স্বাধীনতার লাভের ১৩১৪ দিন পর মর্মান্তিক ভাবে আমরা জাতির পিতা কে হারিয়েছিলাম। জাতি দিশেহারা হয়েছিল।
বৈপরীত্যের ধারাবাহিকতায় প্রায় ২৭ বছর এদেশের মুক্তি পাগল মানুষকে ভ্রান্ত পথে শান্ত ক্লান্ত পথ চলতে হয়েছে।
মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবার-পরিজন এই সময়ে চেতনা পৃষ্ঠ, ক্ষুধা ক্লিষ্ট, অস্তিত্ব বিপন্নতার সংকটকে ধারণ করে বেঁচে থাকার প্রাণান্ত চেষ্টা নিয়েছে।
সম্মান, গৌরব, অহংকার তাদের স্পর্শ করেনি।
রাজাকার, আল বদর, আল শামস, দুর্বৃত্ত পান্ডাদের রিকশা টানা, দিনমজুরি করা, উচ্ছিষ্ট ভক্ষণ-গ্রহণ তখন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অতি সাধারণ ঘটনা হিসেবে প্রচলিত ছিল।
তখনও দেশে সমাজ ছিল, সংস্কৃতি ছিল, সভ্যতা ছিল, মানবতা ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা অপরাধী হয়ে, উচ্ছিষ্ট হয়ে সমাজে অপাঙ্কতেয় ছিল।
যৌবন যাদের মুক্তিযুদ্ধের তাড়নায় তাড়িত করে জীবনের বিপরীতে দেশ ভাবনায় সিক্ত করেছিল, আগুনমুখী পতঙ্গের মতো যারা মহান মুক্তিযুদ্ধে দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, জীবন দিয়েছিল তারাই হয়ে গিয়েছিল এদেশের উচ্ছিষ্ট।
তখনও দেশের সাহিত্য রচনা হতো, কবিতা লেখা হতো, গল্পপাঠ হতো, সভ্য দুনিয়ার সুশীল অনেক কাজ ধারাবাহিকভাবে চলত।
সদ্য স্বাধীন দেশে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের মঞ্চায়ন ঘটানো হয়েছিল। স্বাধীনতার শুভাকাঙ্ক্ষী বন্ধুদের সংখ্যা অনেক কম ছিল। যদিও বঙ্গবন্ধুর আমলেই ১৪০ টি দেশের স্বীকৃতি অর্জিত হয়েছিল।
৭৫ এর পর মুক্তিযোদ্ধাদের পাখি মারার মত ফাঁসিতে ঝুলানো হয়েছিল।
মুক্তিযোদ্ধা বাদ দিয়ে ১৯৭৩ সালে শত্রু দেশ পাকিস্তান ফেরত এরশাদের মত বিতর্কিত মানুষ এদেশের সেনাবাহিনী প্রধান হয়েছিল। তখনো এদেশে মেধা ছিল, সুজন ছিল, সখি ছিল।
জাতিসংঘে পাকিস্তানের হয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিপরীতে সাক্ষী দেয়া ব্যক্তিকে প্রধানমন্ত্রী করা হয়েছিল।
ক্ষুধার্ত, আবাসনহীন নিঃস্ব মুক্তিযোদ্ধাদের তা দেখতে হয়েছিল, হজম করতে হয়েছিল এবং মেনেও চলতে হয়েছিল।
এভাবে বীর মুক্তিযোদ্ধারা আর্থিক, সামাজিক, নৈতিক, পারিপার্শ্বিক যাতাকলে নিশ্চিহ্ন হওয়ার দিকে দ্রুত ধাবিত হচ্ছিল। নৈতিকতা হারিয়ে ফেলেছিল।
হাজার বৈপরীত্যকে অতিক্রম করে অবশেষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কন্যাকে এদেশের মানুষ ক্ষমতায় বসালো। অবশিষ্ট দিশেহারা মুক্তিযোদ্ধারা নতুন করে জীবনকে উপলব্ধি, উপভোগ করার প্রয়াস পেতে শুরু করল। ততদিনে তারা বয়সের শেষ প্রান্তে।
মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সরকারের সাধ্যমত সম্মানী ভাতার ব্যবস্থা করা হলো। ক্রমান্বয়ে তা বৃদ্ধি করা হলো।
মুক্তিযোদ্ধারা ভুলেই গিয়েছিল, তাদের মহান ত্যাগের অর্জন- উপহার এই বাংলাদেশ তাদের অস্তিত্বের একমাত্র ঠিকানা।
বঙ্গবন্ধু কন্যা ধাপে ধাপে মুক্তিযোদ্ধাদের আবাসন সহ অন্যান্য নৈতিক, সামাজিক, বৈষয়িক সুযোগ-সুবিধা দিতে মনোনিবেশ করলেন।
