গোবিন্দ শীল, সিনিয়র সাংবাদিক ও কলাম লেখক ঃ
লক্ষ লক্ষ বছর আগে প্রাকৃতিক পরিবেশে বেঁচে থাকার জন্য মানব মস্তিষ্ক বেশ কয়েক ধরণের শর্টকাট ব্যবহার করতো । এই যুগে মনোবিজ্ঞানীরা সেসব শর্টকাট কে মনের পক্ষপাতিত্ব বা ঝোঁক বলছেন এবং সেই সাথে এসব প্রবণতা থেকে বের হবার উপদেশ দিচ্ছেন । এসব পক্ষপাতিত্বের মূল্য সে সময় অনেক বেশি ছিল কারণ সেখানে জীবণ-মরণের প্রশ্ন জড়িত ছিল এবং সেগুলো আমাদের অবচেতন মনের অংশ হয়ে আছে । যেমন, কোন হিংস্র পশু দেখলে সাথে সাথে তাকে আক্রমণ করা অথবা পালিয়ে যাওয়া । পরবর্তীতে যে কোন তথ্য বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে মস্তিষ্ক পূর্ববর্তী ঐ সব অভিজ্ঞতার সহায়তা নেয়া শুরু করে । সমস্যাটা শুরু এখান থেকে । এখন রাস্তায় সন্ধার অন্ধকারে কাউকে দেখলে মন সাথে সাথে বোঝার চেষ্টা করে লোকটি ক্ষতিকর কিনা, অথবা সুন্দর পোষাক পরিহিত কাউকে দেখলে মন ভাবতে পারে লোকটির মননও নিশ্চয় সুন্দর । এসব পক্ষপাতিত্বের মূল কথা হলো ব্যক্তিমাত্রই নিজের সিদ্ধান্তকে সঠিক মনে করে, যদিও অনেক সময় সেটি ভুলও হতে পারে । আমাদের মনের কয়েকটি পক্ষপাতিত্ব হলোঃ Confirmation Bias, Self-serving Bias (নিজের স্বার্থের অনুকূলে পক্ষপাতিত্ব), Anchoring Bias, survivorship bias, actor-observer bias ইত্যাদি । এরমধ্যে Self-serving Bias হলো আমাদের ইগো মনের পক্ষ নেয়া । এটি আমরা সবাই করে থাকি । যে কোন পরিস্থিতিতে আমরা নিজেদের পক্ষে কথা বলি, যদিও অনেক সময় সেটি বিজ্ঞান নির্ভর হয় না । Survivorship Bias হলো আমরা কারও সফলতাকে অনুসরণ করার চেষ্টা করি । যেমন, কেউ চিংড়ী মাছ চাষ করে সফল হলে আরেকজন আরেকটি চিংড়ী ঘের করার চেষ্টা করে । Actor-Observer Bias হলো আমরা নিজেদের ব্যর্থতার জন্য অন্যদেরকে দায়ী করি আর অন্যদের ব্যর্থতাকে তাদের নিজেদের কারণে হয়েছে বলে মনে করি । মানব মস্তিষ্ক খুব অল্প সময়ের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে অর্থবহ একটি ছাঁচ (Meaningful pattern) খোঁজে । পরবর্তীতে এটি অবচেতন মনের অংশ হয়ে যায় এবং মন সেখান থেকে সিদ্ধান্ত দিতে থাকে । মানব মনের আরেকটি অবৈজ্ঞানিক বিষয় হলো, তার সমুদয় স্মৃতিটাই পক্ষপাতে দুষ্ট । অর্থাৎ, আমরা আমাদের বিশ্বাসের পক্ষ নিয়ে তথ্য অনুসন্ধান করি । অতীতে করিম একটি বোমা ফুটিয়ে থাকলে, কোন বোমা ফুটলেই আমরা ধরে নেই করিমই এটি ফুটিয়েছে (confirmation bias) । এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে বিশেষত মধ্যপ্রাচ্য ও পাশ্চাত্য রাজনীতিতে খুব সাধারণ একটি বিষয় । একই ভাবে পাশ্চাত্যে ও প্রাচ্যের রাজনীতিবিদেরা Anchoring Bias কে তাঁদের পক্ষে ব্যবহারের চেষ্টা করেন । এটি হলো, ধরুন যুদ্ধে ২,০০০ লোক মারা গেছেন। সরকার বিষয়টি সবচেয়ে আগে জানবেন সেটিই স্বাভাবিক । তাই সরকার জনগণের দৃষ্টি ফেরানোর জন্য আগেই ঘোষণা দিয়ে দেন : এ পর্যন্ত যুদ্ধে ২০০ জন নিহত হয়েছেন । আমরাও ব্যক্তিগত জীবনে, চাকুরির ক্ষেত্রে কোন সমস্যা হলো বসকে আগে রিপোর্ট করতে চাই । যে আগে রিপোর্ট করে সে কিছুটা ভাল অবস্থানে থাকে, যদিও দোষটা হয়তো তারই । আমাদের দেশেও সরকারেরা এই এঙ্করিং বায়াসকে কাজে লাগায় । পোষাক কারখানায় বড় ধরণের ঘটনাকে সরকার ছোট করে দেখানোর চেষ্টা করে । আমাদের মনের ছাঁচ/পক্ষপাতকে ব্যবহার করে আমরা অন্যের সহানুভূতি পাবার চেষ্টা করি অথবা পাল্টাপাল্টি আক্রমণকে বৈধতা দেই । প্যালেষ্টাইন সামান্য ঘটনা ঘটালে ইজ্রায়েল অনেক বড় আকারে প্রতিশোধ নেয়, এটি আমরা প্রায়ই দেখে থাকি । আমাদের মনের আরও অনেক ধরণের পক্ষপাত আছে । ধর্ম, জাতি,দেশ নিয়ে আলোচনা করার সময় আমরা আমাদের মনের পক্ষপাতকে গুরুত্ব দেই । মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন মনকে সব সময় খোলামেলা ও বিজ্ঞান নির্ভর রাখতে হবে । তবেই একটি সমাজ অগ্রসর হতে পারবে ।