কেমিক্যাল বিস্ফোরণে নিমতলী ট্র্যাজেডির এক যুগেও দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন আসেনি পুরান ঢাকায়। আজও বোমা গোডাউনেই বসবাস করছে পুরান ঢাকাবাসী। নিমতলী এলাকা থেকে রাসায়নিক ও বিস্ফোরক জাতীয় কেমিক্যাল দোকান সরিয়ে নেওয়া হলেও তার এক কিলোমিটারের মধ্যেই রয়েছে অসংখ্য ‘বোমা গোডাউন’। অধিকাংশ গোডাউন আবাসিক ভবনগুলোতে।
নিমতলী ট্র্যাজেডির পর সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তর সমন্বিত করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। বিশেষজ্ঞরা ১৭টি সুপারিশ পেশ করেছিলেন সরকারের কাছে। এরমধ্যে প্রথমেই ছিল বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থের গুদাম ও কারখানা সরিয়ে নেওয়া, আবাসিক ভবনের বাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধসহ ১৫টি সুপারিশ; যা বাস্তবায়নের দায়িত্ব ছিল শিল্প মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়সহ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তর। ঘটনার এক যুগ অতিবাহিত হওয়ার পরও সুপারিশ বাস্তবায়িত না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন স্বজনহারা ও ক্ষতিগ্রস্তরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তদন্ত কমিটির একজন বলেন, ‘ভয়াল ঘটনার এক যুগেরও সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন না হওয়ার নেপথ্যে ক্ষমতাসীনদের প্রভাব ও সরকারের স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। ওই ঘটনার পর একই কারণে আরো দুটি অগ্নিকাণ্ড দেখতে হয়েছে পুরান ঢাকাবাসীকে।’
নিমতলী অগ্নিকাণ্ডে নিহতের স্বজনরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আর কত প্রাণ গেলে সরকারের টনক নড়বে! ক্ষমতাসীনদের প্রভাবে কেমিক্যাল গোডাউনগুলো হস্তান্তর হচ্ছে না। বরং বাসিন্দারা প্রতিবাদ করলে নানা রকম নির্যাতনের শিকার হতে হয়।
সুপারিশ বাস্তবায়নে শুধু কি ক্ষমতাশালীদের প্রভাব না কি সরকারের সদিচ্ছার অভাব রয়েছে- এমন প্রশ্নে ফায়ার সার্ভিসের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল অলি আহমেদ খান বলেন, ‘ঘটনার এক যুগ পরও কেমিক্যাল গোডাউন হস্তান্তর না হওয়ার পেছনে সরকারের সমন্বয়হীনতা রয়েছে। এজন্য যেকোনো একটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে দায়িত্ব নিতে হবে। কেমিক্যালের কারণে নিমতলীর পর চকবাজেরর ঘটনাও আমাদের নাড়া দিয়েছিল।’
এমন পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি হওয়া আগেই দ্রুত এসব কারখানা ও কেমিক্যাল গোডাউন হস্তান্তর করা দরকার বলে মনে করেন সাবেক এই কর্মকর্তা।
নিমতলী ও পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা য়ায়, নিমতলী অগ্নিকাণ্ডের এক যুগ পরও বাতাসে ভাসছে পোড়া ও ক্ষতের গন্ধ। ওই ঘটনায় আগুনে পুড়ে ১২৪ জনের মৃত্যু হয়। আহত হয় শতাধিক মানুষ। মর্মান্তিক ওই ঘটনার পর নিমতলী থেকে কেমিক্যাল দোকানগুলো সরিয়ে নেওয়া হলেও পাশেই রয়েছে বেশ কয়েকটি পলিথিন ও প্লাস্টিক কারখানা; যা খোদ স্থানীয় পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি শহিদ মিয়ার বাড়ির নিচেই দেখা মেলে পলিথিন ও প্লাস্টিক কারখানা। এ ছাড়া নিমতলী থেকে এক কিলোমিটারের মধ্যে রয়েছে অসংখ্য কেমিক্যাল গোডাউন। স্থানীয়রা এর নাম দিয়েছেন ‘বোমা গোডাউন’।
পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, অ্যাটম বোমার ওপর বসবাস করছে কয়েক হাজার পরিবার। রাসায়নিক দাহ্য পদার্থ ও বিস্ফোরক জাতীয় পদার্থের গোডাউন, কারখানা ও দোকানের ছড়াছড়ি পুরান ঢাকার একাংশ। বিশেষ করে ইসলামবাগ, ওয়াটার-হাজী বাল্লু রোড, কে বি রুদ্র রোড, হরনাথ ঘোষ রোড, গৌরী সুন্দর লেন, বকশীবাজার লেন, তাঁতীবাজার রোড, নাজিমুদ্দিন রোড, মনসুরবাগ, বাগচান খাঁ লেন, নিজামবাগ, জঙ্গলবাড়ী, নূরবাগ, দুখুরিয়া, মমিনবাগ, হুজুরপাড়া, মনেশ্বর রোড, লালবাগ রোড়, মৌলভীবাজার, আরমানীটোলা ও মিটফোর্ড এলাকায় রয়েছে কয়েক হাজার কেমিক্যাল গোডাউন। যার সিংহভাগই আবাসিক ভবনে। এর সততা মিলেছে খোদ ফায়ার সার্ভিস ও সিটি করপোরেশনের প্রতিবেদনেও।
ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে ২০১৯ সালের শেষদিকে একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, আরমানীটোলা, বাবুবাজার, মিটফোর্ড, চকবাজার, কামরাঙ্গীরচর, লালবাগ, ইসলামপুরসহ আশপাশের এলাকায় আবাসিক ভবনে ঝুঁকিপূর্ণভাবে চার শতাধিক প্রতিষ্ঠান ও দুই হাজার গোডাউন রয়েছে। সিটি করপোরেশনের তালিকায়ও উঠে আসে একই চিত্র।
সিটি করপোরেশনের তথ্য বলছে, পুরান ঢাকায় প্রায় ১৯২৪টি কেমিক্যাল গোডাউন রয়েছে; যার ৯৮ শতাংশ আবাসিক ভবনে। তবে বেসরকারি ও বিভিন্ন সংস্থার হিসাবে এর সংখ্যা সাড়ে তিন হাজারের অধিক।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহাম্মদ বলেন, ‘আমরা বরাবরই পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল গোডাউন সরানো বিষয়ে সম্প্রতি কেবিনেটে আলোচনা হয়েছে।’
কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের দাবি, অতিদাহ্য বা ঝুঁকিপূর্ণ কেমিক্যাল নদীর ওপার থেকে বিক্রি করা হচ্ছে। তবে ক্রেতা ও কয়েকজন কেমিক্যাল ব্যবসায়ী জানান, তারা পুরান ঢাকা থেকেই সব ধরনের কেমিক্যাল বিক্রি করে থাকেন। বিশেষ করে মিটফোর্ড, চকবাজার, আরমানীটোলা, ইসলামবাগের বিভিন্ন অলিগলির ভবনের এসব কেমিক্যাল গোডাউন। নাম প্রকাশ না করে এক কেমিক্যাল ব্যবসায়ী বলেন, আমাদের সব ক্রেতা পুরান ঢাকাকেন্দ্রিক। এখানে ছোট-বড় অনেক কারখানা রয়েছে। মুন্সীগঞ্জে গোডাউন করা হলেও এখানেই আমাদের ক্রয়-বিক্রয় করতে হবে। পুরোপুরি সরিয়ে নেওয়া সম্ভব না। এত ঘটনার পরও কোনো আবাসিক এলাকা থেকে কেমিক্যাল সরানো হচ্ছে না! এমন প্রশ্নে ওই ব্যবসায়ী বলেন, ‘এই ব্যবসা যারা করেন, তারা সবাই ক্ষমতাসীন দলের। তাছাড়া এখানে বহু টাকার লেনদেন রয়েছে।’
নিমতলী ট্র্যাজেডির পর কেমিক্যাল গোডাউন স্থানান্তরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রাণালয় থেকে শিল্প মন্ত্রণালয়কে দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরে ২০১৮ সালে শিল্প মন্ত্রণালয় কেরানীগঞ্জে ৫০ একর জায়গার ওপর ‘বিসিক কেমিক্যাল পল্লী ঢাকা’ নামে একটি প্রকল্প একনেকে অনুমোদন পায়। পরে ২০১৯ সালে সেটি মুন্সীগঞ্জ জেলার সিরাজদিখানে ৩১০ একর জমিতে স্থানান্তর করা হয়। এ বছর এসব কেমিক্যাল গুদাম ও কারখানা স্থানান্তরের কথা থাকলেও প্রকল্প পরিচালক বলছেন, আরো এক বছর সময় লাগবে। বাস্তবে জমি ক্রয় ছাড়া এখনো কোনো অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়নি কেমিক্যাল পল্লীর। শিল্প মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুঠিরশিল্প করপোরেশনের (বিসিক) প্রকল্প পরিচালক (বিসিক কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক) মুহাম্মদ হাফিজুর রহমান বলেন, ‘কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের আবাসিক এলাকা থেকে হস্তান্তরের জন্য মুন্সীগঞ্জে ৩১০ একর জায়গা দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে সেখানে মাটি ভরাটের কাজ চলছে। ২০২৩ সালে পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। এরপর সেখানে ব্যবসায়ীদের দোকান/গোডাউন বরাদ্দ দেওয়া হবে।’
মামলা হয়নি, পায়নি আশানুরূপ ক্ষতিপূরণ : নিমতলী অগ্নিকাণ্ডে নিহতের স্বজনদের দাবি, ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১২৪ জন নিহতের ঘটনায় সরকারের পক্ষ থেকে নিহতদের মাথাপিছু ২০ লাখ টাকা করে দেওয়া কথা থাকলেও পরিবার প্রতি পেয়েছেন এক লাখ টাকা। যার পরিবারের ১১ জন মারা গেছে, তিনিও পেয়েছেন ১ লাখ টাকা। ভয়ংকর এ ঘটনায় কোনো মামলা না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন নিহত ও ক্ষতিগ্রস্ত স্বজনরা।
জানা যায়, সেসময়ে বংশাল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছিল। তবে বর্তমানে তারও কোনো হুদিস নেই পুলিশের কাছে। বংশাল থানার ওসি বলেন, ‘তখন কোনো জিডি হয়েছিল কি না, তা আমার জানা নেই।’
এদিকে এ ঘটনায় নাম প্রকাশ না করে স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, ‘নিমতলী ট্র্যাজেডির প্রতিবাদ ও বিচারের দাবি এবং সেসময় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার জন্য অনেক বাসিন্দাকে নির্যাতন ও নানাভাবে হয়রানি করেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা। এ ঘটনায় প্রভাবশালী নেতারা সুবিধা নিয়েছেন অথচ ভুক্তভোগীরা কিছুই পাননি।’
ক্ষতিগ্রস্তরা প্রশ্ন রেখে বলেন, কেমিক্যাল গোডাউন কার ছিল, কাদের জন্য আমাদের এত ক্ষতি, এত বড় ঘটনায় কেন মামলা হলো না? এসব প্রশ্নের উত্তর নেই কারো কাছে।