বঙ্গবন্ধুর ভাষায়, 'পরশ্রীকাতরতা এবং বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের রক্তের মধ্যে রয়েছে।.. পরের শ্রী দেখে যে কাতর হয় তাকে 'পরশ্রীকাতর' বলে। এক শ্রেণীর বাঙালির বিশেষ চরিত্র এটি। নির্লিপ্ত সুবিধাভোগী বাঙালি পরশ্রীকাতরতায় সিক্ত-তিক্ত, ক্ষুব্ধ হতে থাকল।
তাদের ক্ষোভ, অহংকার, অপচিন্তা সমাজে বিষবাস্পের মত ছড়াতে থাকল ।
মুক্তিযোদ্ধার অবশিষ্ট যা থাকল, তারা অস্তিতে নির্ভরতা খুঁজে পেতে থাকল। ততদিনে তারা বার্ধক্যের দুই সীমানায়।
বঙ্গবন্ধু কন্যা আকাঙ্ক্ষার চাইতেও বেশি করে তাদের দিকে মনোযোগ দিলেন।
সরকার প্রধানের এই মনোযোগ প্রতিহিংসা পরায়নতায় পর্যবসিত হতে থাকল।
কথিত ইন্টেলেকচুয়ালরা কলম খুলে বসল। তথ্য দিতে থাকল। তাত্ত্বিক কথা বলতে থাকল।
বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রশাসনিক অনিয়ম ও দুর্বলতার সুযোগে তারা অনেকেই মুক্তিযোদ্ধা বনে যেতে থাকল।
সময় ও সুযোগ বুঝে সচকিত, উচ্ছ্বসিত হওয়া অথবা নীরবতা তাদের চরিত্রের অংশ।
দীর্ঘদিন যোদ্ধাপরাধীদের প্রজন্মের নিরাপদ বিনিয়োগ অর্থ, সম্পদ, ব্যাংক- বীমা, আবাসন তাদের সমৃদ্ধিকে মজবুত ভিত্তি দিতে থাকল।
একদিকে অশিক্ষিত ,অর্ধশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের প্রজন্ম, অন্যদিকে ধূর্ত সবাইকে আঁকড়ে ধরা, অনেকটা দূরদর্শী স্বাধীনতার ভ্রান্ত প্রজন্ম, পাকিস্তান ফেরত সৈনিকদের বংশধর, রাজাকার আল বদর, আল শামস, মুসলিম লিগার, জামাতে ইসলামীদের প্রজন্ম প্রতিবেশে, সমাজের সকল স্তরে মজবুত ভিত্তি গড়ে তুলেছে ইতিমধ্যেই।
সরকার ইতিমধ্যেই মুক্তিযোদ্ধাদের 'বীর মুক্তিযোদ্ধা' সম্বোধনের প্রজ্ঞাপন জারি করল এবং রাষ্ট্রীয় ভাবনাচিন্তায় তাদের প্রজন্মকে সম্পৃক্ত করার প্রয়াস গ্রহণ করল।
এখানেও হাইবিডাইজেশন আশ্রয় নিল। শিক্ষিত একটি শ্রেণি সুযোগ গ্রহণ করে রাতারাতি মুক্তিযোদ্ধার রূপ ধারণ করল। সনদের অধিকারী হল। প্রজন্মকে দুহাতে সুবিধা দেয়ার প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত হল।
মন্ত্রী মিনিস্টার, আমলা- কামলা, বণিক- ব্যবসায়ী, আস্তিক- নাস্তিক, বাম-রাম- ডান, বিপরীত রাজনীতির প্রতিনিধিরা- কেউই বাদ থাকল না।
সরকারিভাবে কোন এক সময় ঘোষণা আসলো মুক্তিযোদ্ধার সন্তানসহ নাতি নাতনিদের বিভিন্ন প্রকার সুযোগ সুবিধা প্রদানের।
এটা ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যয়ের, প্রতিদান। রক্তের মূল্য দেওয়ার প্রচেষ্টা। শ্রমের মর্যাদা দেয়ার প্রক্রিয়া। মুক্তিযুদ্ধের অস্তিত্বকে মুক্তিযোদ্ধার প্রজন্মের মাধ্যমে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা।
আসল মুক্তিযোদ্ধারা নকল মুক্তিযোদ্ধাদের ভীরে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে গেল।
কোন ভূখণ্ডের মুক্তির সৈনিকদের অর্থ দিয়ে সম্মান দিয়ে পরিপূর্ণ মূল্যায়ন করা যায় না। জাতির সকল অংশকে তাদের প্রতি নিঃশর্ত কৃতজ্ঞ থাকতে হয়। এই থাকার মধ্য দিয়েই তাদের প্রতি যথার্থ সম্মান প্রদর্শনে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হয়। ঋণ সুদের প্রচেষ্টা নিতে হয়।
মুক্তিযুদ্ধের সরকার সেই ঐতিহাসিক প্রচেষ্টা চালাতে চেষ্টা করেছে।
আমাদের কতিপয় জ্ঞানপাপী সারা দুনিয়ার উদাহরণ খোঁজার চেষ্টা করে কেতাব খুলে, তত্ত্ব তথ্য খুঁজে জ্ঞানের ভ্রান্তিবিলাস দিয়ে লেখালেখি, বক্তৃতা- বিবৃতি দিয়ে চলেছে। এটি তাদের জীবন ধারণের উপায়ও বটে।
