ড. মোহাম্মদ মিজানুর রহমান, চিকিৎসক, লেখক, গবেষক
বর্তমান বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে একটি বিষয়ের ওপর পরিষ্কারভাবে চোখ পড়ে — জাতীয় রাজনীতিতে নেতৃত্বের সংকট। বিশেষ করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এখন এমন একটি সময় পার করছে, যেখানে তাদের নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতএব, দল পুনর্গঠন এবং ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সময়োপযোগী, বাস্তবভিত্তিক ও জনবান্ধব সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়।
১. অতীত থেকে শিক্ষা, ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি : ২০০৯ সালের পর থেকে রাজনীতির ময়দানে বিএনপি উল্লেখযোগ্যভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। একদিকে সরকারি দমননীতি, অন্যদিকে নিজেদের অভ্যন্তরীণ বিভাজন — এই দুইয়ের চাপে দল ধীরে ধীরে রাজপথ থেকে কার্যত হারিয়ে যেতে বসেছে। ২০১৪, ২০১৮ এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির অনুপস্থিতি বা দুর্বল অংশগ্রহণ জনগণের মধ্যে নেতিবাচক বার্তা পাঠিয়েছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ কী?
উত্তর হলো — এক ঝাঁক সাহসী, সৎ, ত্যাগী, গণমানুষের সঙ্গে মিশে থাকা রাজনীতিককে সামনে আনা এবং তাদের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব গড়ে তোলা। বিশেষ করে যারা ২০১০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সময়টিতে দলের দুঃসময়ে পাশে ছিলেন, পুলিশের লাঠি খেয়েছেন, মামলা খেয়েছেন, কিন্তু পদ-পদবীর জন্য কখনো দল ত্যাগ করেননি — তাদের খুঁজে বের করা এখন সময়ের দাবি।
২. ত্যাগী নেতাদের পাশে না থাকলে ভবিষ্যৎ অন্ধকার, এখন দেখা যাচ্ছে, অনেকেই ‘Awami League’-এর সাথে থাকাকালীন সময়ে ব্যবসা করেছে, সুযোগ-সুবিধা নিয়েছে, অর্থ উপার্জন করেছে। এখন রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখে আবার ‘বিএনপি’র ঘনিষ্ঠ বলে পরিচয় দিচ্ছে। তারা আবার সেই পুরোনো কৌশলে মাঠে নামছে — "Awami League"-এর নেতাকর্মীদের সঙ্গে গোপনে হাত মিলিয়ে ব্যক্তিস্বার্থ রক্ষা করছে এবং জনগণের কাছে 'নেতা' হিসেবে নিজেদের তুলে ধরার চেষ্টা করছে।
এই প্রবণতা বিএনপির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। কারণ, যারা অতীতে দুঃসময়ে দলের পাশে ছিল না, তারা ভবিষ্যতে দলের জন্য কিছুই করবে না — তারা শুধু নিজের জন্য করবে।
৩. গণমানুষই হবে যাচাইয়ের মাপকাঠি, বিএনপির নীতিনির্ধারকদের উচিত এখন grassroots বা তৃণমূল পর্যায়ের জনগণের কাছ থেকে জানার চেষ্টা করা — কে প্রকৃতপক্ষে জনগণের জন্য কাজ করেছেন? কে বিনা স্বার্থে জনগণের সমস্যা সমাধানে এগিয়ে এসেছেন? কে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ও দায়িত্বকে জীবনের অংশ হিসেবে দেখেন?
