐশ্বরিক পরিবর্তন দেখার জন্য প্রতি বছর দেশ-বিদেশের পর্যটকদের ভিড় লেগে যায় এই উপত্যকায়। কিন্তু এমনই যার রাজকীয় আবির্ভাব, সেই ফুলের গাছগুলো কিন্তু নিতান্ত অনাদরেই বেঁচে থাকে।
তামিলনাড়ু ও কেরালা রাজ্যের আশেপাশের এই ফুলের আধিক্য দেখতে পাওয়া যায়। মুন্নার জেলার নীলগিরি পাহাড়েই সবচেয়ে বেশি ফোটে এই ফুল। শোনা যায়, নীলগিরি পাহাড়ের নামই হয়েছে এই ফুল থেকে৷ যখন এই ফুল ফোটে পাহাড়ের ঢালে ঢালে, তখন থাকে শুধু নীলেরই বাহার ৷ ২০০৬ সালে এমনই নীল রঙের ফুলে ঢেকে গিয়েছিল নীলগিরি এরপর ২০১৮ তে ফোটে, এরপর ফুটবে ২০৩০ এ। নীলগিরির বিস্তীর্ণ এলাকা ফের একবার ঢেকে যাবে নীলকুরিঞ্জি ফুলে।
২০০৬ সালে তামিলনাড়ুর কোদাইকানালের পালনি পাহাড়ে রেকর্ড সংখ্যক নীলকুরিঞ্জি ফুটেছিল। টার্নাস ভ্যালি উপত্যকায় এই ফুলের চাদর মেলেছিল। আবার কেরালার মুন্নার থেকে কোদাইকানালের দিকে যেতে সড়কপথে কেরালা-তামিলনাড়ু সীমান্তের টপ স্টেশন নামক জায়গাটির প্রধান আকর্ষণই হলো নীলকুরিঞ্জি।
তামিলনাড়ুর ক্লাভরাই এবং কেরালার কোভিলুরের মাঝখানের পার্বত্য অঞ্চলটিও এই ফুলের জন্য পরিচিত। নীলকুরিঞ্জির জন্যই পর্যটন মানচিত্রে বিশেষ জায়গা করেছে কাদাভারি পার্বত্য অঞ্চল। এমন কয়েকটি অঞ্চল নিয়েই গড়ে উঠেছে ‘কুরিঞ্জিসালা স্যাংচুয়ারি’। এছাড়া মুন্নার থেকে ৩৬ কি.মি. দূরে কোচি-মাদুরাই হাইওয়ের লাগোয়া পাহাড়ের কোলে ২০০৮ সালে ফুটেছিল নীলকুরিঞ্জি।
এছাড়া আরো কয়েকটি অঞ্চলে এই ফুল ফুটলেও সবসময় এর হিসেব রাখা সম্ভব হয় না। আর তাই নীল আকাশ, সবুজ পাহাড় আর এর মাঝে নীলকুরিঞ্জি ফুলের কার্পেট, অনেক সময় অনেক ভ্রমণপিপাসুদের কাছেই অধরা থেকে যায়।
প্রায় প্রজাতির ক্ষেত্রে এই ফুল ফোটে প্রতি ১২ বছরে মাত্র একবার। কিন্তু কয়েকটি প্রজাতির ক্ষেত্রে এর ভিন্নতাও দেখা যায়। কয়েকটি প্রজাতির বেলায় এই ফুল ফুটতে ১৬ বছরও সময় লেগে যায়। ১২ বছর পর পর এই ফুল ফুটলেও ওই বছরের যেকোনো সময়ই কিন্তু এই ফুলের দেখা পাওয়া যায়। বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় একবার মাত্র নীলকুরিঞ্জি ফুল ফোটে। সাধারণত জুলাই থেকে ডিসেম্বর হলো এই ফুল ফোটার আদর্শ সময়।পিক সিজন হলো আগস্ট থেকে অক্টোবর।