২০২৪ সালে রক্তঝরা জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে। রাজনৈতিক দল হিসেবে এ আন্দোলনে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী ছিল অন্যতম সহসংগ্রামী।
গত ১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসন হটাতে জেল-জুলাম ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এ দুদলের নেতাকর্মীরা। এ দুদলের ছাত্র-তরুণরা বিপুল ত্যাগ শিকার করেছেন হাসিনা সরকারকে গদিছাড়া করতে। তারা হয়েছেন হত্যা ও গুমের শিকার। তাদের ও দেশবাসীর আশা ছিল আন্দোলনের শক্তিগুলো ঐকমত্য থেকে দেশকে গণতান্ত্রিক সংস্কারের পথে এগিয়ে নেবে। রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে আইনের শাসন পরিপন্থি কাজ এবং সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জেঁকে বসা দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলা। এখন বাস্তবতা বলছে অন্য কথা। জাতীয় নির্বাচন আগে নাকি স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে—এই প্রশ্নে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে দেখা দিয়েছে প্রবল দ্বিমত। এ প্রশ্নে দল দুটির নেতারা কার্যত বিপরীতমুখী অবস্থান নিচ্ছে ক্রমেই। যা এখন দেশবাসীর সামনে পরিষ্কার।
ভোটবর্জনের ঘোষণা দিতে পারে বিএনপি
জাতীয় নির্বাচনের আগে কোনোভাবেই স্থানীয় নির্বাচন চায় না বিএনপি ও সমমনা দলগুলো। দলটির শীর্ষ নেতারা বলছেন, স্থানীয় নির্বাচন আয়োজনে সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তের পেছনে জাতীয় নির্বাচন পেছানোর কূটকৌশল রয়েছে। এতে সুবিধা পাবে ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দল। এক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার চূড়ান্ত পদক্ষেপ নিলে ভোটবর্জনের মতো সিদ্ধান্তও নিতে পারে বিএনপি ও তার সমমনা দলগুলো।
এদিকে এলজিআরডি উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ জানিয়েছেন জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন আয়োজনে সরকার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
জানা গেছে, নির্বাচন নিয়ে সরকারের এমন অবস্থানের পক্ষে নয় বিএনপি। নীতিনির্ধারণী ফোরামে এ নিয়ে বিস্তর আলোচনাও করেছে দলটি। সিদ্ধান্ত হয়েছে শেষ পর্যন্ত সরকার স্থানীয় নির্বাচন করলে সমর্থন দেবে না বিএনপি। এমনকি আসতে পারে ভোটবর্জনের মতো ঘোষণাও। বিষয়টি নিয়ে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে কোনো স্থানীয় নির্বাচনকে আমরা মেনে নেব না। জনগণের প্রথম দাবি রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক সরকার।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অনির্বাচিত এরশাদ সরকারের আমলে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের খারাপ নজির রয়েছে। সেই উদাহরণ টেনে বিএনপি নেতারা বলছেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনের নামে অহেতুক সময়ক্ষেপণ করা হবে। এর পেছনে রয়েছে সমন্বয়কদের নতুন রাজনৈতিক দলকে শক্তিশালী করার কূটকৌশলও।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন বলেন, এদের (সরকার) মূল লক্ষ্য নির্বাচনকে পিছিয়ে দেওয়া। অন্যদিকে, ছাত্রদের সমন্বয়ে যে দল হচ্ছে তাদের সময় দেওয়া; যাতে তারা গুছিয়ে নিতে পারে। তাদের তো কোনো ক্যাডার নেই। তারা ভাবছে, একবার স্থানীয় সরকার নির্বাচন করে দিলে চেয়ারম্যান, মেম্বার এরাই তাদের ক্যাডার হবে। এরাই তাদের দলকে ধরে রাখবে। এই উদ্দেশেই তারা স্থানীয় সরকার নির্বাচনের কথা বলে। এর বাইরে কোনো মহৎ উদ্দেশ্য নেই। ক্ষমতা যতদিন পারা যায় বিলম্বিত রাখা যায়, সেই উদ্দেশেই এমন কথা বলছে।
সালাহউদ্দিন আহমেদ এ বিষয়ে বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। একটি নির্বাচন করতে তিন চার মাস সময় লাগে। উপজেলা, পৌসভা বা সিটি করপোরেশনে আরো সময় লাগে। এক্ষেত্রে এই নির্বাচনের জন্য এত দীর্ঘসময় তো নেই।
