অভ্যুত্থানের
পরের চার মাসে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ছেড়ে ইউরোপের শীর্ষ অর্থনীতি জার্মানির
নাগরিকত্ব নেয়া হয়েছে সবচেয়ে বেশি। যদিও দেশটিতে দ্বৈত নাগরিকত্বের সুযোগ আছে। এ
তালিকায় পরের অবস্থানে আছে জার্মানির প্রতিবেশী অস্ট্রিয়া এবং পূর্ব ও
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ সিঙ্গাপুর। গত বছরের আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১৩২ জন
জার্মান নাগরিকত্বের অনুকূলে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছেন। এ দেশের
নাগরিকত্ব ছেড়ে অস্ট্রিয়ার নাগরিকত্ব নিয়েছেন ৪৫ জন। এছাড়া ১৪ জন চীনের বিশেষ
প্রশাসনিক অঞ্চল হংকংয়ের, চারজন সিঙ্গাপুরের ও দুজন ভারতের নাগরিকত্বের অনুকূলে
বাংলাদেশী নাগরিকত্ব পরিত্যাগ করেছেন।
বিধান অনুযায়ী বাংলাদেশের নাগরিকত্ব
পরিত্যাগ করতে হলে দেশে অবস্থান করে বা যে দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করা হয়, সেখানে
থেকেই বাংলাদেশী দূতাবাসের মাধ্যমে এজন্য আবেদন করা যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই
সরকার নাগরিকত্ব পরিত্যাগের বিষয়টি মঞ্জুর করে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষাসেবা
বিভাগের যুগ্ম সচিব (বহিরাগমন-২ অধিশাখা) নাসরিন জাহান বলেন, ‘মূলত নাগরিকত্ব পরিত্যাগের আবেদনগুলো আসে
বিভিন্ন দেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে। তাদের সুপারিশের ভিত্তিতেই
নাগরিকত্ব পরিত্যাগের আবেদন গ্রহণ করা হয়। যারা নাগরিকত্ব পরিত্যাগ করেন, তাদের
পুরো বিষয়টিই দূতাবাস থেকে যাচাই-বাছাই করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়ার জন্য আমাদের
কাছে পাঠানো হয়।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত এক বছরে
বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পরিত্যাগকারীদের মধ্যে সিংহভাগই অভিজাত ধনী। তাদের মধ্যে
বিগত সরকারের আমলের কয়েকজন অলিগার্কও রয়েছেন। শেখ হাসিনার পতনের পর দেশ থেকে অর্থ
পাচারসহ নানা আর্থিক অপরাধের দায়ে শাস্তি এড়াতেও কেউ কেউ বাংলাদেশের নাগরিকত্ব
ত্যাগ করেছেন বলে কথিত আছে। আবার দক্ষ কর্মীর ক্যাটাগরিতে বিদেশে অভিবাসন
গ্রহণকারীরা সংশ্লিষ্ট দেশের শ্রমবাজারে একক নাগরিকত্বের সুবিধা নিতে বাংলাদেশের
নাগরিকত্ব ত্যাগের নজিরও আছে অনেক। আবার নিরাপত্তাহীনতা ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি
ক্রমাবনতিও অনেকের নাগরিকত্ব পরিত্যাগের সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলতে পারে বলে অভিমত
রয়েছে।
বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ত্যাগকারীদের
অন্যতম সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান আজিজ খান। বিগত সরকারের আমলে ক্ষমতাঘনিষ্ঠ
অলিগার্ক হিসেবে পরিচিত তিনি। দীর্ঘদিন ধরেই সিঙ্গাপুরে স্থায়ী নিবাসী (পারমানেন্ট
রেসিডেন্ট) হিসেবে বসবাস করে আসছিলেন তিনি। তবে তার নাগরিকত্ব ছিল বাংলাদেশের।
কিছুদিন আগেই তিনি সিঙ্গাপুরের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন। দেশটির আইনে দ্বৈত
নাগরিকত্বের কোনো সুযোগ নেই। এজন্য গত বছর বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছেন
আজিজ খান।
সিঙ্গাপুরের নাগরিকত্ব গ্রহণকারী
অলিগার্কদের আরেকজন এস আলম গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা সাইফুল আলম মাসুদ, যিনি এস আলম
হিসেবেও পরিচিত। গত নভেম্বরে এস আলম ও তার পরিবারের সদস্যদের পক্ষে বাংলাদেশ
ব্যাংকে তাদের আইনজীবীদের পাঠানো একটি চিঠির তথ্য দেশী-বিদেশী গণমাধ্যমে প্রকাশ
