
রোকসানা মনোয়ার : দফায় দফায় ওষুধের দাম বৃদ্ধিতে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ছে মানুষের। ওষুধের বাড়তি দামের কারণে সংসার খরচের হিসাব নতুন করে করতে হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা
বলছেন, আন্তর্জাতিক ও দেশীয় বাজারে ডলারের মূল্য বৃদ্ধির দোহাই দিয়ে ওষুধ
কোম্পানিগুলো জোর করেই ওষুধের মূল্য বৃদ্ধি করছে এবং ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরও অনেকটা
বাধ্য হয়ে বর্ধিত দাম অনুমোদন করছে।
খুচরা
পর্যায়ে ওষুধের দাম দেখতে রাজধানীর একাধিক ফার্মেসি ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় ৭০ শতাংশ
ওষুধই বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে। বিক্রেতারা বলছেন, পাইকারি
বাজার থেকে তাদের বাড়তি দামে কিনে আনতে হচ্ছে। ফলে সেই ওষুধ কম দামে বিক্রির কোনো
সুযোগ তাদের নেই।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশের
শীর্ষ ছয়টি প্রতিষ্ঠান সম্প্রতি তাদের উৎপাদিত ২৩৪টি ওষুধের দাম বাড়িয়েছে। ১০
শতাংশ থেকে শুরু করে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে ওষুধগুলোর দাম। আরও ১০টি প্রতিষ্ঠান
তাদের ওষুধের দাম বাড়াতে অধিদপ্তরে আবেদন করেছে।
দাম বৃদ্ধির তালিকায় সবার শীর্ষে রয়েছে অপসোনিন
ফার্মা লিমিটেড, প্রতিষ্ঠানটি গত কয়েকমাসে ৫২টি ওষুধের দাম বাড়িয়েছে। ইনসেপটা
ফার্মাসিউটিক্যাস লিমিটেড ৪৭টি ওষুধের দাম বাড়িয়েছে। এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালস
লিমিটেড ৪৬টি ওষুধের দাম বাড়িয়েছে। স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড বাড়িয়েছে
৩৯টি ওষুধের দাম।
এছাড়াও
হেলথকেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড ৩৬টি ওষুধের এবং বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস
১৪টি ওষুধের দাম বাড়িয়েছে।
একমাস আগেও
ভিটামিনজাতীয় এক পাতা বেক্সট্রাম সিলভার এবং বেক্সট্রাম গোল্ড ট্যাবলেটের দাম ছিল
২৭০ টাকা, যা বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৩৬০ টাকা করে। অর্থাৎ এক পাতা ওষুধেই মাস
ব্যবধানে দাম বেড়েছে ৯০ টাকা। একমাস আগেও একটি প্রোজেস্ট ট্যাবলেটের দাম ছিল ৩০
টাকা করে, বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকা করে।
অ্যান্টিবায়োটিক সেফ-থ্রি (২৫০ মি.গ্রা.) ট্যাবলেটের দাম ছিল প্রতিটি ৩৫ টাকা করে,
যা এখন হয়েছে ৪৫ টাকা, ৪০০ মি.গ্রা. সেফ-থ্রি
ট্যাবলেটের দাম ছিল প্রতিটি ৪৫ টাকা, যা এখন হয়েছে ৫৫ টাকা,
জক্স (১০০ মি.গ্রা.) সিরাপ আগে ছিল ৩৫ টাকা, এখন
বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকায়।
বিক্রেতাদের
দেওয়া তথ্য মতে, লরিক্স ক্রিম আগে ছিল ৫৫ টাকা, বর্তমানে বিক্রি
হচ্ছে ৬০ টাকায়, অ্যান্টাসিড প্লাস ট্যাবলেট প্রতিপিস দুই
টাকা থেকে এখন হয়েছে আড়াই টাকা, জিম্যাক্স (৫০০ মি.গ্রা.)
