মইনুল ইসলাম মিতুল: অতিবৃষ্টি ও উজানের ঢলে চতুর্থ দফায় নদণ্ডনদীর পানি বাড়ছে দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে। সুরমা কুশিয়ারা ও সারি নদীর পানি বেড়ে সিলেটের বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। নদীর পাড় উপচে শহরে পানি ঢুকে পড়ায় বিভিন্ন এলাকার বাসবাড়ি তলিয়ে গেছে। সুনামগঞ্জের অসংখ্য রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্লাবিত হয়েছে। পানিতে তলিয়ে গেছে কুড়িগ্রামের রৌমারী স্থলবন্দর এলাকা; বন্ধ রয়েছে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যও। এতে বেকার হয়ে পড়েছেন বন্দরের প্রায় ৬০০০ শ্রমিক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। আর ১৫ গ্রাম ও চরের তিন সহস্রাধিক পরিবার বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে নীলফামারীতে। এমন অবস্থায় এসব জেলার বন্যাকবলিত পরিববারগুলো দীর্ঘস্থায়ী দুর্ভোগের শঙ্কা করছেন।
বন্যার্তরা জানিয়েছেন, দ্বিতীয় দফায় আবার বন্যা দেখা দেওয়ায় তারা চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন। অধিকাংশ এলাকায় বাসাবাড়িতে পানি ঢুকে পড়ছে। রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়ায় অনেকে যোগাযোগবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। খবর প্রতিদিনের সংবাদ প্রতিনিধিদের।
সিলেট : পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সিলেট কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলার প্রধান দুই নদী সুরমা কুশিয়ারা ও সারি নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে পানি বেড়েছে। সুরমা নদীর কানাইঘাট পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার শূন্য দশমিক ৯৩ সেন্টিমিটার ও সিলেট পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার শূন্য দশমিক ৩২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়া কুশিয়ারা নদীর ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার শূন্য দশমিক ৩৩ সেন্টিমিটার এবং সারি নদের সারিঘাট পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার শূন্য দশমিক ৪৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়া জেলার অন্য নদণ্ডনদীর পানিও ক্রমশ বাড়ছে।
স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে, জেলার কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট ও সদর উপজেলার অন্তত ৫০০ গ্রাম বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকার একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি-বেসরকারি কার্যালয়ের ভেতরে পানি ঢুকে পড়ায় স্বাভাবিক কার্যক্রম বিঘ্নিত হয়েছে। এর বাইরে সিলেট নগরের অন্তত ৮ থেকে ১০টি এলাকা পানিতে তলিয়ে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
এদিকে কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন ও গ্রামের সংযোগসড়ক পানিতে তলিয়ে আছে। এসব রাস্তা দিয়ে যানবাহনের বদলে মানুষজন নৌকায় চলাচল করছেন। বিকাল পর্যন্ত নগর ও পাঁচটি উপজেলায় অন্তত চার থেকে সাড়ে চার লাখ মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় আছেন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, সিলেট নগরের তালতলা, জামতলা, সোবহানীঘাট, তেরোরতন, উপশহর, কালীঘাটসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় সুরমার পাড় উপচে পানি ঢুকে পড়ায় আকস্মিক বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। এসব এলাকার রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় মানুষজন ভোগান্তি পোহাচ্ছেন। অনেক বাসাবাড়ি ও দোকানে পানি উঠেছে। কোথাও কোথাও হাঁটুপানি দেখা গেছে। ঘরের ভেতরে পানি ওঠায় অনেকে আত্মীয়ে বাড়ি সরে যাচ্ছেন। সিলেটের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমদ চৌধুরী বলেন, ২৪ ঘণ্টায় সিলেটে সর্বোচ্চ ১৪৩ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। চলতি সপ্তাহে কমণ্ডবেশি বৃষ্টিপাত হবে। তবে ১৯ ও ২০ জুন বেশি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে।
সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. আনোয়ার সাদাত জানান, প্রয়োজনীয় স্থানে আশ্রয়কেন্দ্র চালুর জন্য সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন।
সুনামগঞ্জ : সুনামগঞ্জ জেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। জেলার প্রায় সব উপজেলা বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। অসংখ্য রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্লাবিত হয়েছে। জেলা সদরের সঙ্গে পাঁচটি উপজেলার সরাসরি সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। জেলায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন লক্ষাধিক মানুষ।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, সুরমার পানি দিরাইয়ের পুরাতন এলাকার পয়েন্টে বিপৎসীমার ২৯ সেন্টিমিটার, ছাতক পয়েন্টে ২ দশমিক ১৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়া তাহিরপুর এলাকায় জাদুকাটা নদীর পানি প্রবাহিত হচ্ছে বিপৎসীমার ৬৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের সুনামগঞ্জ কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, নদণ্ডনদীর পানি দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে। তবে বৃষ্টি কমলে পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।
জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, পানি বাড়ছে, আর পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। জেলার লক্ষাধিক মানুষ এখন পানিবন্দি। প্রশাসনের পক্ষ থেকে সার্বিক পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
রংপুর : ভারী বর্ষণ এবং উজানের ঢলে তিস্তার পানি বিপৎসীমা ছুঁয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কন্ট্রোল রুম সূত্রে জানা গেছে বৃহস্পতিবার সকাল ৬টার দিকে তিস্তা ব্যারেজ পয়েন্টে নদীর পানি বিপৎসীমার দশমিক ৬৩ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়। তবে সকাল ৯টায় তা বেড়ে বিপৎসীমা ছুঁয়েছে।
এদিকে গঙ্গাচড়ার ছয় ইউনিয়ন ও নদী তীরের বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এরই মধ্যে ৩০ গ্রামের ২৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।
গঙ্গাচড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, তিস্তার পানি বাড়ায় লক্ষ্মীটারি, কোলকোন্দ, মর্নেয়া নোহালী ও আলম বিদিতর ইউনিয়নের ৩০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা লক্ষ্মীটারি ইউনিয়নের। এ ইউনিয়নের বিনার চর, শংকরদাহসহ বেশ কয়েকটি দুর্গম চরাঞ্চলের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।
এদিকে তিস্তা নদীর পানি বাড়ার কারণে চরাঞ্চলের শত শত হেক্টর জমির বাদাম নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
লক্ষ্মীটারি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল হাদী বলেন, অসময়ে তিস্তা নদীর পানি বাড়ায় ইউনিয়নের অনেক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এছাড়া বাদামসহ বেশ কিছু ফসলের ক্ষতি হয়েছে।
গঙ্গাচড়ার ইউএনও এরশাদ উদ্দিন বলেন, পানি বেড়ে যাওয়ায় নদী তীরবর্তী ও দুর্গম চরাঞ্চলের মানুষকে সতর্ক থাকার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন এলাকায় সহায়তা পৌঁছাতে কাজ চলছে।
নীলফামারী : তিস্তা নদীর পানি বাড়ায় ডিমলা উপজেলার তিস্তাবেষ্টিত পূর্ব ছাতনাই, টেপাখড়িবাড়ি, খগাখড়িবাড়ি, খালিশাচাপানী, ঝুনাগাছ চাপানী ও গয়াবাড়ি ইউনিয়নের প্রায় ১৫টি গ্রাম ও চরের তিন সহস্রাধিক পরিবার বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে।
উপজেলার পূর্ব ছাতনাই ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ খান বলেন, সকাল থেকে তিস্তার পানি বাড়তে শুরু করে। এতে ইউনিয়নের ঝাড়সিংহেরস্বর, পূর্ব ছাতনাই ও খোকার চরের পাঁচ শতাধিক পরিবার বন্যাকবলিত হয়ে পড়ে। দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকে।
টেপাখাড়িবাড়ির ইউপি চেয়ারম্যান মো. ময়নুল হক বলেন, ইউনিয়নের প্রায় এক হাজার পরিবারের বাড়িঘরে বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। সকালে স্বপন বাঁধের প্রায় ৫০ মিটার অংশ ভেঙে মসজিদ পাড়ার ১৪০টি পরিবারের বাড়িঘর বন্যাকবলিত হয়।
পানি উন্নয়ন বোর্ড ডালিয়া ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আসফাউদ্দৌলা বলেন, তিস্তার পানি বৃহস্পতিবার বিপৎসীমা ছুঁয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এ কারণে ব্যারাজের সব কটি (৪৪টি) জলকপাট খুলে রাখা হয়েছে। বর্তমানে পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক রয়েছে।
কুড়িগ্রাম : রৌমারী স্থলবন্দর এলাকার রাস্তার দুই পাশে জমে আছে পানি। পানির মধ্যে থরে থরে সাজানো রয়েছে বিভিন্ন আকারের পাথর ও বালু। ডিপোগুলোতে পাথর আছে, পাথর ভাঙার মেশিন আছে, কিন্তু নেই শ্রমিক। নেই কর্মচাঞ্চল্য, নেই মানুষের কোলাহল।
বন্দরের রাজস্ব কর্মকর্তা সৈয়দ আরিফুর রহমান বলেন, বন্দরে যাতায়াতের সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় বাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। এ কারণে ছয় হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে। এছাড়া এ কাজের সঙ্গে জড়িত অন্যরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আর সরকার হারাচ্ছে রাজস্ব। দীর্ঘদিন কর্মহীন থাকায় শ্রমিকদের পরিবারে দেখা দিয়েছে অভাব। অনেকে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা করছেন।
রৌমারী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শেখ আবদুুল্লাহ বলেন, বন্দর অচল হওয়ায় ছয় হাজার শ্রমিক অত্যন্ত অসহায় ও মানবেতর জীবন যাপন করছেন। তাদের দ্রুত সহযোগিতা করা দরকার।