বীর মুক্তিযোদ্ধারা চাকরিতে সার্বিক সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করতে পারেনি সময়ের বৈপরীত্য এবং বয়সের কারণে। সমাজের দায়বদ্ধতা সৃষ্টি হয় তাদের প্রজন্মকে নিরাপদ এবং আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করে তোলার। যেহেতু ইতিমধ্যেই এক প্রজন্ম পিছনে ফেলে দেয়া হয়েছিল। তাই এদের সন্তান প্রজন্ম দিয়ে শুরু করলে আপনা আপনি সন্তানের সন্তান প্রজন্ম অর্থাৎ মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি নাতনির অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়।
এখানে যারা সংবিধান ঘাটে, প্রক্রিয়া খোঁজে, তারা শয়তানের দোসর। রাজাকার, আল বদর, আলশামসদের রক্তের উত্তরাধিকারী।
এদের সংকট মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি নাতনির সুবিধা নিয়ে নয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে চর্চা ও প্রবৃদ্ধি করার প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করা।
দীর্ঘ ২৭ বছর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সরকারের নির্লিপ্ততা, নীরবতা কিংবা অনাগ্রহ দৃশ্যমান ছিল। এটা ছিল পাপাচার।
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারের সর্বসাকুল্যে ২৬ বছরের প্রক্রিয়ার ফসল আজকের বই বয়োবৃদ্ধ অবশেষ মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনের ভার লাঘব করে রাষ্ট্রীয় দায় পালনের প্রচেষ্টা মাত্র।
যোদ্ধাপরাধীদের যে প্রজন্ম, পাকিস্তান ফেরতদের যে প্রজন্ম, রাজাকার, আল বদর, আল শামস, শান্তি কমিটি, শান্তি বাহিনীর যে প্রজন্ম, মুসলিম লীগ, জামাত ইসলামীসহ অন্যান্য ডান- বাম, অর্ধ, অস্তিত্বে বিতর্কিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজনৈতিক দলগুলোর যে প্রত্যয়ী প্রজন্ম, তার সাথে মুক্তিযুদ্ধের, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রজন্মের ফারাক অনন্তকালের।
বর্তমান সরকার প্রধানের চেতনায় জাগ্রত আছে, কখনও কোন মুক্তিযোদ্ধা ন্যূনতম সুযোগ সুবিধার জন্য মিছিল- মিটিং, আহাজারি, বিলাপ, উত্তাপ, লেখালেখি কিংবা আস্ফালন, উচ্ছ্বাস প্রদর্শন করেনি। কেননা তাদের সে যোগ্যতাও ছিল না। আর তারা তা জানতও না। তাদের চক্ষুলজ্জা ছিল, আছে।
এখন অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, তারা সরকারকে প্রভাবিত করে, প্রচার করে, বিভিন্ন প্রকার সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করছে। পাশাপাশি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাহীন কথিত মেধাবীদের আহাজারি, আস্ফালন, উশৃংখলতা, আন্দোলন দেখে মনে হয়, তাদের মেধার উপর কখনোই তাদের দৃঢ় আস্থা তৈরি হয়নি। সফলতার তীরে পৌঁছতে দারুন ঘাটতি আছে তাদের।
আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে ১১ নং সেক্টরে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি। ভারতের মেঘালয়ের তুরা ট্রেনিং ক্যাম্পের ৮ নাম্বার উইং এ প্রায় ৩০ দিন প্রশিক্ষণ নিয়েছি।
স্বাধীনতার পরবর্তীতে বিরতি দিয়ে লেখাপড়া করে অবশেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ সনদ নিয়েছি।
