বাংলাদেশের
উন্নয়নে বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা সব মিলিয়ে ৭ হাজার ২২৯ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে। প্রতি
ডলারের বিনিময়মূল্য ১০৫ টাকা ধরে হিসাব করলে বাংলাদেশি মুদ্রায় এই অর্থের পরিমাণ
দাঁড়ায় প্রায় ৭ লাখ ৫৯ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ এই পরিমাণ অর্থ বিদেশিদের কাছে
বাংলাদেশের ঋণ আছে। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ঋণ দেওয়ার পর থেকে
বিভিন্ন মহলে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। এর মধ্যেই সংস্থাটি বলেছে, দক্ষিণ এশিয়ায়
জিডিপি অনুপাতে সবচেয়ে কম ঋণ নিয়েছে বাংলাদেশ।
নানা
আলোচনার মধ্যেই আইএমএফের কাছ থেকে প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার পেয়েছে
বাংলাদেশ। এই ঋণপ্রাপ্তির পর উন্নয়ন সহযোগীদের কার কাছে কত ঋণ বাংলাদেশের, তা নিয়ে
জনমনে নানা প্রশ্ন, কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছে।
সম্প্রতি
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত
বাংলাদেশের মোট ঋণের পরিমাণ ১৬ হাজার ৬০০ কোটি ডলার, যা জিডিপির ৩৯ শতাংশ।
বাংলাদেশের শীর্ষ পাঁচ ঋণদাতার মধ্যে বিশ্ব ব্যাংক ১ হাজার ৮১৬ কোটি ডলার, এশীয়
উন্নয়ন ব্যাংক ১ হাজার ৩২৮ কোটি ডলার, রাশিয়া ৫০৯ কোটি ডলার, জাপান ৯২৩ কোটি ডলার
ও চীন ৪৭৬ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে।
চলতি
বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এক অনুষ্ঠানে আইএমএফের বরাত দিয়ে জানানো
হয়, বর্তমানে জিডিপি অনুপাতে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রতিবেশীদের
তুলনায় সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। যেখানে জিডিপি অনুপাতে ৮৩ দশমিক ৪০
শতাংশ ঋণ নিয়েছে ভারত। আর নেপাল নিয়েছে ৪৯ দশমিক ০৯ শতাংশ, পাকিস্তান ৭৭ দশমিক ৭৫
শতাংশ, মালদ্বীপ ১২৬ দশমিক ৪১ শতাংশ, শ্রীলঙ্কা ১৩০ দশমিক ৫২ শতাংশ ও ভুটান জিপিডি
অনুপাতে ঋণ নিয়েছে ১৩০ দশমিক ৭৯ শতাংশ।
সেই
অনুষ্ঠানে ঋণনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে ভ্যাট ও আয়কর থেকে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর তাগিদ
দিয়েছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি।
সে সময়
টিপু মুনশি বলেছিলেন, ‘আমাদের সবাইকে ইনকাম ট্যাক্স ও ভ্যাট
দেয়ায় উৎসাহিত করতে হবে। যাদের ইনকাম ট্যাক্স দেওয়ার সক্ষমতা হয়েছে, তারা ট্যাক্স দেবেন
এবং পণ্য কেনার ক্ষেত্রে ভ্যাট দেবেন। তবেই দেশের উন্নয়ন আরও বৃদ্ধি পাবে।’
দেশের
উন্নয়নে রাজস্ব অতি গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, এই রাজস্ব
বাড়াতে ইনকাম ট্যাক্স ও ভ্যাট দিতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। অনুপ্রাণিত করতে
হবে। তবেই দেশ এগিয়ে যাবে। দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।
মন্ত্রী
বলেন, ‘আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।
আমাদের স্মার্ট হয়ে কাজ করতে হবে। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে ভ্যাট ও ট্যাক্স
যথাযথভাবে দিতে হবে। এমনকি ভ্যাট আদায়ের ক্ষেত্রে কোনো মামলা ও সমস্যায় পড়লে আমরা
সহযোগিতা করব।’
এদিকে
ঘুষ-দুর্নীতি কমিয়ে রাজস্ব আদায়ে গতি আনতে এনবিআরকে দুই ভাগ করার দাবি জানিয়েছেন
বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সিনিয়র সহসভাপতি মোস্তফা
আজাদ চৌধুরী বাবু।
তিনি
বলেছেন, ‘বাংলাদেশ এলডিসি থেকে গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর রাজস্ব আদায়ে
গতি আনতে হলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) ভেঙে দুই ভাগ করতে হবে। এক্ষেত্রে রাজস্ব
আহরণ এবং রাজস্ব সম্প্রসারণ নামে আলাদা দুটি বিভাগ গঠন করা যেতে পারে।’
বর্তমানে
বাংলাদেশের কর জিডিপি অনুপাত ৯ দশমিক ৬১ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ায় জিডিপি অনুপাতে কর
আদায়ে বাংলাদেশের নিচে রয়েছে একমাত্র শ্রীলঙ্কা। বাংলাদেশে মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণ ৭
বছর আগের তুলনায় দ্বিগুণ হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে সরকারি ও বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রেই
বৈদেশিক ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
এদিকে,
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণ ছিল
৫৫৮ ডলার, যা ২০২০-২১ অর্থবছরে ছিল ৪৮২ ডলার। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশের মাথাপিছু
বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল ২৫৭ ডলার। গত অর্থবছরে দেশের মোট বৈদেশিক ঋণ ছিল ৯৫ দশমিক
২৩ বিলিয়ন ডলার, যা ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ছিল ৪১ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলার।
অর্থ
মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, এক দশকেরও বেশি সময় ধরে সরকার রূপপুর
বিদ্যুৎকেন্দ্র, ঢাকা মেট্রোরেল, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর ও বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং
কর্ণফুলী টানেলসহ বিদেশি অর্থায়নে বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এর
মধ্যে রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের জন্য বৈদেশিক ঋণ প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার। ফলে
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ব্যাপকভাবে বেড়েছে। তারপরেও বাংলাদেশ
এখনো আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সরকারি খাতের ঋণ ও জিডিপি অনুপাতের সীমার নিচেই
আছে। জিডিপির ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বৈদেশিক ঋণ নেওয়ায় কোনো ঝুঁকি নেই।