ছিল ৩৫ টাকা পিস, বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকা করে। এজিসিন
(৫০০ মি.গ্রা) আগে বিক্রি হতো ৩৫ টাকা করে, এখন বিক্রি হচ্ছে
৪০ টাকায়, ক্যালসিয়ামের ওষুধ অস্টোক্যাল ডি একমাস আগেও বিক্রি
হয়েছে ২১০ টাকা করে, এখন বিক্রি হচ্ছে ২৪০ টাকা করে। ভিটামিন
ওষুধ নিউরো-বি ট্যাবলেট ২৪০ টাকা ছিল, এর বর্তমান দাম ৩০০
টাকা।
মধ্যবাড্ডা ডিআইটি প্রজেক্ট এলাকার একটি ফার্মেসিতে গিয়ে দেখা গেছে,
দোকানের ভেতরে সারি সারি করে ওষুধের বক্স সাজিয়ে রাখা হয়েছে। জানতে
চাইলে ওষুধ বিক্রেতা রফিকুল ইসলাম বলেন, বেশি দামে বিক্রির
আশায় বড় ব্যবসায়ীরা ওষুধের কৃত্রিম সংকট তৈরি করছেন। যে কারণে বাধ্য হয়েই আমাকে
কিছু ওষুধ কিনে এনে রেখে দিতে হয়েছে। নয়তো দু’চারদিন পর আমার ফার্মেসিতেই ওষুধগুলো পাওয়া যাবে না।
দাম বৃদ্ধি
প্রসঙ্গে তিনি বলেন,
গত দুইমাসে ইবনে সিনাসহ হাতেগোনা কয়েকটি কোম্পানি ছাড়া অন্যান্য
কোম্পানির প্রায় ৭০ শতাংশ ওষুধেরই দাম বেড়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় যে ওষুধগুলো আছে,
সেগুলোরই দাম বেড়েছে। শুনেছি কিছুদিনের মধ্যে আরও কিছু ওষুধের দাম
বাড়বে।
বাড্ডা এলাকার মেডিসিন কর্নার নামক একটি ফার্মেসির
মালিকের সঙ্গে কথা হলে ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ওষুধের দাম বৃদ্ধি একটি চলমান
প্রক্রিয়া। এমন কোনো মাস নেই, যে মাসে ওষুধের দাম বাড়ে না।
গত দুই মাসে প্রায় প্রতিটি ওষুধেরই দাম বেড়েছে। শোনা যাচ্ছে আবারও দাম বাড়তে
পারে।
তিনি বলেন, ওষুধের দাম
বাড়া-কমায় কারও কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। যখন যার যত খুশি দাম বাড়িয়ে ফেলেছে। সরকার
যদি একবার বলে যে দাম বাড়বে, এইটুকু বললেই হয়ে যায়।
রাতারাতি সব কিছুর দাম বেড়ে যায়, এমনকি অটোমেটিক বর্ধিত
দাম কার্যকরও হয়ে যায়। কারণ দাম মনিটর করার আসলে কেউ নেই।
দাম বাড়ার
কারণ জানতে চাইলে এই বিক্রেতা বলেন, ঠিক কী কারণে বেড়েছে এটা আসলে আমরা বলতে পারছি
না। এটা তো বলা যাবে না যে তেলের দাম বাড়ায় ওষুধের দাম বেড়েছে, কারণ তেলের সাথে ওষুধের কোনো সম্পর্ক নেই। ওষুধের দাম বাড়ার বিষয়টি তো
তেলের দাম বাড়ার আগেই ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। তবে বাড়তি দামে ওষুধগুলো বাজারে
এসেছে গত কয়েকদিনে।
বাচ্চু মিয়া
নামে আরেকজন ওষুধ বিক্রেতা বলেন, আমাদের ছোট দোকান। স্টক তো করে বড় বড় দোকানগুলো।
কোম্পানিগুলোও স্টক করে। সিপ্রোসিন ওষুধ পাচ্ছি না। টোফেন সিরাপও কম। খুঁজেও
পাচ্ছি না। তার মানে শিগগিরই এগুলোর দামও বেড়ে যাবে।
ওষুধের দাম বৃদ্ধি প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) স্বাস্থ্য
অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, বাজারে
নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসহ প্রায় সব কিছুরই দাম বেড়েছে। এখন আবার ওষুধের দাম
বেড়েছে, এটি আসলে সাধারণ মানুষের জন্য মরার ওপর খাঁড়ার ঘা।
মানুষ আসলে কোথায় যাবে, কী করবে? মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত
মানুষের সংসার চালাতেই তো এখন হাঁসফাঁস অবস্থা। এই অবস্থায় ওষুধের দাম বাড়ালে তো
সাধারণ মানুষকে রোগে ভুগে মারা যেতে হবে।
তিনি বলেন, যাদের সক্ষমতা
আছে, ব্যাংকে টাকা আছে, তাদের জন্য খুব
বেশি সমস্যা হবে না। কিন্তু যাদের নেই, যারা দিন আনে দিন
খায়, তাদের ওষুধের পেছনে বাড়তি খরচ করার উপায় নেই। তাহলে
তাদের হয় অন্য জিনিস স্যাক্রিফাইস করতে হবে, চাল-ডাল খাওয়া
বন্ধ করতে হবে, বাচ্চাদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করতে হবে,
আর নয় তো চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হতে হবে।
সৈয়দ আব্দুল
হামিদ বলেন, একজন চাকরিজীবী হিসেবে আমাদের হয়তো নাভিশ্বাস হচ্ছে, তাহলে এই যে গরিব মানুষ, যাদের নুন আনতেই পান্তা
ফুরায়, তাদের অবস্থা কেমন হচ্ছে? মানুষ
তো তিনবেলার জায়গায় দুইবেলা খেয়েও কোনোরকম বাঁচতে পারে। কিন্তু কেউ যদি অসুস্থ
হয়, আর যদি চিকিৎসা না করা যায় তাহলে তো মরা ছাড়া আর কোনো
পথ নেই।
ওষুধের দাম বৃদ্ধির বিষয়টিকে যৌক্তিক মনে করছেন ঔষধ প্রশাসন
অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক আইয়ুব হোসেন। তিনি বলেন, ওষুধের দাম ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়া কেউই বাড়াতে পারবে না।
ফার্মেসিতেও ওষুধের অতিরিক্ত দাম নেওয়া সম্ভব নয়, আবার ওষুধ
কোম্পানিও নিজেদের ইচ্ছা মতো দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। এমআরপি হোক বা
ইনডিকেটিভ প্রাইস হোক, আমাদের কাছ থেকে অনুমোদন নিয়েই
কার্টন বা প্যাকেটে নতুন দাম বসাতে হবে। এর বেশি দামে যদি কেউ বিক্রি করে, তাহলে সে অপরাধ করছে। এক্ষেত্রে সাধারণ মানুষকেই সতর্ক হতে হবে। প্রয়োজনে
কার্টনের গায়ে দেওয়া মূল্য দেখতে হবে, এমনকি ওষুধের দোকান
থেকে প্রয়োজনে ক্যাশ মেমো নিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, দাম বাড়াটা আমি
মনে করি এখন স্বাভাবিক। দাম কেনই বা বাড়বে না? বর্তমানে
বিশ্ব বাজারে সব জিনিসের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। এদিকে ডলারের মূল্য বৃদ্ধি ও সংকট
তৈরি হয়েছে। এদিকে ওষুধ কোম্পানিগুলোর কর্মীদের বেতন বৃদ্ধির একটি বিষয় আছে।
সবগুলো বিষয় মিলিয়েই তো ওষুধের দাম নির্ধারণ করা হয়। আমার মতে ঔষধ প্রশাসন
অধিদপ্তর ওষুধগুলোর যে পরিমাণ দাম বাড়িয়েছে তা খুবই যৌক্তিক।
ওষুধের দাম
বৃদ্ধি নিয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর কোম্পানিগুলোর চাপের মুখে থাকে কি না জানতে
