মাজহারুল ইসলাম মাসুম :
শুস্বাগতম ২০২৩। জীবনের
গতিপ্রবাহকে বাঁধ দিয়ে ভবিষ্যৎ স্রোতকে রুদ্ধ করা যায় না। সময় ও স্রোতের মতো
জীবনটাও ঠিক তেমনই সতত চলমান। জীবনের শেষ গন্তব্য মৃত্যু। তার আগে সর্বাবস্থায়
জীবনের স্পন্দন অনুভব করা যায়। জীবনের শেষবিন্দু মৃত্যু পর্যন্ত পৌঁছানোর আগে
জীবনঘড়ি টিক টিক চলতেই থাকে।
২০১৯
থেকে মানবসভ্যতা এক কঠিন সময় পাড়ি দিয়ে চলেছে। বৈশ্বিক ক্রান্তিকাল। কখনো মহামারি
করোনা। লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু। করোনার ধাক্কা শেষ হতে না হতেই যুদ্ধের ধাক্কা।
রাশিয়া-ইউক্রেন আঞ্চলিক যুদ্ধ। কিন্তু বৈশ্বিক প্রভাব সারা দুনিয়ায়।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে সমগ্র বিশ্ব টালমাটাল।
বিদায়ী
বছরের প্রাপ্তি এবং নতুন বছরের সম্ভাবনা নিয়ে আরো কিছু কথা বলার আগে ইংরেজি নববর্ষ
উদযাপনের ইতিহাসটায় সংক্ষেপে একটু চোখ বুলিয়ে নেয়া যেতে পারে। যারা নিউইয়র্কে
বসবাস করে, বিশেষভাবে তারা ৩১ ডিসেম্বর পুরোনো বছরকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরকে
স্বাগত জানাতে হাজার হাজার নারী-পুরুষ মধ্যরাতে সমবেত হয় ঐতিহাসিক টাইমস স্কয়ারে।
সেখানে রাত ঠিক ১২টা ১ মিনিটে আপেল পতনের দৃশ্য অবলোকন করা আমেরিকার একটি প্রাচীন
ঐতিহ্য। নতুন বছরকে স্বাগত জানানো শুরু হয় এই আপেল পতন উৎসবের মধ্য দিয়ে। সমবেত
সবাই হাতে হাত ধরে নববর্ষের সংগীত গাইতে গাইতে চোখের পলক না ফেলে দেখতে থাকে আপেল
পতন। সেকেন্ডের কাঁটা ১২টা স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে হর্ষধ্বনি দিয়ে সবাই ২০২২-কে
বিদায় জানিয়ে বরণ করে নেবে ২০২৩-কে।
মানুষ আসলে অতীতের সব আবর্জনা জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে
সামনের সম্ভাবনাকে ধরতে চায়। মানুষ স্বপ্ন দেখে ভবিষ্যতের। কোনো মানুষেরই সব
স্বপ্ন-সাধ ফেলে আসা বছরে পূরণ হয় না। অপূর্ণ স্বপ্ন, অপূর্ণ বাসনা-অপ্রাপ্তি
সব সে পূরণ করতে চায় ভবিষ্যৎকে সামনে রেখে। অনাগত দিন মানুষকে সতত আশাবাদী করে
রাখে।
সে
কারণেই নববর্ষ বরণে মানুষের মধ্যে এত উচ্ছ্বাস-উৎসবের আনন্দ। এত রীতিনীতি। দেশে
দেশে আচার অনুষ্ঠানে নানা বৈচিত্র্য। ১ জানুয়ারি বিশ্বের অধিকাংশ দেশে নববর্ষ
উদযাপিত হলেও সব দেশে উদযাপিত হয় না। অধিকাংশ দেশ যারা ১ জানুয়ারি নববর্ষ উদযাপন
করে,
তারা
মডার্ন গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার মেনে চলে। তবে এর ব্যতিক্রম আছে। ১০ মাসেও বছর আছে।
রোমান ক্যালেন্ডারে ১০ মাসে বছর এবং সে বছর শুরু হয় মার্চ থেকে। ১ জানুয়ারি থেকে
