মাজহারুল ইসলাম মাসুম, সিনিয়র সাংবাদিক লেখক ও গবেষক :
পৃথিবীর প্রত্যেক সন্তানের প্রথম শিক্ষক হচ্ছেন তার মা | খুব উচ্চ শিক্ষিত, স্বল্প শিক্ষিত হবার প্রয়োজন নেই, স্বশিক্ষিত হবারও প্রয়োজন নেই | যখন একজন মা সন্তান জন্ম দেন তখন তার মধ্যে জন্ম নেয় কালজয়ী এক শিক্ষক | যে শিক্ষকের তথাকথিত পৃথিবীর মতো কোনো স্কুল নেই, বড় বড় জ্ঞানগর্ভ বই নেই, মা নিজেই যেন শিক্ষার আলোকবর্তিকা হয়ে উঠেন | মা এমন একজন শিক্ষক যিনি এসবের বিনিময়ে কোনো বেতন নেননা, কোনো ধরণের সুযোগ সুবিধা নেননা, কেবল দিয়েই যান | তিল তিল করে নিজেকে কেবল ত্যাগ করে যান, ভালোবাসার পরশ বুলিয়ে যান | মা এমন একজন নিঃস্বার্থ শিক্ষক যিনি সন্তানের মঙ্গলের জন্য নিজের জীবনও উৎসর্গ করতে পারেন |
মমতাময়ী মাও তো একজন শিক্ষক। সেটা আমরা হয়তো বুঝতে পারিনা। তবে সময় আমাদের তা বুঝিয়ে দেয়। একটা ঘটনায় বিষয়টি অনেক সহজবোধ্য হয়ে যাবে। বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসনের তখন শিশুকাল। এক দিন এডিসন ঘরে এসে তার মাকে খামবন্দি চিঠি দিলেন। তিনি মাকে বললেন, ‘আমার শিক্ষক আমাকে কাগজটি দিয়েছেন এবং শুধু তোমাকেই দিতে বলেছেন।’ মা চিঠিটি জোরে পড়া শুরু করলেন এবং তার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে মাটিতে, ‘আপনার পুত্র মেধাবী। এই স্কুলটি তার জন্য অনেক ছোট এবং এখানে তাকে শেখানোর মতো যথেষ্ট প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও দক্ষ শিক্ষক নেই। দয়া করে আপনি নিজেই তার শিক্ষার ব্যবস্থা করুন।’ তার মা মারা যাওয়ার অনেক বছর পরের কথা। এডিসন তখন শতাব্দীর সেরা আবিষ্কারক। এক দিন তাঁর পারিবারিক পুরনো জিনিসপত্র দেখছিলেন। একটি ডেস্কের ড্রয়ারের কোনায় হঠাৎ তিনি একটি ভাঁজ করা কাগজ পেলেন। তিনি সেটি খুললেন। কাগজে লেখা ছিল—‘আপনার সন্তান মেধাহীন ও নিম্ন বুদ্ধিসম্পন্ন। আমরা তাকে আমাদের স্কুলে আর আসতে দিতে পারি না।’ এডিসন কয়েক ঘণ্টা ধরে কাঁদলেন। কারণ এডিসন বুঝতে পারলেন তার মা সেদিন বড় কিছু ভাবেননি। বরং তার চিন্তাশক্তি প্রয়োগ করে ভেবেছেন কিভাবে একটা নেতিবাচক ধারণাকে ইতিবাচক ধারণায় পরিণত করা যায়। তিনি টমাস আলভা এডিসনকে গড়ার আগেই ভেঙে যেতে দেননি বরং তার মধ্যে এই ধারণা সৃষ্টি করেছিলেন যে তার মতো মেধাবী পৃথিবীতে আর কেউ নেই। কয়েকটি শব্দের ইতিবাচক পরিবর্তন এডিসনের জীবন পাল্টে দিয়েছিল। এখানে এডিসনের মা একজন শিক্ষকের মতো কাজ করেছেন। কিন্তু তা স্কুলের শিক্ষকরা তা পারেননি।
প্রতিদিন এমন মায়ের মতো ভালোবাসার বন্ধনে জড়িয়ে ধরা নিঃস্বার্থ শিক্ষকদের খুঁজি। সেই প্রাণপ্রিয় মুখগুলিকে খুঁজি। কিন্তু কোথায় তারা। তারা তো আকাশের তারা হয়ে গেছে। সে তারা এখনও রাতে আলোর মশাল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আমাদের আলোকিত পথ দেখানোর অপেক্ষা করে। কিন্তু আমরা তো স্বার্থপর হয়ে গেছি। সবাই আর শিক্ষক নেই, কেউ কেউ শিক্ষক। এক দুষ্টচক্রে বাধা পড়ে গেছে শিক্ষকদের প্রকৃত সত্তা। শিক্ষকতা পেশা নয়, এটা একটা আত্মত্যাগ। এটা একটা সেবা। কিন্তু কে শুনবে কার কথা। ছাত্রদের মুখগুলো দেখে কষ্ট লাগে। ওরা ওদের প্রতিভার আলো ছড়িয়ে আলোকিত হতে চায়। কিন্তু শিক্ষক নামের সেই নিঃস্বার্থ মানুষটা তো আর নেই। সব যেন দুঃস্বপ্ন, সব যেন গন্তব্যহীন।