মোহাম্মদ হাছানুজ্জামান মাসউদ :
অনারম্বরপূর্ণ আয়োজনে রাজধানীর জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদানিয়ায় (যাত্রাবাড়ী বড় মাদ্রাসা) ২১ সেপ্টেম্বর (শনিবার) সকাল ১০ টায় কওমি মাদরাসাগুলোর সর্বোচ্চ অথরিটি আল-হাইয়াতুল উলয়া লিল-জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’র চেয়ারম্যান, কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ’র সভাপতি, রাজধানীর জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলূম মাদানিয়া যাত্রাবাড়ি’র প্রিন্সিপাল, গুলশান সেন্ট্রাল মসজিদ ও ঈদগাহ সোসাইটি’র খতিব, মজলিসে দাওয়াতুল হক বাংলাদেশ’র আমীর মুহিউস সুন্নাহ আল্লামা মাহমুদুল হাসানের সভাপতিত্বে এ পরামর্শ সভায় দেশের শীর্ষস্থানীয় ১২০ এর অধিক উলামায়ে কেরাম ও ইসলামী চিন্তাবিদরা উপস্থিত ছিলেন।
কওমের ঐক্য-সংহতি ও সঠিক দিকনির্দেশনার ক্ষেত্রে ওরাসাতুল আম্বিয়া হিসাবে উলামায়ে কেরামের দায়িত্ব আঞ্জাম দেওয়ার নিমিত্তে ‘দেশ ও জাতির চলমান পরিস্থিতি : উলামায়ে কেরাম এবং ইসলামী চিন্তাবিদদের করণীয়’ শীর্ষক জাতীয় পরামর্শ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সভাপতির বক্তব্যে আল্লামা মাহমুদুল হাসান বলেন, ২০২৪ সাল আমাদের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য বছর। গত জুলাই-আগস্ট মাসে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দেশের একটি পট পরিবর্তন ঘটেছে। যার মূলশক্তি ছিল সকলের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস। দেশবাসী এক হলে বড় কিছু করা যায়। এ সময়ে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার সাথে উলামায়ে কেরামের ঐক্য ছিল লক্ষ্যণীয়। এ পর্যায়ে অভূতপূর্ব জাতীয় ঐক্য সংহতিরও নজির সৃষ্টি হয়েছে। এক পর্যায়ে অন্তবর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। তারা রাষ্ট্রসহ মৌলিক অনেক পর্যায়ে সংস্কার সাধন করবেন বলে উদ্যোগী হয়েছেন।
তিনি বলেন, এ সংস্কার কাজে ইসলামী আদর্শ ও মূল্যবোধ এবং দেশ ও জাতির স্বার্থ সংরক্ষিত হচ্ছে কিনা, সেটা দেখা উলামায়ে কেরামের দায়িত্ব। নতুন গঠিত প্রতিটি কমিশনে শতকরা ৯২ ভাগ মুসলমানের স্বার্থ দেখার দায়িত্ব উলামায়ে কেরামের। বিশেষ করে সংবিধান সংস্কারে ইসলাম বিরোধী কোনো পদক্ষেপ যেন গ্রহণ করা না হয়, সেটা পর্যবেক্ষণ করা এবং সংবিধানসহ প্রতিটি কমিশনে উলামায়ে কেরাম ও ইসলামী চিন্তাবিদদের অংশীদারিত্ব বহাল রাখা একটি কর্তব্য।
দেশের সর্বস্তরের উলামায়ে কেরামকে ঐক্যের আহ্বান জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ধর্মপ্রাণ মানুষ এখন উলামায়ে কেরামের ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্মের জন্য অপেক্ষমান। আপনারা এবার বিচ্ছিন্ন না হয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকলে স্থায়ীভাবে জনগণের মনে স্থান করে নেওয়া সম্ভব হবে। রাষ্ট্রব্যবস্থায় নিঁখুত একটি শক্তি হিসেবে ইসলাম ও মুসলমানের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে। মনে রাখতে হবে, সর্বাবস্থায় আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত, আকাবিরে দেওবন্দ ও বাংলাদেশের শত বছরের শীর্ষ মুরব্বি উলামায়ে কেরামের মত-পথ, নীতি ও আদর্শ সমুন্নত রাখতে হবে।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমীর সৈয়দ মুফতি রেজাউল করীম বলেন,-
দেশের দ্রুত পরিবর্তনশীল এই সময়ে যাত্রাবাড়ির হযরত একটি সাহসী এবং যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছেন। স্বাধীনতার পর থেকে ৫৩ বছরে ইসলামকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নেওয়ার সুযোগ আসেনি। ভিন্নমত তো থাকবেই, কিন্তু পরামর্শের ভিত্তিতেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। এই সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। এ ব্যাপারে উলামায়ে কেরামের যে কোনো সৎ পরামর্শ আমরা মেনে নিতে প্রস্তুত।
পরামর্শ সভার আলোচনায় বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ও আলোচক আল্লামা নুরুল ইসলাম ওলিপুরী বলেন,-
যতদিন কওমি আলেমরা রাজনৈতিক প্রশ্নে এক প্লাটফর্মে না আসবে, ততদিন তাদের রাজনৈতিক মুক্তি হবে না। যারা কওমি আলেমদের আকীদার নয় তাদের সাথে ঐক্য কোনো সুফল বয়ে আনবে না।
বেফাকুল আরাবিয়া বাংলাদেশের মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হক বলেন,
আমি মনে করি, আমাদের এখন আকীদার ভিত্তিতে ঐক্য হয়ে যাওয়া। পরবর্তীতে বিরোধী কারো সাথে ঐক্য হলে যদি ইসলামের বৃহৎ স্বার্থ হাসিল হয় তখন রাজনৈতিক নেতারা সময় অনুযায়ী ভেবে সিদ্ধান্ত নিবেন।
ইসলামী চিন্তাবিদ ও আলোচক মুফতি মুশতাকুন্নবী বলেন,
আজকের এই মজলিস আমাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সূচনা। তরিকতের লাইনে বলি আর উলূমের লাইনেই বলি, আল্লামা মাহমূদুল হাসান সাহেব আমাদের জাতীয় মুরব্বি। তিনি বেফাক ও হাইয়ার ক্রান্তিলগ্নে আমাদের বাঁচিয়েছেন। আমরা যদি আজ তার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হতে পারি, তাহলে আগামীর বাংলাদেশে এই দল উলামাদের সঠিক পথ দেখাবে।
এ সময় উলামায়ে কেরাম ও ইসলামী চিন্তাবিদদের করণীয় শীর্ষক জাতীয় পরামর্শ সভায় ৭ দফা প্রস্তাবাবলী গৃহীত হয়।
১। রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসেবে সংবিধান সংস্কারে ইসলাম বিরোধী কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা যাবে না এবং সংবিধানসহ প্রতিটি কমিশনে উলামায়ে কেরাম ও ইসলামী চিন্তাবিদদের অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করতে হবে।
২। শিক্ষা সংস্কার কমিটিতে ইসলামী শিক্ষাবিদ, কারিকুলাম ও সিলেবাস বিশেষজ্ঞ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
৩। সংস্কারের সুযোগে পাশ্চাত্য বিভিন্ন মতবাদ, ট্রান্সজেন্ডার, এলজিবিটিকিউ, উগ্র নারীবাদ, সর্বধর্মবাদ ইত্যাদি অনুপ্রবিষ্ট করা যাবে না।
৪। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শান ও মান এবং খতমে নবুওয়াত সমুন্নত রাখার জন্য আইন পাশ করতে হবে।
৫। রাষ্ট্র, সমাজ ও সরকারের প্রতিটি ক্ষেত্রে শতকরা ৯২ ভাগ মানুষের বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির মূল্যায়ন করতে হবে।
৬। বাংলাদেশের যাবতীয় দ্বীনি কার্যক্রমের শরীয়াভিত্তিক বিশ্লেষণ ও দিক নির্দেশনা প্রদানের জন্য আল্লামা মাহমূদুল হাসানের নেতৃত্বে একটি কাউন্সিল গঠন করা হবে।
৭। আজকের জাতীয় পরামর্শ সভা থেকে প্রাপ্ত প্রস্তাবাবলীর আলোকে ইসলামী অঙ্গনে ব্যাপক আকারে ঐক্যের রূপরেখা তৈরি করে আল-হাইয়াতুল উলিয়ায় উপস্থাপন করা হবে।