এসব কিছু করতে গিয়ে বয়সে ঘাটতি হয়েছে। আশির দশকের শেষ এবং নব্বই দশকের প্রথম দিকে বার বার বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে মৌখিক পরীক্ষায় বাদ পড়েছি।
স্পষ্ট করে বলছি, প্রিলিমিনারি , লিখিত , মনস্তাত্ত্বিক, স্বাস্থ্য এবং মৌখিক পরীক্ষা, সবগুলো ধাপ অতিক্রম করে কোটা পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে বিভিন্ন বিতর্কের মুখোমুখি হয়েছি। শেষে চিঠি পেয়েছি, আমাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য করা হয়নি। এভাবেই দশম, একাদশ, দ্বাদশ, ত্রয়োদশ বিসিএস। আর একজন মুক্তিযোদ্ধাকেও এই পরীক্ষায় আমার সাথে অংশগ্রহণের উপযুক্ত আমি দেখিনি বয়সের কারণে। দেখার সুযোগ আমার হয়নি।
অবশেষে চতুর্দশ বিসিএস পরীক্ষায় বোর্ড প্রধানের সাথে বিতর্ক করে আমাকে প্রমাণ করতে হয়েছে, আমি যোগ্য।
আমাকে সম্মান দেয়া হয়েছে উত্তীর্ণ সকল পরীক্ষার্থীর শেষে অবস্থান দিয়ে। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এটি ছিল আমার সম্মানজনক (!) প্রাপ্তি। এর ফল আমাকে ভোগ করতে হয়েছে চাকরির শেষ দিন পর্যন্ত। সবার শেষে প্রমোশন। শিক্ষা ক্যাডারে বিশেষ যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও(যা কখনোই আর কারো ছিল না) আমি আমলাতান্ত্রিকতায় এরকম অবিচারের শিকার হয়েছি।
মুক্তিযোদ্ধা কোটায় মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা বরাবরই প্রতারিত হয়ে এসেছে। পরীক্ষার সবগুলো ধাপে যারা যোগ্যতা প্রমাণ করে এসেছে , তারাও মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কিংবা পরের প্রজন্ম হওয়ার কারণে কথিত মেধাবীদের দ্বারা, একশ্রেণীর প্রশাসকদের দ্বারা তাচ্ছিল্যের শিকার হয়েছে, হচ্ছে। মেধায় পঙ্গু এইসব প্রজন্ম নিজেদের মেধাকে অস্থায় নিতে না পেরে অপপ্রচার করে এবং আন্দোলন করে। অন্যরা তেল এবং তাল দেয়।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অতন্দ্র ধারক- বাহক। মুক্তিযোদ্ধাদের তিনি ধারাবাহিকভাবে সম্মান দেখিয়ে যাচ্ছেন, সম্মান করে যাচ্ছেন। সর্বশেষ সংযোজন তার সাম্প্রতিক বক্তব্য এবং মন্তব্য।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বলেছেন, 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই হচ্ছে আমার একমাত্র লক্ষ্য। লাখো শহীদ রক্ত দিয়ে গেছেন, লাখো মা-বোন নির্যাতিত। তাদের এই অবদান ভুলে গেলে চলবে না।' দু'লাখ মা- বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে যে বাংলাদেশ, সেই বাংলাদেশের বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের ছাত্রীরা বলে, 'তারা রাজাকার। তুমি কে, আমি কে- রাজাকার, রাজাকার।'
এই স্লোগান আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সকল বিসর্জন ও অর্জনকে দারুন ভাবে আঘাত করে। ৫৩ বছরের পরের বাংলাদেশের প্রজন্ম গর্বের ইতিহাসকে ও ঐতিহ্যকে, এ দেশকে যে প্রক্রিয়া ধারণ করতে যাচ্ছে, তাকে মেধার নামে সাধারণীকরণ করা, অস্তিত্বের সাথে বেইমানি করা।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে এভাবে ভ্রান্তিতে আবৃত করছে কারা। চেতনা কি বৃদ্ধ হয়? চেতনা কি পঙ্গু হয়? চেতনা কি প্রতিবন্ধী হয়?
