অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরীর ফেসবুক থেকে নেয়াঃ
কেউ কেউ জীবনে দিয়েই যায় | যতদিন সে দিতে পারে ততদিন তার দাম থাকে | তারপর একদিন তার দাম ফুরিয়ে যায় | যে মানুষটা সংসারের হাল ধরতে গিয়ে নিজের জীবনকে নিয়ে কখনো ভাবেনি বরং তিল তিল করে নিজেকে নিঃশেষ করতে করতে পরিবারের অন্যদের ভবিষ্যত গড়ে দিয়েছে একদিন পরিবারের কাছে সে বোঝা হয়ে দাঁড়ায় | কখনো কখনো পরিবারের অলংকার হবার পরিবর্তে কলংক হয়ে যায় |
প্রশ্ন তো আসতেই পারে, কি কি বিসর্জন দেয় সেই নিঃস্বার্থ মানুষটা ? অনেককিছু, যা হয়তো খোলা চোখে দেখা যায়না, বন্ধ করে ফেলা চোখে দেখা যায় | চোখ যখন খোলা থাকে তখন মানুষ কোনোকিছু বিচার করতে পারেনা | তবে দিন যত যাচ্ছে চোখ তত বড় বড় চশমার কৃত্রিম কাঁচে আরও বন্দি হয়ে পড়ছে, ক্রমশ ঝাপসা হচ্ছে মানুষের দেখার অনুভূতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি | হাবল টেলিস্কোপের উত্তরসূরি বলে খ্যাত জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ বানিয়ে মানুষ কত কিছুই না খুঁজছে অথচ একজন স্বার্থহীন মানুষের ত্যাগের মূল্য কি খুঁজছে |
কোনটা বড় মানুষ, না মানুষের অতি উচ্চ বিলাসী স্বপ্ন | স্বপ্নের প্রাচুর্য বড় নাকি বাস্তবতার কষাঘাতে নিমজ্জিত মানুষের অসহায় মনটা বড় | এটা নিয়ে তর্ক বিতর্কে জড়াবোনা | সারা পৃথিবী সেই মনোমুদ্ধকর ছবির নানা বিশ্লেষণে মেতেছে, কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি নয় | যুক্তি-তর্কে কে কাকে ছোট করবে, কে কাকে বড় করবে এমন এক মনস্তাত্ত্বিক লড়াই চলছে | পান্ডিত্য জাহিরের এতো বড় সুযোগ মুখোশ মানুষরা কোনভাবেই ছাড়তে রাজি নয় | সাধারণ একটা মানুষের কাছে এসবের কোনো মূল্য নেই | তার কাছে তার মৌলিক চাহিদা মেটানোর লড়াইটা সবচেয়ে বড় |
এটা বিশ্ব রাজনীতির কোনো কৌশল কিনা বলতে পারবোনা, এটা বিজ্ঞানের মানব কল্যাণে নিহিত কোনো গবেষণা কিনা তা বলতে পারবোনা, এটা যেটাই হোক না কেন কোনোটাই বলতে পারবোনা | কারণ সময় কথা বলবে, প্রকৃতি কথা বলবে, ইতিহাস কথা বলবে | তবে একটা কথা বলতে দ্বিধা নেই, সারা পৃথিবী অস্ত্র, মরণাস্ত্র, তারকাযুদ্ধের নামে ধ্বংসযজ্ঞের যে অতি উচ্চ বিলাসী পরিকল্পনা হাতে নিয়ে শক্তির উন্মাদনায় মেতে উঠে টাকার পর টাকা ঢালছে, সে টাকা কি দারিদ্রপীড়িত মানুষদের দারিদ্র্য মোচনের জন্য ব্যয় হতে পারতোনা ? পৃথিবীর ক্ষুধার্ত শিশুদের ক্ষুধার যন্ত্রনা কি মিটাতে পারতোনা | হয়তো পারতো, কিংবা কারো কারো যুক্তিতে পারতোনা | কারণ বিষয় যাই হোক, এর পক্ষে, বিপক্ষে দাঁড়ানো মানুষদের সংখ্যাও কম নয় | কারণ সবকিছু যে একটা খেলা আবার সব খেলা খেলা নয় |
ফেসবুকে একটা লেখা পেলাম, লেখাটা এমন ছিল:
"বাবার অসুস্থতার কারনে ৮বছর বয়সে সংসারের দায়িত্ব নিলাম... ইটভাটায় কাজ করেছি, জেলের কাজ করেছি, ট্রাকে লেবারি করেছি...
হাত ২টা ঠোসা পড়ে গেছে... পড়ালেখা করিনি...
বিয়ে করেছি ৩৫বছর বয়সে... শুধু ভাই-বোনের কথা চিন্তা করে...
সম্পুর্ন নিজের টাকায় ২জন বোন কে বিয়ে দিলাম...
২জন ভাইকে শিক্ষা অফিসার বানালাম...
আরেকজন ভাইকে বানালাম ডাক্তার...
আজ ছোট ভাই একটার জন্য মেয়ে দেখতে যাবে... ভাই বোন সবাই যাচ্ছে, আমাকে নেয়নি.. কারণ, আমি দেখতে ওদের মতো স্মার্ট না... এবং আমি মুর্খ, ওদের সাথে যায় না...
আহ জীবন, আহারে জীবন..."
