বাংলাদেশের চিকিৎসা শিক্ষাব্যবস্থায় ‘অপটোমেট্রি’ একটি অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত অথচ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শাখা। অপটোমেট্রি মূলত চক্ষু ও দৃষ্টির যত্ন, রোগ নির্ণয় ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ক বিজ্ঞানভিত্তিক স্বাস্থ্য পেশা। চিকিৎসা ব্যবস্থার অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিশ্বের বহু দেশে অপটোমেট্রিস্টরা স্বীকৃত স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী হিসেবে কাজ করছেন। কিন্তু বাংলাদেশে এই পেশাটি এখনও অবহেলিত ও সুশৃঙ্খল কাঠামোবদ্ধ অবস্থানে পৌঁছাতে পারেনি।
বর্তমানে বাংলাদেশে অপটোমেট্রি শিক্ষা খুবই সীমিত আকারে পরিচালিত হচ্ছে। বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ও ইনস্টিটিউটে ‘বিএসসি ইন অপটোমেট্রি’ এবং কিছু ক্ষেত্রে ‘ডিপ্লোমা’ কোর্স চালু থাকলেও, এদের অধিকাংশ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করে না। চক্ষু চিকিৎসা বলতে এখনও অনেকেই শুধু চক্ষু বিশেষজ্ঞ (অফথালমোলজিস্ট) বা চশমার দোকানদার (অপটিশিয়ান)-কে বোঝে, অথচ এ দুটির মাঝখানে রয়েছে অপটোমেট্রিস্ট—যিনি একজন প্রশিক্ষিত চক্ষু পেশাজীবী।

অপটোমেট্রিস্টরা চোখের দৃষ্টিশক্তি পরীক্ষা, রিফ্রাকশন, কন্ট্যাক্ট লেন্স ফিটিং, লো ভিশন রিহ্যাবিলিটেশন, বায়োমাইক্রোস্কপি, টোনোমেট্রি, ফান্ডাস্কপি, কর্নিয়াল টপোগ্রাফি এবং অপটিক্যাল কেরাটোমেট্রি ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ ক্লিনিক্যাল কাজ দক্ষতার সাথে সম্পাদন করেন। কিন্তু বাংলাদেশে অপটোমেট্রিস্টদের যথাযথ কর্মপরিধি, স্বীকৃতি ও পেশাগত অধিকার এখনো অনুপস্থিত।
বাংলাদেশের একটি সরকারি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালইয়ে বিএসসি ইন অপটোমেট্রি কোর্স চালু থাকলেও এই কোর্স এর অ্যাকাডেমিক কাঠামো ও কারিকুলাম আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে তুলনামূলকভাবে দুর্বল। ভারতের AIIMS, আমেরিকার ASCO (Association of Schools and Colleges of Optometry), এবং ব্রিটেনের GOC (General Optical Council) তাদের দেশে অপটোমেট্রি কোর্সকে সর্বোচ্চ মানদণ্ডে নিয়ে গেছে। সেখানে চার বছর ব্যাচেলর প্রোগ্রামের সঙ্গে এক বছর ইন্টার্নশিপ বাধ্যতামূলক, সাথে রয়েছে নিয়মিত লাইসেন্সিং পরীক্ষা।
বাংলাদেশে মেডিকেল শিক্ষা ব্যবস্থায় অপটোমেট্রি কোর্সকে স্বাধীন একটি শাখা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অপটোমেট্রিস্টদের ‘চক্ষু সহকারী’ বা ‘চশমা পরীক্ষক’ হিসেবে দেখানো হয়, যা পেশার মর্যাদাকে অবমূল্যায়ন করে।
অপটোমেট্রি একটি লাইসেন্সভিত্তিক পেশা হওয়া উচিত। উন্নত দেশগুলোতে অপটোমেট্রিস্ট হিসেবে কাজ করতে হলে জাতীয় বা আঞ্চলিক লাইসেন্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। যেমন, আমেরিকায় NBEO (National Board of Examiners in Optometry), কানাডায় CACO, অস্ট্রেলিয়ায় OCANZ এবং ভারতে Optometry Council of India (OCI) দ্বারা নিবন্ধন পেতে হয়।
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত অপটোমেট্রিস্টদের কোনো স্বতন্ত্র রেজিস্ট্রেশন কাউন্সিল বা বোর্ড নেই। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (BMDC) বা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে অপটোমেট্রিস্টদের নিবন্ধনের ব্যবস্থা না থাকায় দেশে দক্ষ পেশাজীবীদের কর্মপরিধি অনিশ্চিত থেকে যাচ্ছে। ফলস্বরূপ, অনেক অপটোমেট্রি গ্র্যাজুয়েট প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি না পেয়ে বিদেশে উচ্চশিক্ষা বা কর্মসংস্থানের জন্য দেশ ত্যাগ করছেন।

