
মাজহারুল ইসলাম মাসুম. সিনিয়র সাংবাদিক, লেখক, ও গবেষক : মুহাম্মদ ইকবাল তার ‘ইসলামী ধর্মীয় চিন্তার পুনর্গঠন’ শীর্ষক রচনায়
ইসলাম ধর্মের প্রাসঙ্গিকতা, গতিশীলতা- এর ইতিহাস এবং
ধর্মীয় অভিজ্ঞতা তথা এর মর্মকথা ব্যক্ত করতে গিয়ে এই ধর্মতত্ত্বের সাথে আধুনিক
বিজ্ঞান ও দর্শনের সংঘাত এবং ঐক্যকে খোঁজার চেষ্টা করেছেন। মনুষ্যজাতির সামাজিক ও
রাজনৈতিক সংঘাতের আলোকে, নানা তত্ত্ব। জিজ্ঞাসার মধ্যে
ধর্মবোধ এবং এর প্রয়োগ কতটুকু সম্ভব এমন প্রশ্ন রেখেছেন। তিনি যেমন ইসলামের
মরমীবাদকে অনুভবের চেষ্টা করেছেন, তেমনি নানা
ধর্মতত্ত্বের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ পর্যালোচনা করার চেষ্টা করেছেন। এ প্রেক্ষিতে তিনি
জনৈক মুসলিম সুফির বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, ‘পবিত্র কুরআনকে সে-ই সত্যিকার অর্থে বুঝতে পারবে যে কিনা কোরআন
অবতীর্ণ হওয়ার প্রেক্ষিত এবং তার আদিরূপ অনুভব করতে পারবে।’
মূলত নানামুখী লোভ ও স্বার্থচিন্তার সাথে ধর্মচিন্তার সংশ্লেষণটি
কঠিন হওয়ার কারণেই নানা বিতর্কের সূচনা।
লেখক মনে করেন সামাজিক বিশৃঙ্খলার
আবর্তে নানা ধর্মের মত ও সংঘাতের প্রেক্ষাপটে কোরআনের প্রয়োজনীয়তা অতীব
গুরুত্বপূর্ণ ছিল ওই গ্রন্থের অবতীর্ণ হওয়ার সময়টাতে। সকল শান্তি ও শৃঙ্খলার
প্রেক্ষাপটে ভেদজ্ঞান নিরসন ও শান্তি স্থাপনের আলোকে এর মর্মকথার গুরুত্ব সব সময়ের
জন্য প্রযোজ্য। চূড়ান্ত গোঁড়ামি ও শ্রেষ্ঠত্বের অহংকারে নিমজ্জিত ইহুদি ও
কর্তৃত্ববাদী রোমানদের আঘাতে যিশু ও উদীয়মান খৃস্টানগণ যখন ছিন্নভিন্ন হচ্ছে, যিশুর প্রেম ও
করুণাধারায় সিক্ত মানবতাবাদী ধর্ম যখন বিত্তবানদের করায়ত্বে এসে পথহারা হচ্ছে,
তখনই ইসলামের আবির্ভাব। কেবল পথভ্রষ্ট এবং উচ্ছৃঙ্খল আরবদের পথ
দেখাবার জন্য নয়, বেপথু খৃস্টানদের পথের সন্ধান দিতে,
দিকভ্রান্ত চিন্তা এবং অহং এ নিমজ্জিত ইহুদিগনকে একক বিশ্বাসে
আনবার জন্য, একটি ধর্মীয় ইন্টিগ্রেশন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে
ইসলামের আবির্ভাব হয়।
প্রাচীন গসপেলে জন মানবভাতৃত্বের
কথা ব্যক্ত করেছিলেন। হজরত মোহাম্মদ (সা.) ওই আচরণটিকে অধিকতর মানবিক এবং প্রায়গিক
করেছেন। তিনি বিজ্ঞান এবং সামাজিক শৃঙ্খলাকে ধর্মের অঙ্গ করেছেন। অতিশুদ্ধ
ধর্মাবতার চরিত্রের সাথে প্রকৃত জ্ঞানী সমাজসংস্কারক চরিত্রের অপূর্ব সমন্বিত