হয়। চিঠিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করার হুমকি দিয়ে
বলা হয়, ১৯৮০ সালে বাংলাদেশের বিদেশী বেসরকারি আইন অনুসারে সিঙ্গাপুরের নাগরিক
হিসেবে এস আলম ও তার পরিবারের অধিকার ও সুরক্ষা আছে। বিনিয়োগকারী হিসেবে নিজেদের
অধিকার রক্ষা করতে এস আলমের পক্ষ থেকে সব ধরনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। শুধু
আন্তর্জাতিক সালিশি মামলা নয়, প্রয়োজনে অন্যান্য ব্যবস্থাও নেয়া হবে।
তবে এস আলম সিঙ্গাপুরের নাগরিকত্ব কবে
গ্রহণ করেছেন, সে বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি।
প্রসঙ্গত, কেউ সিঙ্গাপুরের নাগরিকত্ব
পেতে চাইলে তাকে আগে বর্তমান নাগরিকত্ব ত্যাগ করে এর তথ্যপ্রমাণ স্থানীয়
কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিতে হয়। এর পরই তিনি দেশটির নাগরিক হওয়ার সুযোগ পান।
সিঙ্গাপুরের আইনে দ্বৈত নাগরিকত্ব রাখার সুযোগ না থাকায় ওই ব্যক্তিকে আগে
বাংলাদেশের পাসপোর্ট হস্তান্তর করতে হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র
মন্ত্রণালয় থেকে একটি অনুমোদন নিতে হবে যে তিনি সিঙ্গাপুরের নাগরিকত্ব নেবেন এবং
তিনি আর বাংলাদেশের নাগরিক নন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের আর্থসামাজিক
পরিস্থিতি, নিরন্তর রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতির কারণে আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান ও
উচ্চদক্ষতার ব্যক্তিদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদে বা স্থায়ীভাবে বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা
বেড়েছে। আবার বিচার এড়াতেও বিগত সরকারের আমলে সুবিধাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের নাগরিকত্ব
ত্যাগের প্রবণতা বাড়তে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি
ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘তারা কেন নাগরিকত্ব ত্যাগ করছে সেটি তো
অনুমান করে বলা যাচ্ছে না। একেকজনের কারণটা একেক রকম হতে পারে হয়তো। তবে মোটা দাগে
আমার যেটা মনে হয়, বিগত সরকারের আমলের অলিগার্করা বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে যুক্ত
ছিলেন। তাদের অনেকেরই বিচার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। অনেকেই বিদেশে পালিয়েছেন। ফলে
বিচার থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যও অনেকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ করতে পারেন। কারণ
বাংলাদেশের নাগরিক না হলে তাদের দেশে ফিরিয়ে আনা বা বিচারের মুখোমুখি করা একটু
কঠিন এবং লম্বা প্রক্রিয়া।’
অনেকটা একই বক্তব্য অভিবাসন ও
শরণার্থীবিষয়ক বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীরেরও। তিনি বলেন, ‘যখন রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়, বিশেষ করে সে সময় যদি নিরাপত্তার
ইস্যু থাকে তখন এ ধরনের ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। এখনকার সময়ে বিষয়টি প্রায় একই।
প্রথমত, যারা নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছে, তারা মনে করছে বাংলাদেশে থাকা নিরাপদ না।
যেহেতু একটা আইনি প্রক্রিয়া আছে, সুযোগও আছে, সে সুযোগটা তারা নিচ্ছে। এখন এ সুযোগ
অনেকেই নিতে পারবে না। আমরা এ-ও দেখেছি যে অনেকেই বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন,
তারা পারেননি। কিন্তু ব্যবসায়ীসহ অনেকের ক্ষেত্রে সে সুযোগটা আছে। কেননা তাদের
পরিবারের অনেকেই বিদেশে থাকে। যেটা আমরা শুনেছি বিভিন্ন সময়ে তারা বিপুল পরিমাণ
অর্থ পাচার করেছে, সেখানে ব্যাংকে তাদের প্রচুর অর্থ আছে। যেকোনো সময়ের জন্য এমন
