
ভারতের সেভেন সিস্টার্স খ্যাত পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যের একটি হলো মিজোরাম।
রাজ্যটির উত্তরে আসাম ও মণিপুর, পূর্বে ও দক্ষিণে মিয়ানমার, পশ্চিমে
বাংলাদেশ ও ভারতের ত্রিপুরা। এটি একটি স্থল বেষ্টিত রাজ্য। এর আয়তন ২১,০৮৭ বর্গকিলোমিটার। আসামের সাথে এর ১৬৪ কিলোমিটার, ত্রিপুরার
সাথে ৯০ কিলোমিটার, মণিপুরের সাথে ৯৫ কিলোমিটার, মিয়ানমারের সাথে ৪০৪ কিলোমিটার এবং বাংলাদেশের সাথে ৩১৮ কিলোমিটার স্থল
সীমানা রয়েছে। ভারতের ২০১১ সালের আদম শুমারি অনুযায়ী মিজোরামের জনসংখ্যা ১০,৯১,০১৪ জন। রাজ্যটির জনসংখ্যার ৮৭ ভাগ খ্রিষ্টান,
৮ ভাগ বৌদ্ধ, ৩ ভাগ হিন্দু ও ২ ভাগ মুসলিম।
শিক্ষার হার ৯২ শতাংশ। ব্রিটিশ ভারতে মিশনারিদের তৎপরতায় মিজোরা খ্রিষ্টান ধর্মের
প্রতি আকৃষ্ট হয়। এ সময় থেকে মিজোদের মধ্যে শিক্ষার হার বাড়তে থাকে।
মিজোরাম একসময় দুর্গম পাহাড়ি এলাকা হিসেবেই বিবেচিত হতো। এ অঞ্চলের মোঙ্গলীয়
মহা জাতিসত্তার আদিবাসী ‘মিজো’ থেকে অঞ্চলের নাম হয়েছে
মিজোরাম। ভারতবর্ষে প্রথম যে মিজোরা প্রবেশ করেছিল তাদেরকে কুকি বলা হয়। ভারতে
প্রবেশকারী এ জাতি গোষ্ঠীর দ্বিতীয় দলকে নব্য কুকি নামে অভিহিত করা হয়। আর এ
জাতিসত্তার সর্বশেষ যে দলটি ভারতে প্রবেশ করেছিল তাদেরকে অভিহিত করা হয় লুসাই
নামে। কুকি, নব্য কুকি এবং লুসাইদের সম্মিলিত নাম হলো মিজো।
মিজোরামের তাপমাত্রা শীতকালে ১১-২১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে। গ্রীষ্মকালে
তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি অবধি ওঠে। মিজোরাম রাজ্যটি আটটি জেলায় ও ২৩টি মহকুমায়
বিভাজিত। জেলাগুলো হলো মামিত, কোলাশিব, আইজল, চম্ফাই,
সেরাছিপ, লুঙ্গলেই, লাওঙ্টলাই
এবং সাহা।
মিজোরামের প্রাদেশিক ভাষার নাম মিজো। মিজোরামের অধিকাংশ মানুষ এ ভাষায় কথা
বলে। এ ভাষার সাথে হমার, মারা, লাই, পাইতে, গ্যাঙটে ইত্যাদি আঞ্চলিক ভাষার মিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়। এ ভাষার কোনো
বর্ণমালা ছিল না। খ্রিষ্টান মিশনারিরা মিজো বর্ণমালার উদ্ভাবন ঘটিয়েছে। ভাষাটির
মূল বর্ণগুলো রোমান বর্ণমালা থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। এ ভাষায় ব্যবহৃত বর্ণমালায় মোট
২৫টি বর্ণ রয়েছে। এ ভাষার মানুষ মিজোরাম ছাড়াও মিয়ানমার এবং বাংলাদেশে রয়েছে।
বাংলাদেশের মিজো ভাষার মানুষ বাংলা বর্ণমালা ব্যবহার করে।
