এক মাসেরও বেশি সময় ধরে দুঃসহ যানজটে ভুগছে রাজধানীবাসী। কোথাও এতটুকু রাস্তা ফাঁকা নেই। এই যানজটের প্রধান কারণ অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে দেশের পট পরিবর্তনের পর সুযোগ বুঝে রাজধানীর সীমান্ত এলাকার অলিগলিসহ আশপাশের এলাকা থেকে ঢাকায় ঢুকে পড়ে লাখ লাখ ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক। অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতাদের হিসাবে এ সংখ্যা প্রায় ৬ লাখ।
যানজট নিরসনে ইতোমধ্যে অভিযান শুরু করেছে ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ। গত দুদিনে ২৯২১টি ব্যাটারিচালিত রিকশা আটক করা হয়েছে। ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনে মামলা হয়েছে ৮৮৮টি। জরিমানা করা হয়েছে ৩৫ লাখ ৭ হাজার টাকা। ভুক্তভোগিদের মতে, ট্রাফিক পুলিশের অভিযান অব্যাহত না রাখলে যানজট কমবে না। ঢাকা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের একজন নেতা বলেন, ৬ লাখ ব্যাটারি রিকশা ও ইজিবাইকের মধ্যে ২৯২১টি রিকশা আটক কোন প্রভাব ফেলবে না। পুলিশকে আরও জোরালো অভিযান চালাতে হবে। বিশেষ করে এগুলোর কারখানায় অভিযান চালিয়ে উৎপাদন বন্ধ করতে হবে।
ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা এখন নগরের এক অন্যরকম এক আতঙ্কের নাম। জানা গেছে, নগরীর রামপুরা, বনশ্রী, বাড্ডা,শনির আখরা, দনিয়া, রাযেরবাগ, যাত্রাবাড়ি, বাসাবো, বৌদ্ধ মন্দির, মুগদা, সিপাহীবাগ, মানিকনগর, মান্ডা, সায়েদাবাদ, কোনাপাড়া, বসিলাসহ বিভিন্ন এলাকাতেই আগে থেকেই চলতো হাজার হাজার ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। দেশের পট পরিবর্তনের পর পুলিশ নিস্ক্রিয় হওয়ায় এগুলো ঢাকার ভিআইপি এলাকাতেও প্রবেশ করে। শুধু তাই নয়, বিমানবন্দর সড়ক এমনকি এলিভেটেডে এক্সপ্রেসওয়েতেও এগুলো চলতে দেখা যায়। ট্রাফিক পুলিশ সক্রিয় হওয়ার পর ভিআইপি সড়ক ও এলাকাতে এগুলোর চলাচল কমলেও একেবারে বন্ধ হয়নি। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরেও বনানীর প্রধান সড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক চলতে দেখা গেছে। একই চিত্র ছিল মতিঝিল, গুলিস্তান, আরামবাগ, কাকরাইল, পুরানা পল্টনসহ ব্যস্ততম এলাকাগুলোতেও।
নগরীর নিম্ন এলাকাগুলোয় এই ব্যাটারিচালিত রিকশা নামানোর ব্যাপারে কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করা হয় না। যেমন- গুলশান-বনানী কিংবা বারিধারায় চাইলেই এসব গাড়ি হুট করে নামানো যায় না; কিন্তু যাত্রাবাড়ি, সায়েদাবাদ, মুগদা, মানিকনগর, মান্ডা কিংবা সিপাহীবাগের মতো এলাকাগুলোতে যে কেউ যখন-তখন নামিয়ে ফেলতে পারে এসব রিকশা। ফলে ঘনবসতিপূর্ণ এসব এলাকায় আরও যানজট বাড়ছে, বাড়ছে রাস্তায় বিশৃঙ্খলাও। অথচ, নিয়ম রয়েছে রাস্তার হিসাব করে যেকোনো নামানো বিষয়টি। ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা যেন রাস্তায় নামানোই এখন সহজ একটি প্রক্রিয়া।
রাজধানীর ঘনবসতিপূর্ণ পুরান ঢাকা, লালবাগ, হাজারীবাগ, আজিমপুরসহ ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, মিরপুর এবং উত্তরাতেও ব্যাপক সংখ্যক ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলাচল করছে অবাধে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, প্রায় প্রতিদিন রাজধানীতে ব্যাটারিচালিত রিকশার চালকদের বেপরোয়া চলাচলে প্রধান সড়ক ও অলিগলিতে দুর্ঘটনা ঘটছে। এতে হতাহতের ঘটনাও ঘটছে। কিছু কিছু ঘটনা আলোচনায় আসছে। বাকি অনেক ঘটনা জানতেও পারছে না মানুষ।
জানা গেছে, এসব রিকশা থেকে প্রতি মাসে বড় অঙ্কের চাঁদাবাজি হয়ে থাকে। যা স্থানীয় থানাসহ রাজনৈতিক পরিচয়ধারী নেতা-কর্মীরা ভাগ পেয়ে থাকে। ঢাকা শহরের মতো দেশের বিভিন্ন এলাকায় এই ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা এখন রাস্তার বিষফোঁড়া। এলাকার ভেতরের রাস্তায় এসব রিকশা চলাচলের কথা থাকলেও এগুলো সব সময় মহাসড়কে উঠে আসে। ফলে প্রতিনিয়ত বাড়ছে দুর্ঘটনা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব নিয়ন্ত্রণ করা যায় না রাজনৈতিক কারণেই। কারণ দিনশেষে এ থেকে বড় অঙ্কের চাঁদাবাজি হয়ে থাকে। যার ভাগ রাস্তার পাতি নেতা থেকে শুরু করে প্রশাসন পর্যন্ত পেয়ে থাকে। তবে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে চাঁদাবাজি বন্ধ রয়েছে। অনেকের মতে, এগুলো নির্মুল করার এখনই উপযুক্ত সময়।
