মাজহারুল ইসলাম মাসুম, সিনিয়র সাংবাদিক ও কলাম লেখক ঃ
আপনার মাঝে আমি অচেনারে খুঁজি। অচেনারে খুঁজতে খুঁজতে কোথায় হারিয়ে যাই তা আমি জানি না। তারপরও খুঁজি। এমন করে অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমি নিজেকে যেখানটায় আবিষ্কার করি সেটা ভিন্ন একটা পৃথিবী। যে পৃথিবী একান্ত আমার আর কারো নয়। সে পৃথিবীর বাসিন্দা কেবল আমি আর কেউ নয়। সেটা মানুষের পৃথিবীর মতো এতো ছোট নয়। সেটা অনেক গুণ বড়। এতটা বড় যে তার কোনো মানচিত্র থাকে না। তবে সেখানে অসংখ্য কল্পনার শেকড় থাকে। যে শেকড়কে মাটিতে শক্ত করে ধরে রেখে মানুষ একটার পর একটা কল্পনার বৃক্ষ গড়ে তোলে।
সে কল্পনার শক্তি মানুষের পৃথিবীর যে কোনো শক্তির চেয়ে অনেক বড়। তৃষিত হৃদয়ের কল্পনাশক্তি মানুষের ভিতরে নতুন নতুন চিন্তার জন্ম দেয়। সে চিন্তা গতানুগতিক পৃথিবীর মতো নয়। সে চিন্তা মৌলিক চিন্তার অন্তর্গত। পৃথিবীর মানুষ যা আগে কখনো ভাবতে পারেনি এমন এক একটা নতুন চিন্তা মানুষ তার নিজের পৃথিবীর কল্পনাশক্তির নির্যাস থেকে বের করে আনে। সে এক অভূতপূর্ব বিস্ময়, সে এক অলৌকিক শিহরণ, সে এক আপনা মাঝে শক্তি ধরো নিজেরে করো জয়ের মতো অভিজ্ঞতা। মানুষটা তখন সে পৃথিবীর সৃজনশীল মানুষ হয়। মানুষের পৃথিবী তার মূল্য দিবে কি দিবে না মানুষটা সেটা কখনো ভাবে না। কারণ সে জানে তার পৃথিবী তাকে ত্যাগ করতে শেখায় আর মানুষের পৃথিবী স্বার্থপর হতে শেখায়। স্বার্থপর পৃথিবী মানুষটার নিজের গড়া পৃথিবী থেকে শুধু কেড়ে নিতে জানে, প্রতিদান দিতে জানে না। পৃথিবীর মানুষ তাই হারিয়ে যায়, কিন্তু নিজের অচেনার মাঝে চেনা পৃথিবী গড়া মানুষটা বেঁচে থাকে কাল থেকে কালান্তরে, যুগ থেকে যুগান্তরে, মহাকাল থেকে মহাস্রোতে। মানুষ যদি নিজের পৃথিবী তৈরী করতে পারে তবে সে পৃথিবী মানুষের মনে স্বপ্ন তৈরী করে।
সে স্বপ্ন মানুষটা নিজের স্বার্থে দেখেনা তার পৃথিবীর বাইরে মানুষের যে পৃথিবী রয়েছে সে পৃথিবীর মুখোশ পরা মানুষগুলোর জন্য দেখে। তাদের জন্য মানুষটা স্বপ্নের ঘুড়ি তার নিজের পৃথিবীর আকাশে উড়ায় যেন সে ঘুড়িটা সুতো ছিঁড়ে গোলকধাঁধার আবর্তে ঘুরতে ঘুরতে মানুষের পৃথিবীতে উড়তে থাকে। আনন্দের বার্তা হাতে নিয়ে, সবার চোখের আয়নায়। তৃতীয় নয়নে। তারপর ঘুড়িটা জীবের আবরণ ছেড়ে জীবন পেয়ে পাখি হয়ে উড়ে বেড়ায় নীল আকাশ থেকে নীল আকাশে। শীতের দেশে, নদীর জলে, প্রকৃতির কোলে। তারপর কোনো এক মহাকাব্যের লেখক তার নিজের পৃথিবী ছেড়ে নেমে আসে মানুষের পৃথিবীতে। স্বপ্ন শুধু একটাই তার, যদি বদলানো যায় মানুষ। যদি বদলানো যায় মানুষের জীবন। যে জীবন সব বস্তুবাদী চিন্তাধারাকে বিসর্জন দিয়ে নিজের পৃথিবী গড়বে।
প্রত্যেক মানুষের একটা নিজের পৃথিবী থাকে। তবে নিজের মাঝে বাস করা অচেনা পৃথিবীকে কেউ খুঁজে পায়, কেউ পায় না। যারা পায় তারা কখনো কাউকে সেটা জানায় না, বরং সে পৃথিবী তৈরির বোধ তার মধ্যে তৈরী করে। আমি সেই পৃথিবী খুঁজে পেয়েছি কিনা জানি না, তবে সে পৃথিবী যতই অচেনা-অজানা হোক, অন্তর্নিহিত হোক, সে পৃথিবী খোঁজার মহাযজ্ঞে নামুক মানুষ। কারণ সে পৃথিবীর যারা মানুষ হতে পারে তাদের মতো মানুষ আর কেউ হতে পারে না। নিজেকে যারা চিনতে পারে তারাই তো মানুষ আর যারা নিজেদের চিনতে পারে না তাদের মতো অভাগা আর কেউ নেই।