আমাদের মনে রাখতে হবে চেতনার বয়স নেই। চেতনা চির সবুজ, চির অম্লান, চির জাগ্রত।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বলেছেন, 'মুক্তিযোদ্ধাদের সব সময় সর্বোচ্চ সম্মান দিতে হবে। তাদের সম্মানটা সর্বোচ্চ থাকবে।' ৫৩ বছর পরে এসে সরকার প্রধানের এই বক্তব্য মুক্তিযোদ্ধাদের সকল ক্ষোভকে নিভৃত করছে বলে মুক্তিযোদ্ধারা মনে করে। এখান থেকে হয়তো একটা শ্রেণীকে বুঝে নিতে হবে মেধার গুরুত্ব সর্বোচ্চ, নাকি মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনের গুরুত্ব সর্বোচ্চ।
আহমদ ছফা বলেছিলেন, 'বুদ্ধিজীবীদের পরামর্শ নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান চললে দেশ স্বাধীন হতো না।'
আজকের কথিত মেধাবিরাই তো কালকের বুদ্ধিজীবী। বলার কি অপেক্ষায় রাখে?
প্রধানমন্ত্রী উদাত্ত কণ্ঠে বলেছেন, 'জাতির পিতার আহবানে সাড়া দিয়ে জীবনের মায়া, পরিবার- সংসার সবকিছু ছেড়ে বীর মুক্তিযোদ্ধারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। তাদের অনেকেই জীবন দিয়েছেন, পঙ্গুত্ববরণ করে শত্রুকে পরাজিত করে আমাদের বিজয় এনে দিয়েছেন। কাজেই তাদের সব সময় সর্বোচ্চ সম্মান দিতে হবে।'
তিনি আরো বলেন, দল মত নির্বিশেষে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান করতে হবে। যেন তারা গর্ব করে বলতে পারেন, 'আমি মুক্তিযোদ্ধা'। এদেশের মানুষ যুগ যুগ ধরে তাদের সম্মানটা দেবে, সেটাই আমরা চাই।'
মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের প্রজন্মের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে যারা মেধাকে সামনে এনে রাষ্ট্রের সংহতি, সম্প্রীতি, অগ্রগতি এবং সমৃদ্ধির কথা বলতে চেষ্টা করছেন, তারা মুক্তিযুদ্ধকে অসম্মান করলে, প্রজন্মকে অস্বীকার করলে তাদের ষোল আনাই মিছে হয়ে যায়।
আমরা দৃঢ়ভাবে মনে করি রাষ্ট্রের পরিচালনায় কোটাসহ অন্যান্য বিষয়গুলোর যৌক্তিক সংস্কার থাকবে। রাষ্ট্রই সেটি ভাববে। তারুণ্য দিয়ে, বিশৃঙ্খলা দিয়ে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বৈপরিত্য দিয়ে, অধিকারের নামে, উস্কানির নামে এবং বিভাজনের নামে তা প্রতিষ্ঠার পথ পরিহার করতে হবে।
আমাদের বিশ্বাস করতে হবে, একজন শেখ হাসিনা দেশ বুঝেন, মুক্তিযুদ্ধ বুঝেন, সংবিধান বুঝেন, দেশের আগামী তারুণ্য কিভাবে স্বপ্ন জয় করবে- সেটিও বুঝেন।
সুজনে কুজনে, ভিআইপি,পিআই বি কিংবা মিলার কিলার তত্ত্ব দিয়ে, প্রচারণা দিয়ে '৬৯, '৭০, '৭১ এ বিভ্রান্তি ছিল। '৭৪, '৭৫ এ ষড়যন্ত্র ছিল। পরবর্তীতে ষড়যন্ত্রকারীদের ষড়যন্ত্র- বৃক্ষ ডালপালায়, ফলে ফুলে সুশোভিত হয়েছে কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে চেতনা, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা ইতিহাস থেকে মুছে যায়নি, যাবে না কখনও।
প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইদ্রিস আলী
মুক্তিযোদ্ধা, সেক্টর- ১১
বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ অধ্যয়ন কেন্দ্র, চট্টগ্রামের প্রধান সমন্বয়ক।