দেশের অনেক সড়কেই নিয়ন্ত্রণহীনভাবে চলে থাকে ধীরগতির ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, ভ্যান, ইজিবাইক, নসিমন, করিমন, মাহিন্দ্রা গাড়িগুলো। অন্যদিকে, দূরপাল্লার পরিবহনগুলো দ্রুত গতির হয়ে থাকে। এতে বাড়ছে দুর্ঘটনা। সরু রাস্তা ও ধীরগতির অবৈধ যানবাহনের কারণে সৃষ্টি হচ্ছে দুর্ভোগও।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ট্রাফিক বিভাগের কাছে সঠিক কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও পুরো দেশজুড়েই চলছে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক। ধারণা করা হয় এ সংখ্যা ৫০ লাখেরও বেশি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঢাকাসহ দেশের জেলা শহরগুলোতে চলাচল করছে। সারা দেশে এই অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশা ও তিন চাকার অটোবাইকের ব্যাটারি চার্জ দেওয়া হয়। এতে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ বিদ্যুতের খরচ হচ্ছে। সাধারণত একটি ইজিবাইক চালানোর জন্য চার থেকে পাঁচটি ১২ ভোল্টের ব্যাটারি প্রয়োজন। আর প্রতি সেট ব্যাটারি চার্জের জন্য গড়ে ৯০০ থেকে ১১০০ ওয়াট হিসেবে পাঁচ থেকে ছয় ইউনিট (দিনে বা রাতে কমপক্ষে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা) বিদ্যুৎ খরচ হয়। সে হিসেবে এক লাখ ইজিবাইক বা ব্যাটারিচালিত রিকশা চার্জের জন্য জাতীয় গ্রিড থেকে প্রতিদিন অন্তত ১১০ মেগাওয়াট এবং মাসে ৩৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ খরচ হওয়ার কথা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অধিকাংশ গ্যারেজ চুরি করে ও লুকিয়ে বিদ্যুৎ ব্যবহার করে এসব ব্যাটারি রিচার্জ করায় সরকার বিদ্যুতের বড় অঙ্কের রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করেন বুয়েটের প্রফেসর ও গণপরিবহণ বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল হক। গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, রেজিস্ট্রেশনবিহীন যেসব গাড়ি যেমন- ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, নছিমন, করিমন সেগুলোর বিষয়ে করণীয় কী এগুলো কেউ ভাবছেন বলে মনে হচ্ছে না। বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক প্রফেসর হাদিউজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেন, সিঙ্গেল সড়কগুলো যখন সরাসরি মহাসড়কের সঙ্গে সংযুক্ত করে দেওয়া হয় আর আইন করা হয় এসব তিন চাকার যান মহাসড়কে ওঠা নিষেধ, তাহলে বিকল্প রাস্তা প্রয়োজনের জন্য। তিনি বলেন, গত ১৫ বছরে কয়েক লাখ মানুষের কর্মনির্ভর করে এখানে। তিনি বলেন, সব মহাসড়কের দুই পাশে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সার্ভিস রোড চালু করতে হবে। এতে মহাসড়ক একদিকে ঝুঁকিমুক্ত হবে এবং থ্রি-হুইলারসহ অযান্ত্রিক যানবাহন চলাচল বন্ধ হবে। আনফিট যানবাহন সরিয়ে নিতে হবে।
ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) বলেন, রাজধানীর যত্রতত্র চলছে ব্যাটারিচালিক রিকশা। ট্রাফিক পুলিশ নগরীর ১০৯টি পয়েন্টে চেকপোষ্ট বসিয়ে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন করা হচ্ছে। কোন কোন দিন প্রায় ৩হাজার ব্যাটারিচালিক রিকশার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন করা হচ্ছে।
খোন্দকার নজমুল হাসান আরও বলেন, শুধু আইন প্রয়োগ করে এ ধরনের রিকশার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন করা সম্ভব নয়। এ জন্য নগরীর সাধারণ মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। ব্যাটারিচালিক রিকশা দ্রুতগতির হওয়ায় দুর্ঘটনাও ঘটছে। সাধারণ মানুষ ব্যাটারিচালিক রিকশা ব্যবহার বন্ধ করলে বা কমিয়ে দিলে চালকদের মধ্যে আগ্রহ কমবে। সকলের সহযোগিতা থাকলে ব্যাটারি চালিত রিকশার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন করে সফল হবে পুলিশ।