
এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুর প্রকোপ ক্রমেই মারাত্মক আকার ধারণ করছে। চলতি বছরের
প্রথম ছয় মাসে ডেঙ্গুর ভয়ংকর রূপ দেখেছে দেশ। কোনো বছরের প্রথম ছয় মাসে ডেঙ্গুর
এমন ভয়াবহ রূপ আর কখনো দেখা যায়নি।
২০১৯ সালে সর্বোচ্চসংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হন। ওই বছরের প্রথম ছয় মাসে ডেঙ্গুতে
মৃত্যু হয়েছিল আটজনের। কিন্তু এবার ইতোমধ্যে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা ৫৪ জনে পৌঁছে
গেছে। আর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন সাড়ে আট হাজারের বেশি রোগী।
মাসের হিসাবে জানুয়ারিতে ৫৬৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১৬৬ জন, মার্চে ১১১ জন, এপ্রিলে ১৪৩ জন, মে মাসে ১০৩৬ জন এবং জুন মাসে ৫৯৫৬ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এদের
মধ্যে জানুয়ারিতে ছয়জন, ফেব্রুয়ারিতে তিনজন, এপ্রিলে দুজন, মে মাসে দুজন এবং জুন মাসে ৩৪ জনের মৃত্যু
হয়েছে। চলতি জুলাই মাসের ১৫ দিনে মারা গেছেন ৮২ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ডেঙ্গু নিয়ে আতঙ্কিত না হয়ে সতর্ক থেকে পরিবেশ
পরিচ্ছন্নতার ওপর নজর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। সেই সঙ্গে এডিস মশাবাহিত রোগটির
প্রকোপ মোকাবেলায় স্বাস্থ্যের বিভিন্ন বিষয়ের প্রতিও নজর দেওয়ার কথা জানিয়েছে
সংস্থাটি।
ডেঙ্গু এবার ভয়াবহ রূপ নিতে পারে এ ব্যাপারে আগেই সতর্ক করা হয়েছিল। গত মে
মাসে সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানিয়েছিলেন, গত বছরের তুলনায় এবার সারাদেশে
ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা পাঁচ গুণ বেশি।
বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন- এবার ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা অন্য সব
বছরকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। আর আক্রান্তের সংখ্যা বাড়লে বাড়তে পারে মৃত্যুর সংখ্যাও।
ডেঙ্গু নিয়ে সতর্ক করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও। গত মে মাসে সংস্থাটি জানিয়েছিল, বাংলাদেশে সাধারণত জুন থেকে
ডেঙ্গুর মৌসুম শুরু হয়, কারণ ওই সময়ে শুরু হয় বর্ষাকাল। এই
প্রাদুর্ভাব চলে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। এ বছর মৌসুম শুরুর আগেই হাসপাতালে ডেঙ্গু
রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।
সিটি করপোরেশনকে আরও বেশি তৎপর হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তখন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের
অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির বলেছিলেন, 'প্রাক মৌসুমে ডেঙ্গু
নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে। তাই সবাইকে সচেতন হতে হবে।'
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক
হোসেন জানান, আগামী কয়েক মাস ডেঙ্গুর প্রকোপ আরও মারাত্মক
আকার ধারণ করতে পারে। তিনি বলেন, 'দেশে সাধারণত জুনের পর
থেকে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ে। তাই আগামী দিনগুলোতে আক্রান্তের সংখ্যা অনেক বেড়ে যেতে
পারে। আর আক্রান্ত বেশি হলে মৃত্যুর সংখ্যাও বেশি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এখনই
ব্যবস্থা না নিলে সামনের দিনগুলোতে পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম বলেন, 'ঢাকায় বসতবাড়িতে এবার বর্ষা
মৌসুমে আগেই এডিস মশার লার্ভা বেশি পাওয়া গেছে। গত বর্ষা মৌসুমের তুলনায় ৭ শতাংশ