জাতীয় এ পরামর্শ সভায় অন্যান্যদের মধ্যে আলোচনা করেন, হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব আল্লামা সাজিদুর রহমান, ঢালকানগর মাদ্রাসার মুহতামিম মুফতী জাফর আহমাদ, জামিয়া পটিয়ার মুহতামিম মাওলানা আবু তাহের নদভী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নায়েবে আমীর মুফতি সৈয়দ ফয়জুল করীম, জাতীয় ওলামা মাশায়েখ আইম্মা পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি মাওলানা নূরুল হুদা ফয়েজী, হেফাজতে দ্বীন বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মুফতি মুহাম্মদ আলী, জামিয়া গহরপুরের মুহতামিম মাওলানা মুসলেহুদ্দীন গওহরপুরী, বেফাকের প্রধান পরিচালক মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের সভাপতি মাওলানা মানুসুরুল হাসান রায়পুরী, ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মাওলানা আব্দুল কাদির, ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব অধ্যক্ষ ইউনুস আহমাদ, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের মহাসচিব মাওলানা হাবিবুল্লাহ মিয়াজী, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির সভাপতি মুফতি মুজিবুর রহমান, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব আব্দুল হক কাউসারি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব ড. মহিউদ্দিন ইকরাম, খেলাফত আন্দোলনের নায়েবে আমীর মাওলানা মুজিবুর রহমান হামিদী, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির নির্বাহী সভাপতি একেএম আশরাফুল হক প্রমুখ।
জাতীয় পরামর্শ সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন, বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা ওবায়দুল্লাহ হামযা, শিবচর জামিয়াতুস সুন্নাহর মুহতামিম মাওলানা নেয়ামতুল্লাহ ফরিদী, মাওলানা আব্দুল আউয়াল (নারায়নগঞ্জ), তাওয়াক্কুলিয়া রেঙ্গার মুহতামিম মাওলানা মুহিউল ইসলাম বুরহান, টঙ্গি দারুল উলুমের মুহতামিম মুফতি মাসউদুল করীম, হেফাজত ইসলামের প্রচার সম্পাদক মুফতি কেফায়েতুল্লাহ আজহারী, বসুন্ধরা মাদরাসার সিনিয়র মুহাদ্দিস মুফতি সোহাইল, চকবাজার শাহী মসজিদের খতিব মাওলানা মিনহাজ, মাদরাসাতু সালমানের মুহতামিম মুফতি রুহুল আমিন, চৌধুরীপাড়া মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা মাহফুজুল হক, মেরাজনগর মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা রশীদ আহমদ, খতমে নবুওয়তের সহ-সভাপতি মুফতি সাঈদ, মাওলানা উবায়দুর রহমান মাহবুব, মাওলানা সাদেক আহমদ সিদ্দিকী, মাওলানা আবু জাফর কাসেমী, মাওলানা নুরুল ইসলাম (গাজীপুর), মাওলানা আলী আহমাদ (পীর সাহেব চণ্ডিবর্দি), মাওলানা শওকত হোসেন সরকার, মাওলানা বোরহানুদ্দীন রাব্বানী, মাওলানা আনওয়ারুল হক, মুফতি মাওলানা গোলামুর রহমান, শহীদুল আনওয়ার সাদী, মাওলানা আশরাফ আলী, মুফতি মাসুম আহমদ প্রমুখ।
সভার পরিসমাপ্তিতে জুলাই-আগস্ট মাসে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যেসকল তাজা প্রাণ ঝরেছে তাদের রূহের মাগফিরাত কামনা করা হয় এবং বর্তমান উপদেষ্টা পরিষদের ও দেশ জাতির কল্যাণ কামনায় মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সাহায্য কামনা করা হয়।