রূপের প্রকাশ ছিল হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর চরিত্রে। বোধ এবং সামরিক জ্ঞানের এমন
সমন্বয় হয়ত কারও মাঝে প্রকাশিত হয়নি। ধর্মীয় উদ্দেশ্য, রাজনৈতিক
স্বার্থ তথা সামগ্রিক মানবকল্যাণ ও শান্তিকে তিনি এক পাতায় আনতে পেরেছিলেন তার
অসামান্য চরিত্র ও মেধাগুণে। তার অবর্তমানে ইসলাম তার বিজয়ধারা অক্ষুণ্ণ রাখলেও
অহংবোধ ও স্বার্থচিন্তার আবর্তে পরে মূল ধর্মচিন্তা ও স্রোত থেকে অনেকটা সরে যায়
এর প্রবক্তাগণ। ব্যাখ্যাগত দুর্বলতায় আক্রান্ত হলেও খ্রিস্টধর্মের মতো গুরুতররূপে
শিকড়বিচ্যুত হয়নি ইসলাম।
এক্ষেত্রে, লেখক মনে
করছেন, শুরু থেকে ইসলামে নানামুখী চিন্তা প্রাধান্য পেলেও
এক পর্যায়ে তা দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে যায়। একপক্ষে থাকেন কর্তৃত্ববাদী ধর্ম এবং এর
স্থূল তথা কট্টর ব্যাখ্যার প্রবক্তা বলে পরিচিত ইমাম গাজ্জালি ও ইমাম হানিফা
প্রমুখ, অন্যপক্ষে থাকেন ইবনে রুশদ এবং তার অনুসারীগণ।
শাক্ত ও সুযোগসন্ধানীগণ এই কট্টরদের ওপর সওয়ার হয়ে ইসলামের সাম্যবাদে কুঠারাঘাত
করে। শুরু হয় বিরুদ্ধ স্রোত ইসলাম যা সমর্থন করেনা সেই রাজার রাজত্ব।
একেবারে ইসলামের শুরুতে যখন
ইসলামী চিন্তাবিদগণ গ্রিকদর্শনসহ অন্যান্য দর্শন ও বিজ্ঞান পরীক্ষা করছিলেন এবং
ওইসব দর্শন ও বিজ্ঞানের উৎকর্ষ সাধনের চেষ্টা করছিলেন, সে সময় ইমাম
গাজ্জালি একটি গ্রন্থ প্রণয়ন করেন যার নাম ছিল তাহফাতে ফালাসিফা যার অর্থ হলো ওই পর্যায়ে ইবনে রুশদের ধারণা স্পেন ও ইউরোপে
ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। বিশেষ করে, ৬২২ খৃস্টাব্দে
হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর মৃত্যুর পর, ৬৩৪ খৃস্টাব্দে
একদিকে যেমন সিরিয়া বিজয় নিশ্চিত হয়, তেমনি ইসলামী
চিন্তার আধিপত্য সিরিয়া অতিক্রম করে তুর্কিস্থান হয়ে ইউরোপমুখী হয়, অন্যদিকে, শিক্ষা, দীক্ষা,
সংস্কৃতি, শক্তিতে বলবান পারস্য তা
অতিক্রম করে ৬৩৭ খৃস্টাব্দে। পারস্য বিজয় সম্পূর্ণ হলে তা আফগানিস্তান ও হিন্দুকুশ
পর্বতমালা অতিক্রম করে ভারতের মাটিতে আসে ৬৬৪ খৃস্টাব্দে। একইভাবে স্পেনের
কনস্ট্যান্টিনোপল আক্রান্ত হয় ৬৬৯ খৃস্টাব্দে, মিশর পদানত
হয় ৬৪২ খৃস্টাব্দে এবং প্রাচীন সভ্যনগরী কারথেজ পদানত হয় ৬৯৭ খৃস্টাব্দে। ৭১১ থেকে
৭১২ এর মধ্যে স্পেনের অধিকাংশ মুসলিমদের কব্জায় আসে, এরপর