মিজোরামের রাজধানী আইজল। শহরটি অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর। পাহাড়কে অক্ষত রেখে কিভাবে শহর হয় তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আইজল। রাতের আইজল যেন এক স্বপ্নপুরী। পাহাড়ের কোলঘেষে গড়ে ওঠা বসতবাড়ির বিদ্যুৎ বাতিগুলোকে দূর থেকে জোনাকীর মতো মনে হয়। আইজলের পাহাড়ের খাজে খাজে রয়েছে সড়ক। সড়কগুলো ২০-২৫ ফুট প্রশস্ত। সড়কের দু’ধারে ৫-৬ ফুট পরিধির পায়ে হাঁটার পথ রয়েছে। নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের কারণে সড়ক ও হাঁটার পথে পৃথিবীর উন্নত দেশের ন্যায় ভাঙাচোরা লক্ষ করা যায় না। শহরে বসবাসরত মানুষের অধিকাংশেরই নিজস্ব বাহন রয়েছে। শহরে বসবাসরত লোকজনের বেশভূষা চলনে-বলনে রয়েছে পাশ্চাত্যের ছাপ।
ব্যবসা বাণিজ্য
পরিচালনার ক্ষেত্রে পুরুষদের চেয়ে নারীদের অধিক সক্রিয় দেখা যায়। আইজলে বসবাসরত
মানুষের ৯০ শতাংশের অধিক খ্রিষ্টান হওয়ায় শহরটির সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে অসংখ্য
গির্জা রয়েছে। আর এ কারণে এ শহরটিকে গির্জার শহরও বলা হয়। আইজলের প্রাণকেন্দ্রে
একটি মসজিদও রয়েছে। মসজিদের সন্নিকটে মুসলিম ব্যবসায়ীদের কিছু দোকান রয়েছে। শহরের
প্রাণকেন্দ্র থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে রয়েছে বিমানবন্দর। কোলকাতা থেকে সরাসরি
বিমানে আইজল যাওয়া যায়। এছাড়া আগরতলা থেকে আইজলের বিমান যোগাযোগ বিদ্যমান রয়েছে।
মিজোরামের যে শহরগুলো পর্যটকদের আকর্ষণ করে এর অন্যতম হলো রেইক। রেইক আইজল হতে
৩০ কিলোমিটার দূরে মামিত জেলায় অবস্থিত। রেইকে যাওয়ার পথে পড়ে মিজোরামের প্রধান
নদী খোয়াথল্যাংতুইপুই যা কর্ণফুলী নামেও পরিচিত। নদীটির উৎসমুখ মামিত জেলার শৈতা
গ্রামে অবস্থিত। এটি বাংলাদেশের সীমান্ত বরাবর দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে তলাবং এর কাছে
বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। আইজল হতে রেইক যাওয়ার পুরো পথটি ঝর্ণাধারার মধ্যে ঘন সবুজ
বনাঞ্চল আবৃত। পাহাড়ের ওপর সুউচ্চ নীল আকাশ আর প্রান্তরের সবুজের মিশ্রণে যে
অপূর্ব নৈসর্গিক দৃশ্যের দেখা মিলে এটি এ ধরায় বিরল। রেইক ভ্রমণের সবচেয়ে ভালো সময়
এপ্রিল মাস। এ মাসটিতে এখানে স্থানীয় প্রিয় ফুলের নামে হয় আন্তরিয়াম উৎসব। এ উৎসবে
স্থানীয় জনগোষ্ঠীর প্রস্তুতকৃত সামগ্রীর সমাহার ঘটে। উৎসবকে ঘিরে লোকগীতি ও নৃত্য
পরিবেশনার মাধ্যমে দেশজ শিল্প সংস্কৃতি তুলে ধরা হয়।
পর্যটনের দিক হতে মুইফাং মিজোরামের জনপ্রিয় একটি পার্বত্য শহর। আইজল হতে
মুইফাং এর দূরত্ব ৫০ কিলোমিটার। রেইক থেকে আইজল হয়ে মুইফাং যাওয়া যায়। মুইফাং