চাইলে তিনি বলেন, আমরা তো ওষুধ কোম্পানিগুলোর জন্যই কাজ করি। তাদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা দেখাই আমাদের মূল দায়িত্ব। এর বাইরেও ওষুধপত্রের দাম নিয়ে রীতিমতো
আমরা খবরদারি করি। সুতরাং আমাদের তাদের চাপের মুখে থাকার কোনো প্রশ্নই আসে না।
তবে ঔষধ
প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, প্রতিনিয়তই ঔষধ
প্রশাসন অধিদপ্তরে কোম্পানিগুলো দাম বৃদ্ধির ব্যাপারে আবেদন করে। দাম বৃদ্ধি না
হলে কেউ কেউ উৎপাদন বন্ধের হুঁশিয়ারিও দেয়। আমরা আমাদের পলিসিগতভাবে বিষয়গুলো
দেখি। এসব আবেদনের প্রেক্ষিতে সম্প্রতি আমরা বিশ্ববাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে ১৫
থেকে ২০ শতাংশ দাম বাড়িয়েছি। তবে আমাদের এই নির্ধারিত দামের বাইরেও যদি কেউ
স্বপ্রণোদিত হয়ে দাম বাড়ায়, তাহলে আমরা তাদের বিরুদ্ধে
ব্যবস্থা নেব।
দুই মাস আগেও পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকার ওষুধে মাস যেত মো. সিরাজুল
ইসলামের। এখন ৭ হাজার টাকাতেও যায় না। ওষুধের দাম বাড়ায় প্রতিমাসে এইখাতে খরচ হয়
সাত হাজার টাকারও বেশি। এদিকে ডায়াবেটিস, প্রেশারের সাথে
সিরাজুল ইসলামের যোগ হয়েছে হার্টের ওষুধ। এর বাইরে প্রতিমাসে একজন চিকিৎসকের
পরামর্শ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষায় খরচ হয় আরও দুই থেকে তিন হাজার টাকা। সব মিলিয়ে
বর্তমানে চিকিৎসায় তার মাসে খরচ ১০ হাজার টাকা। সিরাজুল ইসলামকে চিকিৎসক জানিয়েছেন,
যতদিন বেঁচে থাকবেন, ততদিনই নিয়মিত চলবে এসব
ওষুধ।
বর্তমানে একটি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকলেও, খুব শিগগিরই চাকরিজীবন শেষ হচ্ছে সিরাজুল ইসলামের। তিনি বলেন, প্রেশারের ওষুধ বন্ধ করলেই প্রেশার বেড়ে যায়, ডায়াবেটিসের ওষুধ বন্ধ হলেই ডায়াবেটিস বেড়ে যায়। ডাক্তার বলেছে আজীবন ওষুধ খেয়ে যেতে হবে। এখন না হয় কোনোরকম যোজন-বিয়োজন করে সংসার ও চিকিৎসা চালিয়ে নিচ্ছি, কিন্তু চাকরি শেষ হয়ে গেলে প্রতিমাসে এই টাকা কীভাবে ম্যানেজ করব ?
দফায় দফায়
ওষুধের দাম বৃদ্ধিতে শুধু সিরাজুল ইসলামেরই নয়, নিয়মিত ওষুধে নির্ভরশীল এমন অসংখ্য
মানুষের কপালে চিন্তার ভাঁজ। তাদের অনেককেই এখন ওষুধ অথবা খাওয়া-পরায় কাটছাঁটও
করতে হচ্ছে।
ওষুধের সাথে পাল্লা দিয়ে স্বামী-স্ত্রীর পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি
গ্রহণের পণ্যেরও দাম বেড়েছে। বাজারে অতিপরিচিত গর্ভনিরোধক পিল ফেমিকন একমাস আগেও
বিক্রি হয়েছে ৩৫ টাকায়। এখন সেটি বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকায়।
এছাড়াও প্রায়
প্রতিটি কোম্পানির কনডমের দাম বেড়েছে। হিরো কনডম আগে বিক্রি হতো ১২ টাকা প্রতি পিস, বর্তমানে বিক্রি
হচ্ছে ২০ টাকা করে। এছাড়াও প্যানথার কনডেমের পূর্বে মূল্য ছিলো ১৫ টাকা, বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ২৫ টাকা করে।