দক্ষিণ ইতালিসহ গ্রিসের সিসিলিও মুসলিমদের পদানত হয়। ৭৩২ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত এই
অভিযাত্রা অপ্রতিরোধ্য থাকে। ১৪৫৩ পর্যন্ত পূর্ব ইউরোপসহ পুরো এই অঞ্চলটি
মুসলিমদের অধীনে থাকে।
লেখক মনে করেন- এই আগ্রাসন ও
রাজ্য বিজয়ের মধ্যে একদিকে ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে প্রাচীন উর ও মেসপটেমিয়ার
সভ্যতার ছোঁয়া বিশেষ করে অংক, জ্যোতির্বিদ্যা ও জ্যামিতি শাস্ত্রের অনুপ্রবেশ
ঘটে, তেমনি গ্রিকদের ন্যায়শাস্ত্র, তর্কশাস্ত্র ও দর্শনের অনুপ্রবেশ ঘটে। ধর্মবিস্তারের সাথে সাথে একদিকে
রোমানদের রাজ্যশাসন এবং দিগ্বিজয়ের কৌশলটিও রপ্ত করে আরবগণ, অপরদিকে প্রাচীন সিরিয়া বা পারস্য সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটে ইসলামের
মাঝে।
এতে করে সুফি ও মরমীবাদের আসন
স্থায়ীভাবে নিশ্চিত হয় ইসলামে। এই সুফিগণই প্রিয় মোহাম্মদ (সা.) এর অনুসারী হয়ে
শুদ্ধ আত্মার অনুসন্ধানে ব্যাপ্ত হয়ে শুদ্ধতাচর্চায় নিমজ্জিত হয়। ঈশ্বরের সাথে
একীভূত হয়ে শুদ্ধতার লক্ষ্যে পথচলা ও পথের আলোয় পথ দেখানোই সুফিবাদ। সুফিবাদে বিশ্বাসীগণকে
সমষ্টিগত বলে আউলিয়া,
যার অর্থ আল্লাহর কাছের মানুষ; ঈশ্বরাশ্রয়ী
এক বন্ধু, যার আত্মার মাঝে দৃশ্যমান বিশ্ব এবং অলক্ষ্য,
অজ্ঞাত, অনন্তের নিত্য খেলা।
এটি ইসলামী ঋষি সংস্কৃতিকেই
প্রকাশ করে। সে অন্তরে যেমন ঈশ্বরের ছায়া ও শক্তি ধারণ করে, তেমনি ঈশ্বরের
প্রতিভূর মনন ও শক্তি ধারণ করে। তিনি রাজা বা প্রভূ নন; তিনি
শুদ্ধতার এক প্রেমময় প্রকাশ।
ইউরোপীয় এবং ইহুদি সম্প্রদায়গুলো
স্পেনে বসবাস করায় ওই অঞ্চলটি একটি সাংস্কৃতিক রন্ধনশালায় পরিণত হয়। অর্থাৎ একে
অপর থেকে গ্রহণ ও বর্জন করছিল ওই স্থানে, অনেকটা সহজ প্রক্রিয়ার মধ্যে। এভাবেই আরবদের
নানা আবিষ্কার, জীবন ও দর্শন পাশ্চাত্যে শেকড় পায়। তবে,
এটি ছিল সেই দর্শন যা ইবনে রুশদ প্রচার করেছিলেন। স্পেনে
অবস্থানকারী সকল মুসলিম দার্শনিক ও পণ্ডিত যে ইবনে রুশদের সাথে একমত পোষণ করেছেন
তা নয়।
ওই সময় রাজ্যবিজয় এবং রাজার
রাজত্ব, রাজার স্বার্থ মুখ্য হয়ে ওঠে। এতে মূল ধর্মচিন্তা, ধর্মীয় স্বার্থ এবং মৌলিক দর্শন অনেক ক্ষেত্রে গৌণ হয়ে ওঠে। এ আলোকে
মূলচিন্তার অনুসারীগণ আপন দর্শন বিস্তারে ভিন্ন পথ খোঁজেন। এরই ধারাবাহিকায় সুফি