বিশ্বের উন্নত দেশে অপটোমেট্রি একটি উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন পেশা। যেমন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ভারত, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে অপটোমেট্রিস্টরা ডাক্তার উপাধি (Doctor of Optometry) পান এবং স্বাধীনভাবে চক্ষু পরীক্ষা ও ব্যবস্থাপত্র দেওয়ার অধিকার রাখেন।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, বাংলাদেশ থেকে পাশ করা অনেক অপটোমেট্রি শিক্ষার্থী বিদেশে উচ্চশিক্ষায় গিয়ে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করে দেশে ফিরে আসেন অথবা বিদেশেই সেবা প্রদান করছেন। কিন্তু দেশে তাদের সনদের মূল্যায়ন ও কর্মপরিধি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেই বললেই চলে।
সরকারি ও বেসরকারি খাতে অপটোমেট্রিস্টদের জন্য কোনো নির্দিষ্ট বেতন কাঠামো নেই। অনেক সময় অপটোমেট্রি পেশাজীবীরা মাত্র ৮,০০০ থেকে ১৫,০০০ টাকা মাসিক বেতনে কাজ করতে বাধ্য হন। যেখানে একজন দক্ষ অপটোমেট্রিস্ট চিকিৎসা পেশায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন, সেখানে তার আর্থিক সম্মান ও নিরাপত্তা থাকা উচিত। উন্নত দেশে একজন লাইসেন্সধারী অপটোমেট্রিস্ট বার্ষিক ৫০,০০০ থেকে ১,২০,০০০ মার্কিন ডলার আয় করেন। ভারতেও অভিজ্ঞ অপটোমেট্রিস্টরা মাসে ৫০,০০০ থেকে ১,০০,০০০ রুপি পর্যন্ত আয় করে থাকেন।
প্রস্তাবিত উদ্যোগ ও করণীয়
১. স্বতন্ত্র অপটোমেট্রি কাউন্সিল গঠন: বাংলাদেশে ‘বাংলাদেশ অপটোমেট্রি কাউন্সিল’ নামে একটি স্বতন্ত্র নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা গঠন করা অত্যন্ত জরুরি। এতে পেশাজীবীদের রেজিস্ট্রেশন, লাইসেন্স প্রদান ও পেশাগত অধিকার সংরক্ষণ নিশ্চিত হবে।
২. আন্তর্জাতিক মানের কারিকুলাম চালু: বিএসসি ইন অপটোমেট্রি কোর্সকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে হবে। এর মধ্যে থাকবে গবেষণা, প্র্যাকটিক্যাল ক্লিনিক্যাল রোটেশন, কমিউনিটি অপটোমেট্রি, এবং পেডিয়াট্রিক আই কেয়ার।
৩. পেশাগত স্বীকৃতি ও বেতন কাঠামো নির্ধারণ: সরকারিভাবে অপটোমেট্রিস্টদের জন্য পেশাগত পদ ও বেতন স্কেল নির্ধারণ করতে হবে। স্বাস্থ্য ক্যাডারে অপটোমেট্রিস্ট পদ অন্তর্ভুক্ত করা সময়ের দাবি।
৪. উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা সুযোগ: দেশে অপটোমেট্রিতে মাস্টার্স ও পিএইচডি পর্যায়ের উচ্চশিক্ষা চালু করতে হবে, যাতে করে দেশীয়ভাবে গবেষণায় অবদান রাখা যায়।
৫. সচেতনতামূলক কার্যক্রম: সাধারণ জনগণের পাশাপাশি চিকিৎসক ও প্রশাসনিক মহলে অপটোমেট্রিস্টদের ভূমিকা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সেমিনার, ওয়ার্কশপ ও গণমাধ্যমে প্রচারণা চালানো জরুরি।
চোখের চিকিৎসা ব্যবস্থায় অপটোমেট্রিস্টরা একটি অপরিহার্য অংশ। বাংলাদেশে এই পেশার সম্ভাবনা বিপুল, তবে সঠিক কাঠামো, স্বীকৃতি ও সরকারি উদ্যোগের অভাবে তা পূর্ণতা পাচ্ছে না। যদি এখনই জাতীয় পর্যায়ে অপটোমেট্রিস্টদের স্বীকৃতি ও উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ না করা হয়, তাহলে এই পেশার উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে এবং দেশ অভিজ্ঞ মানবসম্পদ হারাবে।
চোখের সুরক্ষা, দৃষ্টির পরিচর্যা এবং জনস্বাস্থ্য উন্নয়নের লক্ষ্যে অপটোমেট্রি শিক্ষাকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করে একটি সুদৃঢ় কাঠামোর মধ্যে আনা এখন সময়ের দাবি।

লেখক : ডক্টর মহাম্মদ মিজানুর রহমান
অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর, ম্যানেজমেন্ট এন্ড সাইন্স ইউনিভার্সিটি , মালয়শিয়া