যাওয়ার পথে পড়ে সবুজ গালিচায় আচ্ছাদিত উঁচু-নিচু প্রান্তর। মুইফাং এর চতুর্দিকে
রয়েছে পাহাড়। পাহাড়গুলোর অরণ্যের অনেকাংশেই এখনো মানুষের পদচিহ্ন পড়েনি। বিক্ষিপ্ত
জনবসতির মানুষজন এলাকায় আগত পর্যটকদের সাথে ভাব বিনিময় করতে চাইলেও ভাষা সমস্যার
কারণে তা সম্ভব হয় না।
পর্যটনের দৃষ্টিকোণ হতে অপর গুরুত্বপূর্ণ শহর হলো চম্ফাই। মুইফাং হতে চম্ফাই
যাওয়ার পথে মিজো বয়নশিল্পের কেন্দ্র থানজোয়ালের দেখা মিলে। এখানে প্রতিটি ঘরে
উজ্জ্বল রং এর মিজো পোশাক, চাদর, ব্যাগ প্রভৃতি প্রস্তুত হয়। চম্ফাই শহরের
সন্নিকটে রয়েছে মিজোরামের সর্ববৃহৎ ভেন্টাং জলপ্রপাত। চম্ফাই শহরটি পাহাড় দিয়ে
ঘেরা একটি উপত্যকা। মিজোরামের সর্বাধিক সমতল ভূমি রয়েছে এ উপত্যকায়। মিজোদের
প্রধান খাদ্য ভাত। চম্ফাই উপত্যকায় যে ধানের চাষ হয় তা সমগ্র মিজোরামের চালের
জোগান দেয়।
আসামের গুয়াহাটি থেকে সড়ক পথে মিজোরাম যাওয়া যায়। আবার মেঘালয়ের জোওয়াই হয়ে
শিল চর দিয়েও সড়ক পথে মিজোরাম যাওয়া যায়। বাংলাদেশীরা জাফলং হতে ভারতের ডাউকি হয়ে
জোয়াই অতিক্রম করে মিজোরামে যেতে পারেন। মিজোরাম সম্প্রতি রাজ্যটির শিলসুরি এবং
বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকার সাজেকে একটি বর্ডার হাট স্থাপনের প্রস্তাব দিয়েছে।
মিজোরামের প্রস্তাবে বাংলাদেশ নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে। বর্ডার হাটটি বাস্তবায়ন করা
হলে উভয় দেশের মধ্যে পণ্য বিনিময় উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক, নির্মাণ সামগ্রী, প্লাস্টিক ও খাদ্যপণ্যের বিপুল চাহিদা রয়েছে মিজোরামে। এর বিনিময়ে
বাংলাদেশ মিজোরাম হতে পাথর, হলুদ, আদা,
মরিচ, বাঁশ প্রভৃতি আমদানি করতে পারে। লুসাই
পাহাড়ের অবস্থান মিজোরামে। কর্ণফুলী নদী লুসাই পাহাড় হতে উৎপত্তি হয়ে বাংলাদেশের
চট্টগ্রামের মধ্য দিয়ে সাগরে পতিত হয়েছে। এ কর্ণফুলী নদীর তীরেই বাংলাদেশের
সর্ববৃহৎ চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর অবস্থিত। কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ দিয়েই বাংলাদেশের
একমাত্র জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র কাপ্তাই এ স্থাপিত হয়েছে।
ব্রিটিশ শাসনামলে মিজোরাম লুসাই পাহাড় নামে অভিহিত ছিল। সে সময় এটি আসামের অংশ
ছিল। ১৯৭২ সালে মিজোরাম কেন্দ্রীয় শাসিত অঞ্চল হিসেবে আসাম হতে আলাদা হয়। অতঃপর
দিল্লি এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী এমএনএফের (মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট) মধ্যে সম্পাদিত
চুক্তির মাধ্যমে মিজোরাম আলাদা রাজ্যের মর্যাদা পায়। এমএনএফ ভারতের বিরুদ্ধে টানা
২০ বছর গেরিলা অভিযান চালিয়েছিল। গেরিলা যুদ্ধের নেতৃত্বে ছিলেন মিজোদের জাতীয়
নেতা লালডেঙ্গা। ভারতের সাথে আপস-রফার পর লালডেঙ্গা মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী
নির্বাচিত হয়েছিলেন। আইজল শহরের কেন্দ্রস্থলে লালডেঙ্গার আবক্ষ মূর্তি স্থাপন করা
হয়েছে।
১৩ লাখ জনগোষ্ঠীর পাহাড়ি রাজ্য মিজোরামের সাথে ভারতের বাকি অংশের সংযোগ যে
মহাসড়কটির মাধ্যমে স্থাপিত হয়েছে তা আসামে অবস্থিত। ভারতের মূল ভূখণ্ড হতে পশ্চিম
বাংলা হয়ে আসামের মাধ্যমে মিজোরামের সাথে সড়ক পথে যোগাযোগের ব্যবস্থা অত্যন্ত
দুর্গম, ব্যয়বহুল ও
সময়সাপেক্ষ। আর এ কারণেই মূল ভারত হতে পশ্চিম বাংলা ও আসাম হয়ে মিজোরামে যেকোনো
পণ্য পরিবহন করতে হলে তা সাধারণ মানুষের জন্য ব্যয়বহুল হয়ে ওঠে। মিজোরামের রাজ্য
সরকার দীর্ঘদিন যাবৎ এ সমস্যাটি হতে উত্তরণের জন্য রাজ্যটির নিকটতম প্রতিবেশী
বাংলাদেশের সাথে বাণিজ্য বৃদ্ধিতে আগ্রহ প্রকাশ করে আসছে। কিন্তু ভারতের কেন্দ্রীয়
সরকারের অনাগ্রহে তা বাস্তবায়নে বিভিন্ন সমস্যার উদ্ভব হয়েছে। মিজোরামের রাজ্য
সরকার ও সাধারণ মানুষ মনে করে বাংলাদেশের সাথে বাণিজ্যের সম্প্রসারণ করা গেলে
রাজ্যটি ব্যাপকভাবে উপকৃত হবে এবং রাজ্যের মানুষের ভাগ্যোন্নয়ন ঘটবে।
মিজোরামের শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে ভারতের মূল ভূখণ্ডের
বিভিন্ন রাজ্যে অধ্যয়ন করতে হলে তাদের জন্য যাতায়াত ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ হওয়ায়
তারা তাদের প্রতিবেশী বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় এবং
কারিগরি, প্রকৌশল ও প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা গ্রহণে
আগ্রহী। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও কেন্দ্রীয় সরকারের অসহযোগিতা তাদের উচ্চশিক্ষার পথকে
রুদ্ধ করে দিচ্ছে।
মিজোরামের সাধারণ মানুষ মনে করে তারা ভারতের মূল ভূখণ্ডের জনগোষ্ঠী হতে ধর্ম, ভাষা, কৃষ্টি
ও সংস্কৃতির দিক হতে সম্পূর্ণরূপে স্বতন্ত্র। আর এ কারণেই তারা উপেক্ষিত, অবহেলিত এবং অনগ্রসর। দীর্ঘদিনের উপেক্ষা ও অবহেলার কারণে তাদের মধ্যে যে
ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে তারা এর দ্রুত উপসম চায়। অন্যথায় তারা মনে করে তাদের
রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথ তাদের নিজেদেরই বেছে নিতে হবে।