ভাবছি অসহায় লোকটার কথা, একদিন যার দাম পরিবারের কাছে সবচেয়ে বেশি ছিল | স্বার্থপর আর সুবিধাবাদী পরিবারের মানুষরা তখন তাকে তাদের উপরে উঠার এক একটা লোভনীয় সিঁড়ি ভেবেছে | হয়তো লোকটা তাদের কাছে কোনোদিন মানুষের মূল্য পায়নি, আপনজনের ভালোবাসা পায়নি, যা পেয়েছে তা হয়তো একধরণের মেকি অভিনয় | সবাই অভিনেতা হলেও সাধারণ লোকটা সমাজের বাস্তবতা হয়েছে | কিন্তু সেটি হয়েওবা লাভ কি, সবাই রূপের জৌলুসকে ভালোবাসে, রক্ত মাংসের মানুষকে ভালোবাসেনা |
লোকটা পরিবারকে গড়ে তুলতে শরীরের ঘাম ঝরিয়েছেন, জীবনের অনেক মৌলিক চাহিদার মধ্যে শিক্ষার মতো মৌলিক চাহিদাকেও বিসর্জন দিয়েছেন | তার শ্রমের পানি করা রক্তে ভাই-বোনেরা এখন শিক্ষিত হয়ে সমাজের মাথা হয়েছে, বড় বড় পদপদবী পেয়েছে. ক্ষমতার রক্ত টগবগ করছে তাদের চোখে-মুখে | সমাজে তাদের মর্যাদা বেড়েছে, জাতে উঠেছে তারা | সবার দাম বেড়েছে আর সময় যতই গড়িয়েছে নিঃস্বার্থ লোকটার দাম ততই কমেছে | খুব কষ্ট পেয়েছে লোকটা, হয়তো কান্নার পানি চোখে আনেননি , সেটা হিমশীতল বরফ করে জমাট বাঁধিয়েছেন এমন একটা জায়গায় সেটা হয়তো কেউ কোনোদিন খুঁজেও দেখবেনা | লোকটার কথাগুলো পড়ে মনে হলো মানুষ যতই শিক্ষিত হয় ততই স্বার্থপর ও অকৃতজ্ঞ হয় | কারণ আমাদের শিক্ষায় ভোগবাদিতার সব উপাদান থাকলেও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির কোনো জায়গা নেই | লোকটাকে এতদিন ব্যবহার করে বড় বড় সাহেব সুবেদার হয়ে উঠা আপনজনরা মনে করছে লোকটা পরিবারের জন্য একটা কলংক | স্টেটাস বলেও তো একটা অতি দানৱীয় কথা আছে , সে স্ট্যাটাসে লোকটার কোনো জায়গা নেই | তার জায়গা ডাস্টবিনে কিংবা গরুর খোয়াড়ে | একদিন সে গাছ ছিল, এখন সে আগাছা হয়েছে |
আমার একজন প্রিয় ছাত্র লিখেছে, "পরিবারের বন্ধন ততদিন মজবুত থাকে যতদিন বন্ধনের মুল কারিগর (মা) থাকে।মুল কারিগর (মা) নেই বন্ধনও ধুমড়ে মুচড়ে নড়বড়ে।এটাই কি হবার কথা? সবই শূণ্যের কোটায়!!" কথাটা খুব সাধারণ মনে হলেও এর ভিতরের গভীরতা অনেক | যতদিন মা বেঁচে থাকেন ততদিন সম্পর্কগুলো মাকে আবর্তিত করে চলতে থাকে | মা যখন চলে যান, সম্পর্কগুলো তখন স্বার্থপর হয়ে যায় | চেনামুখগুলো অচেনা মনে হয় | পরিবারের স্বার্থহীন মানুষেরা পরিবারের স্বার্থপর মানুষদের দ্বারা আক্রান্ত হয় | কে আপন, কে পর বোঝা খুব কঠিন হয়ে পড়ে | মায়ের মৃত্যুর সাথে সাথে সম্পর্কের বন্ধন নড়বড়ে হয়ে পড়ে, সম্পদের লোভ মানুষের সম্পর্কে ফাটল ধরায় | ভেঙে যায় সব স্বপ্ন, সব সুখ |
বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন জাপানের মানুষেরা দীর্ঘায়ু হবার কারণগুলোর মধ্যে একটি হলো তাদের খাদ্যাভ্যাস | আর বাকি কারণগুলো মানবিক ধারণা দ্বারা পুষ্ট | যেমন তাদের বয়স যত বাড়ে টেনশন তত কমে, নাতি নাতনিদের সাথে তাদের আনন্দ করেই সময় কাটে | সবচেয়ে বড় কথা হলো প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তারা এমন এক সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে যেখানে ছোটরা বড়দের সব সময় সন্মান করে , পরিবারের জন্য বড়রা যে ত্যাগ করেন সে ত্যাগের প্রতি পরিবারের ছোটরা সব সময় কৃতজ্ঞ থাকে | তাদের শিক্ষায় মানবিক আচরণ ও জীবনাচরণের বিষয়টি বেশি গুরুত্বপূর্ণ |
এমন একটা সমাজের স্বপ্ন দেখি......স্বপ্ন কি সত্য হয় নাকি অধরাই থেকে যায় | ঠিক জানিনা, জানতেও চাইনা | কারণ এ সমাজে কিছু চাওয়াটাই যে পাপ কিংবা অপরাধ | যদিও পাপ ও অপরাধের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান |