মইনুল ইসলাম মিতুল: প্রমত্তা পদ্মার বুকে এখন স্বগর্বে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসের দীর্ঘতম সেতু- স্বপ্নের পদ্মা সেতু। দেশ-জাতির সক্ষমতার প্রতীক পদ্মা সেতু এখন উদ্বোধনের পালা। আর মাত্র ১০ দিন পরই খুলে দেওয়া হবে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণ বাংলাকে এক সুতোয় গেঁথে দেওয়া এই সেতুটি। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানকে উৎসবে রূপ দিতেই এখন সব ব্যস্ততা। সেতুর দুই পাড়েই শুধু নয়, উৎসব ছড়িয়ে দেওয়া হবে দেশজুড়ে। তাই প্রতিদিনই সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সেতু এলাকা পরিদর্শনে যাচ্ছেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সফল করতে কার কী দায়িত্ব তা বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে। টুকটাক যেসব কাজ বাকি আছে, তাও আগামীকালের মধ্যে শেষ হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। গতকাল সোমবার মাওয়া প্রান্তে গিয়ে সরেজমিনে দেখা গেছে, পদ্মা সেতুকে সাজিয়ে-গুছিয়ে নিতে শেষ মুহূর্তের কর্মযজ্ঞ। অন্য দিকে দেখা গেছে পদ্মা সেতু দেখতে আসা উৎসুক মানুষের ভিড়।
দুর্নীতিচেষ্টার ভিত্তিহীন অভিযোগ এনে বিশ্বব্যাংকের মুখ ফিরিয়ে নেওয়া, রাজনৈতিক বাদানুবাদ, গুজব, প্রাকৃতিক প্রতিকূলতাসহ নানা বাধা জয় করে বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত পদ্মা সেতু এখন ঐতিহাসিক বাস্তবতা।
৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই পদ্মা সেতু নির্মাণ করে বিশ্বকে নিজের সক্ষমতা জানান দিয়েছে বাংলাদেশ। আগামী ২৫ জুন সেতু উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেতুর দুই পাড়ে তিনি নানা আনুষ্ঠানিকতায় অংশ নেবেন। পরে মাদারীপুরের শিবচরে রাজনৈতিক সমাবেশে অংশ নেবেন প্রধানমন্ত্রী।
সরেজমিনে দেখা গেছে, উদ্বোধন অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে সেতুকে। শেষ মুহূর্তের কাজ চলছে জোরেশোরেই। মূল সেতুর লাইট লাগানোর কাজ শেষ পর্যায়ে। কিছু কিছু জায়গায় ধোয়া-মোছার কাজ চলছে। নিরাপত্তা ব্যবস্থাও খতিয়ে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। সেতু উদ্বোধন ঘিরে দুই পাড়ের মানুষের মধ্যে দেখা গেছে বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনা। এতে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উৎসুক মানুষের ঢল সামাল দেওয়া নিয়েও আলোচনা চলছে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে।
সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, মাওয়ায় সুধী সমাবেশের স্থান, দুই প্রান্তের ম্যুরাল ও ফলক উন্মোচনের স্থানসহ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেসব স্থানে যাবেন, এর সবকটি ঘুরে দেখছেন সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা।
সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের দিন দুই পাড়ে অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা থাকবে। জরুরি স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজন হলে দুই পাড়েই পদ্মা সেতু প্রকল্পের অধীন পুনর্বাসন এলাকার পাঁচটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র ব্যবহার করা হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, উদ্বোধনী অনুষ্ঠান উপলক্ষে সেতু বিভাগ ১৮টি উপকমিটি করেছে। এসব কমিটি প্রতিদিনই নিজেদের মধ্যে বৈঠক করছে। এর মধ্যে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য এরই মধ্যে প্রায় তিন হাজার অতিথির তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তাদের প্রত্যেকের জন্য দাওয়াতপত্র তৈরির কাজ চলছে।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের জন্য প্রস্তুত। এখন সবকিছু ঠিকঠাক আছে কি না তা পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। কোনো সমস্যা থাকলে তা সমাধান করা হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পদ্মা সেতু উদ্বোধনকে ঘিরে বর্ণাঢ্য আয়োজন করতে যাচ্ছে সরকার ও ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচিতে পদ্মা সেতু যুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগ। সারা দেশে ২৩ জুন প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী এবং ২৫ জুন পদ্মা সেতুর উদ্বোধন যুগপৎভাবে পালন করবে দলটি।
পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হবে খুবই জমকালো। মূল উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ৬৪টি জেলাতেও দেখানোর ব্যবস্থা থাকবে। অর্থাৎ দেশজুড়ে উৎসব পালন করা হবে। ২৫ জুন সকাল ১০টায় মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর সেতু পেরিয়ে জাজিরা প্রান্তে যাবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ প্রান্তের টোল প্লাজার সামনে উদ্বোধনী ফলক উন্মোচনের পর তিনি যোগ দেবেন দলীয় জনসভায়। মাদারীপুরের শিবচরের কাঁঠালবাড়ীতে উদ্বোধনী জনসভার মঞ্চটি করা হচ্ছে পদ্মা সেতুর আদলে। এরই মধ্যে ঢাকা ও পদ্মার দুই পাড়ের জেলাগুলোর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন। জনসভায় ১৫ থেকে ২০ লক্ষাধিক লোকের উপস্থিতি প্রত্যাশা করছে আওয়ামী লীগ।
দলীয় সূত্র মতে, প্রথমে নৌকার আদলে জনসভার মঞ্চ করার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর আদলে মঞ্চ তৈরির নির্দেশনা দিয়েছেন। ফলে শুধু পদ্মা সেতু উদ্বোধনই নয়, মঞ্চেও চমক থাকবে পদ্মার।
মঞ্চের সামনে থেকে দেখে মনে হবে অবিকল পদ্মা সেতুর ওপর মূল জনসভা করা হচ্ছে। পদ্মা সেতু যে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সাহসের প্রতীক তা প্রমাণ করতেই এ উদ্যোগ বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা। জনসভার পর ফানুস উড়ানো থেকে শুরু করে জমকালো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। সেতুর পাশাপাশি সাজানো হচ্ছে দুই পাড়ের পুরো এলাকা। এ দিন নদীতেও থাকবে সুসজ্জিত নৌকা। ক্ষমতাসীনদের প্রত্যাশা, শুধু পদ্মা সেতুর দুই পাড়ের মানুষই নয়, উদ্বোধনের দিন সারা দেশের মানুষ এই আনন্দ উৎসবে অংশ নেবে। কেউ সমাবেশস্থলে এসে, আবার কেউ টেলিভিশনের মাধ্যমে, আবার কেউ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উৎসবে মেতে উঠবেন। পাশাপাশি দেশের প্রতিটি জেলা-উপজেলা, ইউনিয়ন পর্যন্ত আনন্দ মিছিল, শোভাযাত্রা, আতশবাজিসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আনন্দ উৎসব করা হবে।
উদ্বোধনের আগে সেনাবাহিনী মূল সেতু এলাকায় কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু দেখতে আসা মাইমুনা আক্তার বলেন, ‘পদ্মা সেতু হয়ে গেছে শুনে দেখতে আসলাম। কিন্তু নৌকাতেও সেতুর নিচে যেতে দিচ্ছে না। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে। তাও অনেক ভালো লাগছে। গর্বে বুকটা ভরে যাচ্ছে। আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানাই।’
পদ্মা সেতু সর্বশেষ অবস্থা জানাতে রবিবার সেতু এলাকাসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ড সরেজমিনে পরিদর্শন করেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ নুর-ই-আলম চৌধুরী, পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীমসহ একটি প্রতিনিধি দল।
সেতুর সর্বশেষ পরিস্থিতি জানিয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা এই সেতু নির্মাণ করে বিশ্বকে জানিয়ে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ দুর্নীতি করে না। তিনি বলেন, এই সেতু আমাদের সামর্থ্য ও সক্ষমতার সেতু। এই সেতু এক দিকে সম্মান ও মর্যাদার প্রতীক, অন্য দিকে তথাকথিত দুুর্নীতির কথা বলে যে অপমান করা হয়েছে, সেই প্রতিশোধের সেতু।
তিনি জানান, পদ্মা সেতু উদ্বোধন উপলক্ষে ২৫ জুন সকাল ১০টায় মাওয়া প্রান্তে কূটনৈতিকসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষদের নিয়ে সুধী সমাবেশ করা হবে। এখানে পদ্মা সেতুর ফলক উন্মোচন করা হবে। বেলা ১১টার পর শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু পাড়ি দিয়ে ওপারে আরেকটি ফলক উন্মোচন করবেন। তারপর কাঁঠালবাড়ীতে লাখ লাখ মানুষের সমাবেশে দেশবাসীর সামনে কথা বলবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।