প্রচারেঃ-মোতালিব শেখ আল মাইজভান্ডারি
ক. হাযির-নাযির বলতে কী বুঝায় ?
সুপ্রিয় পাঠকবৃন্দ,,,,,,,,,,,,,,,,
‘হাযির’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো- সামনে উপস্থিত থাকা, অনুপস্থিত না থাকা। ‘নাযির’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো- দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তি, দ্রষ্টা, চোখের মণি, নাকের রগ, চোখের পানি ইত্যাদি। আর হাযির ও নাযির-এর পারিভাষিক র্অথ হলো-
(১) পবিত্র ক্ষমতা সম্মপন্ন ব্যক্তি একই স্থানে অবস্থানপূর্বক সমগ্র জগতকে নিজ হাতের তালুর মত দেখা।
(২) দূরে-কাছের আওয়াজ শুনতে পারা, অথবা এক মুহুর্তে সমগ্র ভ্রমণ করার ক্ষমতা রাখা। অনেক দূরে অবস্থানকারী বিপদগ্রস্থকে সাহায্য করতে পারা। এক্ষেত্রে আসা-যাওয়া রুহানীভাবে অথবা রুপক শারীর নিয়ে বা আসল দেহ নিয়ে হতে পারে।
উদাহরণ স্বরূপ দেখুন হযরত ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) রাসূল (ﷺ) থেকে বর্ণনা করেছেন-
حَيَاتِي خَيْرٌ لَكَمْ تُحْدِثُونَ وَيُحَدَثُ لَكَمْ، وَوَفَاتِي خَيْرٌ لَكَمْ تُعْرَضُ عَلَيَّ أَعْمَالُكُمْ، فَمَا رَأَيْتُ مِنْ خَيْرٍ حَمَدَتُ اللَّهَ عَلَيْهِ، وَمَا رَأَيْتُ مِنْ شَرٍّ اسْتَغْفَرْتُ اللَّهَ لَكَمْ -
‘‘আমার হায়াত তোমাদের জন্য উত্তম বা নেয়ামত। কেননা আমি তোমাদের সাথে কথা বলি তোমরাও আমার সাথে কথা বলতে পারছ। এমনকি আমার ওফাতও তোমাদের জন্য উত্তম নেয়ামত। কেননা (আমার ওফাতের পর) তোমাদের আমল আমার নিকট পেশ করা হবে এবং আমি তা দেখবো। যদি তোমাদের কোন ভাল আমল করতে দেখি তাহলে আমি তোমাদের ভাল আমল দেখে আল্লাহর নিকট প্রশংসা করবো, আর তোমাদের কোন মন্দ কাজ দেখলে আল্লাহর কাছে (তোমাদেও পক্ষ হয়ে) ক্ষমা প্রার্থনা করবো।’’
🔴(ক.বায্যার, আল-মুসনাদ, ৫/৩০৮পৃ. হাদিসঃ ১৯২৫, সুয়ূতি, জামিউস সগীর, ১/২৮২পৃ. হাদিসঃ ৩৭৭০-৭১, ইবনে কাছির, বেদায়া ওয়ান নিহায়া, ৪/২৫৭পৃ. মুত্তাকী হিন্দী, কানযুল উম্মাল, ১১/৪০৭পৃ. হাদিসঃ ৩১৯০৩, ইমাম ইবনে জওজী, আল-ওফা বি আহওয়ালি মোস্তফা, ২/৮০৯-৮১০পৃ., ইবনে কাছির, সিরাতে নববিয়্যাহ, ৪/৪৫পৃ.)
এ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হল নবীজি (ﷺ) আমাদের ভাল, মন্দ সব কিছুই দেখতেছেন এবং দেখতে থাকবেন।
ইমাম নুরুদ্দীন ইবনে হাযার হাইসামী (رحمة الله) বলেন-
رَوَاهُ الْبَزَّارُ، وَرِجَالُهُ رِجَالُ الصَّحِيحِ.
‘‘হাদিসটি ইমাম বাযযার (رحمة الله) বর্ণনা করেছেন আর সনদের সমস্ত রাবী বুখারীর সহিহ গ্রন্থের ন্যায় বিশুদ্ধ।’’
🔴(ইমাম হাইসামী, মাযমাউয যাওয়াইদ, ৯/২৪পৃ. হাদিস নং. ১৪২৫০, মাকতুবাতুল কুদসী, কায়রু, মিশর।)
━━━━━━━━━━━━━━━━
খ. হাযির-নাযির আল্লাহ না রাসূল?
আল্লাহকে হাযির-নাযির বলা যাবে না। আহলে হাদিসদের মতো আল্লাহ আরশে আযীমে সমাসীনও বলা যাবে না। কেননা আল্লাহ স্থান কাল থেকে মুক্ত। মহান আল্লাহ সমস্ত জগত বেষ্টন করে রয়েছেন; তাকে কোন সৃষ্টি বেষ্টন করতে পারে না।
মহান রব পবিত্র কুরআনে বলেছেন-
إِنَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ مُحِيطٌ
‘‘নিশ্চয় তিনি সব কিছুকে বেষ্টন করে আছেন।’’
(সুরা হা-মীম সিজদাহ, ৫৪)
অনেকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে হাযির নাযির অস্বীকার করতে গিয়ে বলেন হাযির নাযির আল্লাহর গুণ। কিন্তু আহলে হাদিসদেরই মাযহাব আল্লাহ সব জায়গায় হাযির-নাযির নয়; বরং আরশে সমাসীন কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হাযির-নাযির অস্বীকার করতে গিয়ে তাদের নিজস্ব মতবাদ ভুলে যান। আর দেওবন্দীরা তাদের বিভিন্ন আক্বায়েদের কিতাবে লিখে থাকেন যে, আল্লাহ স্থান, কাল, আকার, আকৃতি থেকে মুক্ত। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হাযির-নাযির অস্বীকার করতে গিয়ে তারা আবার বেঁকে বসে এবং মুতাযিলা ও ক্বাদরিয়া ফিরকার আক্বিদা পোষণ করেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো তারও আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের অনুসারী বলে দাবী করে। ইমাম জুরজানী (رحمة الله) বলেন-
أنه تعالى ليس في جهة، ولا في مكان.
-‘‘মহান আল্লাহ কোনো দিকে বা স্থানে নন।’’
🔴(ইমাম জুরজানী, শরহুল মাওয়াকিফ, ২/৫১-৫২পৃ., সাফর বিন আবদুর রাহমান আল-হাওলী, মিনহাজুল আশাইরাহ, ৭৯পৃ. (শামিলা))
ইমামে আহলে সুন্নাহ আবূ মানসূর মাতুরিদী 🔴(ওফাত.৩৩৩হি.) বলেন-
وقالت القدرية و المعتزلة أن الله تعالى فى كل مكان
-‘‘বাতিল ফিরকা মুতাযিলা ও ক্বদরিয়াগণ বলেন, আল্লাহ সব স্থানে উপস্থিত।’’
🔴(ইমাম মাতুরিদী, শরহুল ফিকহুল আকবার, ১৯পৃ.)
ইমাম ইবনে জারীর আত্-তবারী (رحمة الله) বলেন-
لا يتمكن في كلّ مكان.-
‘‘তিনি সব স্থানে নন।’’ তাই আমরা কী বলবো সে প্রসঙ্গে
🔴(ইমাম তবারী, তাফসীরে তবারী, ৬/২১০পৃ.)
ইমাম কুরতুবী আন্দুলুসী (رحمة الله) বলেন-
وأنه في كل مكان بعلمه،-
‘‘নিশ্চই মহান রবের জ্ঞান সকল স্থানে উপস্থিত।’’ 🔴(ইমাম কুরতুবী, হিদায়া ইলা বুলুগুল নিহায়া, ১/১২পৃ.)
শায়খ আহমাদ বিন উমর মাসআদ হাযামী তার شرح كتاب التوحيد. কিতাবের ৫৩/৮পৃষ্ঠায় (শামিলা) উল্লেখ করেন-
اعتقد أن الله تعالى في كل مكان هذا كفر أكبر، -‘
‘কেউ যদি আক্বিদা রাখে আল্লাহ সবখানে (হাযির-নাযির) এই ধারণা কুফুরে আকবার।’’ আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের আকায়েদের ইমাম আবুল হাসান আশ‘আরী (رحمة الله)
🔴(ওফাত. ৩২৪হি.) তার الإبانة عن أصول الديانة গ্রন্থের ১০৯ পৃষ্ঠায় (যা দারুল আনসার, কায়রু মিশর হতে ১৩৯৭ হিজরীতে প্রকাশিত) লিখেন-
وزعمت المعتزلة والحرورية والجهمية أن الله تعالى في كل مكان، -
‘‘ মুতাযিলা, হারুরিয়াহ এবং জাহমিয়্যাহ বাতিল ফিরকার লোকেরা বিশ্বাস করে আল্লাহ সকল স্থানে (হাযির-নাযির) আছেন।’’ ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ)-এর ছেলে ইমাম আবু আব্দুল্লাহ আহমদ ইবনে মুহাম্মদ হাম্বল (ওফাত. ২৪১হি.) তিনি তার الرد على الجهمية والزنادقة কিতাবের ১১৪ পৃষ্ঠায় এ আক্বিদা পোষণ কারীদের খন্ডনে একটি শিরোনাম করেন এ নাম দিয়ে
الرد على الجهمية في زعمهم أن الله في كل مكان -
‘‘আল্লাহ সকল স্থানে (হাযির-নাযির) আছেন জাহমিয়্যাহ ফিরকার বাতিল আক্বিদার খন্ডন।’’
আকায়েদবিদ ইমাম ত্বাহাবী (رحمة الله) বলেন-
مُحِيطٌ بِكُلِّ شَيْءٍ وَفَوْقَهُ وَقَدْ أَعْجَزَ عَنِ الإحاطة خلقه
-‘‘প্রত্যেক বস্তুই তাঁর পরিবেষ্টনে রয়েছে এবং তিনি সব কিছুর ঊর্ধ্বে। আর সৃষ্টিকুল তাঁকে পরিবেষ্টনে অক্ষম।’’
🔴(ইমাম তাহাভী, আক্বিদাতুল তাহাভী, ৫৬পৃ. ক্রমিক. ৫১, মাকতুবাতুল ইসলামী, বয়রুত, লেবানন, প্রকাশ.১৪১৪হি.)
আর এজন্যই আল্লাহ তা‘য়ালার একটি নামই হল মুহিত বা পরিবেষ্টনকারী অর্থাৎ তিনি সকল সৃষ্টিকে বেষ্টন করে রয়েছেন। ইমাম ত্বাহাবী (رحمة الله) তাঁর এ কিতাবের অন্যত্র বলেন-
لَيْسَ فِي مَعْنَاهُ أَحَدٌ من البرية وَتَعَالَى عَنِ الْحُدُودِ وَالْغَايَاتِ وَالْأَرْكَانِ وَالْأَعْضَاءِ وَالْأَدَوَاتِ لا تحويه الجهات الست كسائر المبتدعات
‘‘আল্লাহ তা‘য়ালার গুণে সৃষ্টি জগতের কেহ নেই। তিনি সীমা, পরিধি, অঙ্গপ্রতঙ্গ এবং উপাদান উপকরণের ঊর্ধ্বে। সৃষ্টি জগতের ন্যায় ছয় দিকের কোন দিক তাকে বেষ্টন করতে পারে না।’’
🔴(ইমাম তাহাভী, আক্বিদাতুত তাহাভী, ৪৪পৃ. ক্রমিক. ৩৮, মাকতুবাতুল ইসলামী, বয়রুত, লেবানন, প্রকাশ.১৪১৪হি.)
তাই প্রমাণিত হল আল্লাহকে হাযির-নাযির বলা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মতে কুফুরী।