দার্শনিক মহীয়ুদ্দীন ইবনুল- আরাবি মন্তব্য করেন, ‘আল্লাহ অনুভূতিস্বরূপ এবং দৃশ্যমান জগৎ একটি প্রত্যয় মাত্র।’
আরেকজন সুফিসাধক ইরাকির মতে স্থান ও কালের মাঝে অবস্থান বহু এবং
বিচিত্র; ‘ঐশীস্থান’
ও ‘ইন্দ্রকালের’
অস্তিত্ব আছে এর মাঝে। এক্ষেত্রে ইকবাল বলেন, ‘এমনও হতে পারে আমরা যাকে বাহ্যিক জগৎ বলি তা আমাদের বুদ্ধির সৃষ্টি, মানবিক বোধ ও
অনুভূতির এমন আরও অনেক স্তর রয়েছে যা সম্পূর্ণ আলাদা স্থান ও কালের সাথে সামঞ্জস্য
রক্ষা করে চলছে।’
এক্ষেত্রে এটা স্পষ্ট যে, ধর্মীয়
অনুভূতির মধ্যে যারা সত্য আবিষ্কারে আগ্রহী হবে তাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও
অনুভূতির ওপর নির্ভর করতে হয়। লেখক মনে করেন যে, এসব
বিষয়ে অপরকে সম্পূর্ণ জানা ও জানানো কখনোই সম্ভব নয়। মধ্যযুগীয় আধ্যাতিক সাধনা বা
সনাতন সত্যজিজ্ঞাসা পদ্ধতি আদিম এবং মহাসত্য আবিষ্কারের পথে, এটি বিগ্ন বৈ কিছু নয়; তবে তিনি এটাও বলেন,
‘সন্ধান নিরর্থক নয়।’
লেখক নিজে মনে করেন, এ ধরনের
চিন্তা চেতনার মধ্যে একটি তৃপ্তি ও শান্তি থাকলেও এর ভ্রান্তির চোরাবালি
প্রগতিমুখী চিন্তা বা বিজ্ঞাননির্ভর চিন্তাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। গভীরতম জ্ঞান
ও মৌলিক আবিষ্কারের পেছনে চর্চিত পাঠ ও কগনিটিভ জ্ঞানের মতো বিভূতির ভূমিকা কম নয়।
মহাবিশ্ব তথা সকল সৃষ্টির শুরু
শূন্য থেকে, ব্যাখ্যাতীত উৎস বা আধার থেকে উৎসারিত শক্তি থেকে। আর সে শক্তির পেছনে
যদি ঈশ্বর বা স্রষ্টাকে অনুভব করি তার অর্থ দাঁড়াবে- তার হতে শুরু এবং সেখানেই
পরিসমাপ্তি। আমরা আছি সেই যাত্রাপথে- নদীর স্রোতে। তিনি সকল কার্যকারণের নিয়ন্ত্রক,
সকল কিছুর স্রষ্টা এবং বিনাশকর্তা।
সৃষ্টি, বিনাশ,
কর্ম এবং কর্মফল সবকিছুর পেছনে রয়েছে কার্যকারণ। এই কার্যকারণের
কিছু ব্যাখ্যা দিয়েছেন হজরত আব্দুল কাদের জিলানি, তাঁর ‘ফতুহুল গায়েব’ গ্রন্থে। এসব
কথা স্পষ্ট হয়েছে মাওলানা রুমীর অনবদ্য রচনাতেও।
পবিত্র কোরআনের আয়াতে বলা হয়েছে- ‘ইয়া হাইয়্যু হিনা লা-হাইয়্যু ফীদাইমু মিয়্যাতি মুলকিহী ওয়া বাকাইহী
ইয়া হাইয়্যু।’ অর্থাৎ- ‘হে চিরজীবী (আল্লাহ)! যে সময় তোমার রাজত্বের স্থায়িত্বে ও
অস্তিত্বে কিছুই বর্তমান ছিল না, সে সময়ও তুমি বর্তমান ছিলে; হে চিরজীবী।’
এর মাঝে মহাবিশ্বের সৃষ্টি, বিস্তার,
বির্বতন ও সময়ের প্রসারণের কথা বলা রয়েছে এটা অসাধারণ ইনট্যুইটিভ
জ্ঞান তথা সত্যের প্রকাশ।