যে বর্ষ গণনা শুরু হয়, সেটিই বিশ্বের প্রাচীনতম এবং সর্বজনীনভাবে উদযাপিত উৎসব। জুলিয়ান
ক্যালেন্ডারেও ১ জানুয়ারি নববর্ষ উদযাপিত হয়।
ইংরেজি
নববর্ষ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখন এমন বর্ণাঢ্য রূপ এবং বিশাল কলেবরে উদযাপিত হয় যে, তাদের নিজস্ব নববর্ষের
উদযাপনও এর কাছে ম্লান হয়ে যায়। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম দেখা যায় না। ইংরেজি
নববর্ষের হুল্লোড় ঠেকাতে বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অনেক রকম
ব্যবস্থা নিতে হয়। অনেক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটার কথাও শোনা যায়। প্রবাসেও বাঙালি
কমিউনিটিকে প্রতিবার ইংরেজি নববর্ষের উৎসবে মেতে উঠতে দেখা যায়। বিশ্বজুড়ে
আমেরিকার সাংস্কৃতিক আধিপত্য যে এখনো অটুট, তা দেশে দেশে ইংরেজি নববর্ষ উদযাপনের আতিশয্য দেখেই অনুভব করা যায়।
গ্লোবাল ভিলেজের মোড়ল যুক্তরাষ্ট্র এখনো তার প্রভাব বহাল রেখেছে যেমন, বিশ্বে সাংস্কৃতিক
আধিপত্যও যুক্তরাষ্ট্রের হাতেই রয়েছে।
বাংলাদেশ
এবার নববর্ষ উদযাপন করছে বিশেষ রাজনৈতিক উত্তাপের মধ্য দিয়ে। ২০২৪-এর জানুয়ারির
শুরুতেই জাতীয় সাধারণ নির্বাচন। সেই নির্বাচন ঘিরেই এই উত্তেজনা। বাংলাদেশের মানুষ
জানে না, তারা ২০২২-এর মতো ২০২৩-কে বিদায় জানাতে পারবে কি না। বাংলাদেশে
একটি প্রবাদ আছে, ‘যায় দিন ভালো, আসে দিন খারাপ।’ আমরা যে দিনটাকে বিদায় জানিয়ে যে দিনকে বরণ করে নিই, সে দিনটি বিদায়ী দিনের
চেয়ে ভালো হয় না। অর্থাৎ আমরা ক্রমাগতভাবে খারাপের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। আমরা সবাই
সামনে এগিয়ে যেতে চাই। কিন্তু ক্রমাগতভাবে যেন পিছিয়েই যাচ্ছি। যারা আমরা মানুষকে
ভালোর প্রতিশ্রুতি দিই, অঙ্গীকার করি, তারাও কেন যেন নিজেদের প্রতিশ্রুতি শেষ পর্যন্ত রক্ষা করার সাফল্য
অর্জন করতে পারি না।
কে জানে এই ব্যর্থতার জন্য দায়ী আজকের সময়ে উৎসবও মুনাফার অংশ হয়ে গেছে কি না! এখন সব উৎসবই অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। তাই নির্মল আনন্দের জায়গা নিয়ে নিচ্ছে অর্থনীতি। শত শত কোটি টাকা বিনিয়োগ করছেন ব্যবসায়ীরা মুনাফার আশায়। সে কারণে তাদের উৎসবের চেয়ে বাণিজ্যের দিকে বেশি লক্ষ রাখতে হয়। তবে সবাই প্রত্যাশা করে অর্থনীতি ও বিনোদনের মধ্যে একটা ভারসাম্য রক্ষা পাক। মানুষ আনন্দ লাভ করুক। ব্যবসায়ীরাও বাণিজ্যে লাভবান হোক।
লেখক :
সিনিয়র সাংবাদিক, লেখক,ও গবেষক ( সিনিয়র বার্তা প্রয়োজক একাত্তর টেলিভিশন )