বিএনপি জোটের শরিক নাগরিক ঐক্যের সভাপতি ও গণতন্ত্র মঞ্চের নেতা মাহমুদুর রহমান মান্নাও স্থানীয় নির্বাচন নিয়ে সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেন, এরশাদ আমলে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করাই ছিল পার্টি বানানোর ধান্দা। এরকম সন্দেহ তো সবার ভেতরে ভেতরে। সরকারকে এই প্রশ্নে পড়তে হবে কেন? যদি ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন (জাতীয় নির্বাচন) করা যায়, তাহলে সেটি (স্থানীয় নির্বাচন) পরে হবে। এই বিবেচনায় আমি মনে করি, এখন স্থানীয় সরকার নির্বাচন দরকার নেই।
যদিও মাহমুদুর রহমান দাবি করেন, জনগণের সেবার জন্য স্থানীয় সরকার প্রয়োজন। তবে রাজনৈতিক সরকারের অধীনেই স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পক্ষে তিনি। বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর শীর্ষ নেতারা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের মূল কাজ জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা।
সংস্কার শেষে নির্বাচন চায় জামায়াত
এক যুগ পর নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করে ‘জরুরি সংস্কার’ সেরে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি চালু এবং জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবি তুলে ধরেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। দলটির সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পূর্ণ করে, নির্বাচন প্রক্রিয়া সুষ্ঠু করতে যেটুকু সংস্কার লাগে সেটুকুই করুক সরকার। জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন আয়োজনে সমর্থন রয়েছে জামায়াতের। তিনি বলেন, কমিশনকে আমরা পরামর্শ দিয়েছি, জনগণের আকাঙ্ক্ষা, জনগণ চায় স্থানীয় নির্বাচন আগে হোক। আমরা জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে সমর্থন ও সম্মান জানাই।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দীনসহ অন্য নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে বৈঠক শেষে এ কথা বলেন তিনি। বৈঠকে জামায়াত সেক্রেটারি ছাড়াও সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এ এইচ এম হামিদুর রহমান আযাদ, নির্বাহী পরিষদের সদস্য মতিউর রহমান আকন্দ, প্রকাশনা ও মিডিয়া বিভাগের সেক্রেটারি কর্মপরিষদ সদস্য অ্যাডভোকেট জসিম উদ্দিন সরকার, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মজলিসে শূরা সদস্য অ্যাডভোকেট ইউসূফ আলী, জামায়াতের কর্মপরিষদ সদস্য অ্যাডভোকেট কামাল উদ্দিন উপস্থিত ছিলেন।
মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, পূর্বের তিনটি নির্বাচনে জনগণ যে ভোট দিতে পারেনি, সেই নির্বাচনেরই পুনরাবৃত্তি ঘটবে যদি সংস্কার সঠিকভাবে না হয়। এ দেশের জনগণ ২ হাজার ছাত্র-জনতার জীবন, ৩০ হাজার আহত জনতার রক্ত বৃথা যেতে দেবে না। এ জন্য আমরা বলেছি, সংস্কার সম্পূর্ণ করে, নির্বাচন প্রক্রিয়া সুষ্ঠু করতে যেটুকু সংস্কার লাগে সেটুকু করুক। আমরা পুরো রাষ্ট্রের সংস্কারের কথা বলিনি। অনেকে এটা নিয়ে ভুল বোঝার চেষ্টা করেন। এটা (সংস্কার) করতে গেলে সময় লাগে, এটা সরকারের দায়িত্ব বলেও জানান তিনি। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নির্বাচনকে নিরপেক্ষ করতে গেলে যে সংস্কারটুকু ন্যূনতম প্রয়োজন, তার জন্য যতটুকু সময় যৌক্তিক প্রয়োজন, জমায়াতে ইসলামী সে সময় দিতে প্রস্তুত। আমরা কোনো দিন, মাস, ক্ষণ বেঁধে দিইনি। সংস্কার ও নির্বাচনের জন্য ‘যৌক্তিক সময়’ নিয়ে জামায়াতে ইসলামী বরাবরই আগের অবস্থানে রয়েছে বলে জানান সেক্রেটারি জেনারেল।