সুযোগ তারা একটা ট্রাম্প কার্ডের মতো হাতে রাখেন। যাতে যেকোনো সংকটের সময় সেখানে
থেকে যেতে পারেন এবং বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ করতে পারেন। নাগরিকত্ব ত্যাগ করার
আরেকটি কারণ হতে পারে যে দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী বা রাজনৈতিক দলের শীর্ষ
সন্ত্রাসীদের দেশে ফেরত আনার প্রক্রিয়াটি বাধাগ্রস্ত হয়। হয়তো রাজনৈতিক পটপরিবর্তন
না ঘটলে তারা থেকেই যেত। তারা যে দেশেই থাকুক না কেন, সংশ্লিষ্ট দেশে নিয়োজিত
বাংলাদেশ দূতাবাস তাদের কিছুই করতে পারবে না। কারণ তারা পুরোপুরি ওই দেশেরই নাগরিক।
অভিযোগ রয়েছে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের
আমলে অনেক দুর্নীতিবাজ ও নব্য ধনীর বিদেশে অর্থ পাচারের পাশাপাশি পরিবারের সদস্যরা
বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। ওই সরকারের শেষ দিকে বাংলাদেশীদের আরো বেশি দেশের দ্বৈত
নাগরিকত্ব নেয়ার সুযোগ তৈরি করে দেয়া হয়। আর কয়েকটি শীর্ষ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর
কর্ণধার ও তাদের পরিবারের সদস্যরা বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ করে অন্য দেশের
নাগরিকত্ব নিয়েছেন। বর্তমান আইন অনুযায়ী, কোনো বাংলাদেশী অন্য দেশের পাসপোর্ট
(অর্থাৎ নাগরিকত্ব) গ্রহণের পর বাংলাদেশের দ্বৈত নাগরিকত্ব রাখতে না চাইলেও এ দেশে
৭৫ হাজার ডলার স্থায়ী বিনিয়োগ করে সহজেই স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ পান।
বাংলাদেশী নাগরিকত্ব পরিত্যাগের পাশাপাশি
গ্রহণের ঘটনাও রয়েছে। যদিও সেটি সংখ্যায় খুবই কম। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের
তথ্যমতে, ১৯৮৮ সালে প্রথম চারজন বিদেশীকে নাগরিকত্ব দেয় বাংলাদেশ। ১৯৮৯ সালে
নাগরিকত্ব পান ৩৩ বিদেশী। এরপর ২০০৩ ও ২০১০ সাল ছাড়া প্রতি বছরই কিছু না কিছু
বিদেশীকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত মোট ৪৫২ জন বিদেশী নাগরিক
বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পেয়েছেন। তাদের বেশির ভাগই নাগরিকত্ব পেয়েছেন বৈবাহিক
সূত্রে। দীর্ঘদিন ধরে বসবাসের কারণেও বেশ কয়েকজনকে নাগরিকত্ব দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পরিত্যাগকারীরা
কোনো অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত হলে তাদের দেশে ফিরিয়ে বিচারের মুখোমুখি করার
প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে আইনজীবী শিশির মনির বলেন, ‘কোনো অপরাধে অভিযুক্ত হলে সেই অপরাধ
সংঘটনের পর নাগরিকত্ব পরিত্যাগ করলেও তাদের নামে ফৌজদারি মামলা চালাতে কোনো বাধা
নেই। তবে যেসব দেশে মৃত্যুদণ্ড নেই, কিন্তু বাংলাদেশে এ ধরনের শাস্তিযোগ্য অপরাধের
দায়ে বিচারের জন্য বন্দি প্রত্যর্পণ করা যায় না। কেবল যেসব দেশের সঙ্গে বন্দি
প্রত্যর্পণ চুক্তি আছে, সেসব দেশের সঙ্গে বন্দি প্রত্যর্পণ করা যায়। উদাহরণ হিসেবে
বলা যায়, ভারতের সঙ্গে বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি থাকায় ওইসব দেশ থেকে বন্দি আনতে
পারি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুরের সঙ্গে আমাদের বন্দি বিনিময়
চুক্তি না থাকায় বিষয়টি জটিল। যদি কেউ দেশে অভিযুক্ত হওয়ার ভয়ে নাগরিকত্ব ত্যাগ
করে, তাহলে নিশ্চয়ই আন্তর্জাতিক আইনজীবীদের পরামর্শ নিয়েই কাজটি করবে। বিষয়টি নিয়ে
আন্তঃদেশীয় বিবাদ দেখা দিলে তা আইনের জটিল অংশ। এক্ষেত্রে দক্ষ লোকবল ও দক্ষ
কূটনীতিক লাগবে। এমনও হতে পারে, আন্তর্জাতিক আদালতে গিয়েও লড়তে হতে পারে। এটি বেশ
জটিল একটি প্রক্রিয়া।