প্রত্যেক উপজেলায়, ইউনিয়নে, ওয়ার্ডে সাধারণ মানুষের কাছে জিজ্ঞাসা করলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে — কে প্রকৃত নেতা, কে ছদ্মবেশী সুবিধাভোগী। বিশেষ করে তরুণদের চোখে যিনি আদর্শ — তিনিই ভবিষ্যতের জন্য যোগ্য নেতা।
৪. ‘নেতা’ নয়, ‘পরিবর্তনের দূত’ দরকার, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় দীর্ঘদিন ধরে 'নেতা' শব্দটি যেন কেবল একটি সুবিধাভোগী শ্রেণির প্রতিনিধি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু সময় এসেছে এই ধারণার পরিবর্তন ঘটানোর। এখন প্রয়োজন এমন নেতৃত্ব, যারা হতে পারেন জনগণের স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রকৃত দূত।
এই নেতৃত্ব হতে হবে: সৎ , আত্মত্যাগী , শিক্ষিত এবং রাজনৈতিকভাবে পরিপক্ব, দল এবং দেশের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য
তাদের অতীত রাজনৈতিক জীবন হবে স্বচ্ছ এবং সমাজে ‘রোল মডেল’ হিসেবে কাজ করার মতো।
৫. বিএনপির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আজকের সিদ্ধান্তের ওপর , এই বাস্তবতায় বিএনপির জন্য এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো — সুপরিকল্পিতভাবে নতুন নেতৃত্ব বেছে নেওয়া। এই নেতৃত্ব তৈরি করতে হবে দলীয় কর্মসূচি, রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ এবং সামাজিক সম্পৃক্ততার মাধ্যমে। বিশেষ করে যুবসমাজের মধ্যে যে উদ্যম ও উত্সাহ রয়েছে, সেটিকে কাজে লাগাতে হবে।
বিএনপির উচিত একটি নতুন 'ক্যাডার ফর্মেশন প্ল্যান' করা, যেখানে দলীয় কর্মীদের রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে, ত্যাগের মূল্যায়ন করা হবে এবং তৃণমূল থেকে জাতীয় পর্যায়ে তাদের অগ্রসর হওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে।
৬. রাজনৈতিক আদর্শ নয়, নৈতিকতাই মূল চালিকাশক্তি ,বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক সংকট হলো — নৈতিকতা ও আদর্শের ঘাটতি। আজ যারা 'আদর্শের কথা' বলেন, কাল তারা ক্ষমতার লোভে আদর্শ বিসর্জন দেন। এমন পরিস্থিতিতে শুধুমাত্র রাজনৈতিক দলীয় পরিচয় নয়, একজন ব্যক্তির নৈতিকতা, সততা এবং জনগণের প্রতি দায়িত্ববোধই হবে নেতৃত্বের আসল মাপকাঠি।
যারা ব্যক্তিগত লাভ, প্রভাব বিস্তার বা নির্বাচনী সুযোগের জন্য রাজনীতিতে আসে — তারা কখনোই দেশের জন্য কিছু করতে পারে না। বরং যে ব্যক্তি দিনের পর দিন সাধারণ মানুষের পাশে থেকেছেন, ছোট খাটো কাজ করে হলেও সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছেন — তিনিই প্রকৃত নেতা।
৭. শেষ কথা, বিএনপি বর্তমানে এক সন্ধিক্ষণের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। এখন যদি তারা আবার সেই পুরোনো সুবিধাবাদীদের দিয়ে ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করে, তাহলে দল শুধু আরও দুর্বলই হবে না, বরং জনসমর্থন হারিয়ে রাজনৈতিক অস্তিত্ব সংকটেও পড়তে পারে।
অতএব, সময় এসেছে—তৃণমূল থেকে উঠে আসা, পরীক্ষিত, সংগ্রামী, শিক্ষিত এবং নৈতিকতাসম্পন্ন নেতাদেরকে বিএনপির ভবিষ্যতের কান্ডারি হিসেবে তুলে ধরার। রাজনৈতিক ইতিহাস আমাদের বলে — একটি দলের ভাগ্য নির্ধারিত হয় সঠিক সময়ের সঠিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) যদি এই সময়টিকে কাজে লাগিয়ে, সৎ ও যোগ্য নেতাদের সামনে নিয়ে আসে, তাহলে শুধু দল নয় — গোটা জাতির ভাগ্য বদলাতেও ভূমিকা রাখতে পারে।
সত্যিকার নেতৃত্বের অভাবেই বাংলাদেশ আজ রাজনৈতিক অস্থিরতা ও নৈতিক অবক্ষয়ের মাঝে ছটফট করছে। বিএনপি যদি এই সংকটে পথপ্রদর্শক হতে চায়, তাহলে সময় এসেছে মুখোশধারীদের সরিয়ে প্রকৃত দেশপ্রেমিক ও জননেতাকে সামনে আনার।