ডিসেম্বর ধরে জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতির বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, গভর্মেন্ট একটি টেনটেটিভ আইডিয়া দিয়েছে। তারা যদি তাদের ঘোষিত সময়ে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা সম্পূর্ণ শেষ করে নির্বাচন ফ্রি, ফেয়ার করতে পারেন তাতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। মাস আমাদের কাছে ফ্যাক্টর নয়। সংস্কারটা পূর্ণ করে নির্বাচন ফেয়ার হবে কিনা, সেটার জন্য যে মাস লাগে তাতে আমরা প্রস্তুত আছি।
সেক্রেটারি জেনারেল বলেন, ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯১(এ) অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল দাবি করা হয়েছে। রাজনৈতিক উদ্দেশে এ ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছিল।’
‘প্রবাসী ভোটারদের ভোটাধিকার নিশ্চিত, সরকারি চাকরি থেকে অবসরের তিন বছর পূর্ণ না হলে নির্বাচন নয়- এমন বিধানের সুপারিশ করা হয়েছে।’
ডিসেম্বর ধরে ভোটের প্রস্তুতির বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘আমরা বলেছি, সরকার একটি টেনটেটিভ আইডিয়া দিয়েছে। তারা যদি তাদের ঘোষিত সময়ে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা সম্পূর্ণ শেষ করে নির্বাচন ফ্রি, ফেয়ার করতে পারেন, তাতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। মাস আমাদের কাছে ফ্যাক্টর নয়। সংস্কারটা পূর্ণ করে নির্বাচন ফেয়ার হবে কিনা, সেটা জন্য যত মাস লাগে আমরা প্রস্তুত আছি।’
এ জামায়াত নেতা জানান, প্রস্তাবনার মধ্যে প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (পিআর); আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব হারের নির্বাচনব্যবস্থা চালুর সুপারিশ করা হয়েছে। বিশ্বের ৬০টি দেশে এ ব্যবস্থা চালু রয়েছে।
‘পেশিশক্তির প্রভাবমুক্ত রেখে অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য এ ব্যবস্থা দরকার বলে আমরা সুপারিশ করেছি।’
অনিয়মের জন্য ভোট আংশিক বা পূর্ণাঙ্গ বাতিলের ক্ষমতা ফিরিয়ে আনার বিষয়েও সুপারিশ রয়েছে জামায়াতের।
তিনি বলেন, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে ৯১(এ) অনুচ্ছে পুনর্বহাল দাবি করা হযেছে। রাজনৈতিক উদ্দেশে এ ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছিল।’
প্রবাসী ভোটারদের ভোটাধিকার নিশ্চিত, সরকারি চাকরি থেকে অবসরের তিন বছর পূর্ণ না হলে নির্বাচন নয়- এমন বিধানের সুপারিশ করা হয়েছে।
শর্ত পূরণ না হওয়ার যুক্তি দিয়ে এক রিট মামলার রায়ে ২০১৩ সালে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে হাইকোর্ট। তাদের জন্য বরাদ্দ মার্কা দাঁড়িপাল্লা প্রতীকের তালিকা থেকে বাদ দেয় নির্বাচন কমিশন।
জামায়াত আপিল বিভাগে গেলেও ২০২৩ সালে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে দলটির নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সেই আপিল পুনরুজ্জীবনের আবেদন করা হয় জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে। গত ২০ অক্টোবর তা পুনরুজ্জীবিত করার আদেশ দেন সর্বোচ্চ আদালত। ফলে দলটির নিবন্ধন ফিরে পাওয়ার আশা তৈরি হয়।
সেই প্রসঙ্গ ধরে এক প্রশ্নে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল বলেন, নিবন্ধনের বিষয়ে তারা আদালতে ‘ন্যয়বিচার’ পাবেন বলে আশা করছেন। তিনি বলেন, ‘নিবন্ধন আইনে এত কঠিন শর্ত আরোপ করা হয়েছে। এ কঠিন শর্ত পূরণ করে (নিবন্ধন করা) রাজনৈতিক অধিকার খর্ব করা হয়েছে। এ আইনটা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এটা বাতিল করতে হবে। দল ও রাজনীতি করার অধিকার সবার।’ এক প্রশ্নের জবাবে জামায়াতের সেক্রেটারি বলেন, ‘নিবন্ধনের কোনো প্রয়োজনই নেই। দল হলেই নির্বাচন (করবে)। ২০০৮ সালের আগে নিবন্ধন আইনই ছিল না। এসব করে রাজনৈতিকভাবে দল ও রাজনীতি করার অধিকার ক্ষুণ্ণ করা হয়েছে। এ আইন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।