বেশি বাড়িতে এ লার্ভা পাওয়া যায়। ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসায় হাসপাতালে আলাদা প্রস্তুতি
রাখা হয়েছে।
এ বছর ডেঙ্গুর ধরন (ভেরিয়েন্ট) ডেন-দুই-এ বেশি মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন। সীমিতসংখ্যক
নমুনা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ৬২ শতাংশ রোগী ডেঙ্গুর ধরন ডেন-দুই-এ আক্রান্ত হয়েছেন। বাকি ৩৮ শতাংশ
আক্রান্ত হয়েছেন অন্য ধরন ডেন-তিন-এ। আইইডিসিআর ডেঙ্গুর ধরন সম্পর্কে এ তথ্য
জানিয়েছে।
জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক বেনজির আহমেদ বলেন, 'ডেঙ্গু যে দেশে ঢোকে, সেখান থেকে বের হয় না। কিন্তু একে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আমাদের দেশে দুই
যুগের বেশি সময় ধরে এর নিয়ন্ত্রণে কোনো কাজ করা হয়নি। ২০০০ সালে দেশে ডেঙ্গুর
প্রকোপ দেখা দিলেও এর নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট কার্যকর কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি।'
তার মতে, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট বরাদ্দ
দিতে হবে এবং সেই সঙ্গে একটি সঠিক কর্মপরিকল্পনা করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ডেঙ্গু নিয়ে আতঙ্কিত না হয়ে সতর্ক থেকে পরিবেশ
পরিচ্ছন্নতার ওপর নজর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। সেই সঙ্গে এডিস মশাবাহিত রোগটির
প্রকোপ মোকাবেলায় স্বাস্থ্যের বিভিন্ন বিষয়ের প্রতিও নজর দেওয়ার কথা জানিয়েছে
সংস্থাটি।
তীব্র ডেঙ্গুর লক্ষণ সম্পর্কে জানিয়ে তথ্যবিবরণী বলা হয়েছে, ডেঙ্গু হওয়ার তিন থেকে সাত দিন
এর তীব্র লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে। শরীরের তাপমাত্রা অস্বাভাবিক কমে যাওয়া, তীব্র পেট ব্যথা, ক্রমাগত বমি করা, বমির সঙ্গে রক্ত যাওয়া, ঘন ঘন শ্বাস নেওয়া এবং শরীরে
অবসাদ বোধ করা ও অস্থিরতা বোধ করা।
সম্প্রতি এক তথ্যবিবরণীতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, শরীরের তাপমাত্রা ১০৪ ডিগ্রি
হওয়ার পাশাপাশি দুটি লক্ষণ দেখা দিলে ডেঙ্গু সন্দেহে নিকটস্থ চিকিৎসকের পরামর্শ
নিতে হবে। লক্ষণ দুটি হলো- তীব্র মাথা ব্যথা, চোখের পেছনে
ব্যথা, শরীরের পেশি ও জয়েন্টসমূহে ব্যথা এবং বারবার বমি করার
প্রবণতা।
তীব্র ডেঙ্গুর লক্ষণ সম্পর্কে জানিয়ে তথ্যবিবরণী বলা হয়েছে, ডেঙ্গু হওয়ার তিন থেকে সাত দিন
এর তীব্র লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে। শরীরের তাপমাত্রা অস্বাভাবিক কমে যাওয়া, তীব্র পেট ব্যথা, ক্রমাগত বমি করা, বমির সঙ্গে রক্ত যাওয়া, ঘন ঘন শ্বাস নেওয়া এবং শরীরে
অবসাদ বোধ করা ও অস্থিরতা বোধ করা।
প্রতিবছর বর্ষাকালে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়।
২০১৯ সালে দেশব্যাপী ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলেন এক লাখ এক হাজার ৩৫৪ জন। ওই
সময়ে চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীসহ প্রায় ৩০০ জনের মৃত্যু হয়েছিল।
২০২০ সালে করোনা মহামারিকালে ডেঙ্গুর সংক্রমণ তেমন একটা দেখা না গেলেও ২০২১
সালে সারাদেশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হন ২৮ হাজার ৪২৯ জন। ওই বছর ডেঙ্গুতে
আক্রান্ত হয়ে ১০৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল।
এছাড়া ২০২২ সালে ডেঙ্গু নিয়ে মোট ৬২ হাজার ৩৮২ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন।
এর মধ্যে গত বছর মশাবাহিত রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে ২৮১ জন মারা গেছেন।