
মইনুল ইসলাম মিতুল : পর্যটনের অপার সম্ভাবনা সত্বেও যোগাযোগ অবকাঠামোর অভাবে পিছিয়ে ছিল । কিন্তু পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর এই ‘সাগরকন্যা’ সেজেছে নতুন রূপে। বেড়েছে পর্যটকও। তবে অপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনায় পর্যাটকদের ভোগান্তি রয়ে গেছে।
পদ্মা সেতু চালুর পর কুয়াকাটার প্রতি পর্যটকদের কাছে আগ্রহ বেড়েছে জানিয়ে রুম্মান ইমতিয়াজ বলেন, এবার চট্টগাম, মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, গাজীপুর, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, জামালপুর থেকেও পর্যটকর আসছেন। তার যুক্তির বাস্তবতাও পাওয়া গেল। নেত্রকোনা থেকে যাওয়া পর্যটক সোহেল, নাদিম, বিনয় ও বিপ্লব বলেন, ১১ ঘণ্টায় আমরা নেত্রকোনা থেকে এখানে এসেছি। নাদিয়া জানালেন, প্রাইভেটকারে ১০ ঘণ্টার কম সময়ে তারা পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এখানে পৌঁছান।
কুয়াকাটা হোটেল-মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোতালেব শরীফ বলেন, কুয়াকাটায় অ্যাসোসিয়েশনভুক্ত হোটেল-মোটেল আছে ৭৪টি। এর বাইরে আছে ৫৬টি হোটেল-মোটেল। প্রথম শ্রেণির হোটেল রয়েছে ১৫টি। এসব হোটেল-মোটেলে সর্বোচ্চ ১৫ হাজারের মতো পর্যটক রাত যাপন করতে পারেন।
মোতালেব শরীফ আরো বলেন, আগে শুধু শীতকালে কুয়াকাটায় বেশি পর্যটক বেড়াতে আসতেন, এখন পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় সারা বছরই কুয়াকাটায় পর্যটকেরা আসতে পারবেন। সেভাবেই আমরা সবকিছু ঢেলে সাজাচ্ছি।
এদিকে কুয়াকাটাসহ আশপাশের এলাকা ঘুরে বেড়ানোর জন্য ৩০০-৩৫০ ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল রয়েছে। এসব মোটরসাইকেলচালক সমিতির সভাপতি আব্বাস কাজী। তিনি বলেন, পর্যটক বেড়ে যাওয়ায় একেকজন মোটরসাইকেলচালক এখন দিনে ১ হাজার ২০০ থেকে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করছেন। তাতে হিসাব করলে দেখা যায়, ৩৫০ মোটরসাইকেল থেকে দিনে গড়ে ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা আয় হচ্ছে।
কুয়াকাটা পর্যটন পুলিশের পরিদর্শক হাসনাইন পারভেজ বলেন, পর্যটকদের নিরাপত্তায় পর্যটন পুলিশের বেশ কয়েকটি দল এ কাজ করছে। সৈকতে যাতে কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে, সে জন্যও তৎপর রয়েছে পর্যটন পুলিশ।
সৈকতের পাশেই দেড় শতাধিক একর জমিতে অবস্থিত নারিকেল বাগান যা ‘নারিকেল কুঞ্জ’ নামেই পরিচিত। ১৯৬০ সালে ১৬৭ একর খাস জমি লীজ নিয়ে জনাব ফয়েজ মিয়া ‘ফার্মস এন্ড ফার্মস’ নামে এ বাগান করেন। সৈকতের পূর্ব দিকে রয়েছে মনোরম ঝাউ বাগান। ১৯৯৭/৯৮ অর্থ বছরে বন বিভাগ ১৫ হেক্টর জমিতে সি বিচ সংলগ্ন ঝাউ বাগান গড়ে তোলে। এর পরেই রয়েছে আর এক বিশাল বনাঞ্চল চরগঙ্গামতি। বনের মধ্যে রয়েছে ছৈলা, কেওড়া ও কড়াই বাগান ও একটি নয়নাভিরাম লেক। কুয়াকাটা সমূদ্র সৈকত থেকে ৫ কিলোমিটার পশ্চিমে লেম্বুর চরে বন বিভাগের একটি বাগান আছে। বনে রয়েছে কড়াই, গেওয়া, ছৈলা ও কেওড়া গাছ। বেড়াতে আসা পর্যটকরা এখানে যায়। আন্ধারমানিক নদীর মোহনার পূর্ব দিকে লেম্বুর চর আর পশ্চিম দিকে রয়েছে ফাতরার চরের বিশাল বনাঞ্চল।
ভৌগোলিক ভাবে বরগুনা জেলায় বাগানটির অবস্থান থাকলেও কুয়াকাটায় আগত পর্যটকরা বিনোদনের জন্য সেখানে ট্রলার যোগে যাতায়াত করেন। কুয়াকাটা সৈকতের ৭ কিলোমিটার পশ্চিমে রয়েছে শুটকি পল্লী। সেখানে পর্যটকরা তাজা মাছ কেটে শুটকিজাত করার দৃশ্য দেখতে ভিড় জমান। সরকারিভাবে গঙ্গামতিতে ইকোপার্ক ও বিমানবন্দর করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এ ছাড়াও কুয়াকাটা উন্নয়নের জন্য মাস্টার প্লানের কাজ চলমান।
পর্যটকরা জানিয়েছেন, ভোরে ঢাকা থেকে যাত্রা করে দুপুরের আগেই কুয়াকাটা পৌঁছে দিনভর ঘোরাঘুরি শেষে বিকেলে সূর্যোদয় দেখে রাতে আবার ঢাকায় ফিরতে পেরেছেন তারা। এক সময় ঢাকা থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত ১২ থেকে ১৪টি ফেরি সার্ভিস ছিল। সে কারণে কুয়াকাটায় পৌছাতে ২৪ থেকে ২৪ ঘণ্টা সময় লাগতো। সর্বশেষ ভোগান্তি ছিল মাওয়া-জাজিরা পয়েন্টের ফেরি। পদ্মা সেতু নির্মিত হওয়ায় মাত্র ৫ ঘণ্টায় কুয়াকাটা পৌছতে পেরে আনন্দিত পর্যটকরা।
পদ্মা সেতুর সুফলে এবার চট্টগ্রাম, জামালপুর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, গাজীপুর, মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ সহ বিভিন্ন জেলার পর্যটকরা আসছেন সাগরকন্যা কুয়াকাটার সৌন্দর্য উপভোগ করতে। ১৩টি দর্শনীয় স্পট দেখতে হাজার হাজার দর্শনার্থীদের উপচেপড়া ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। সমুদ্রে ঢেউয়ের তালে তালে দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে তরুণ তরুণীসহ নানান পেশার মানুষ। সমুদ্রে গোসল, ফুটবল খেলাসহ নানা আনন্দ উল্লাসে মেতে আছে পর্যটকরা।
একাধিক পর্যটকরা জানান, আগে কেবল মাত্র ভোগান্তির জন্যই সাগরকন্যায় আসার আনন্দ ধুলোয় মিশে যেতো। সূর্যোদয় কিংবা সূর্যাস্ত কোনোটাই দেখা সম্ভব হতো না। পরিবার-পরিজন নিয়ে কুয়াকাটায় বেড়াতে আসা একাধিক ব্যক্তি জানান, এবার ছুটির মধ্যেই পরিবার নিয়ে সাগরকন্যার সৌন্দর্য উপভোগ করতে পেরেছেন। ঈদ উল আযহার দিন বিকেল থেকেই কুয়াকাটার একাধিক পর্যটন স্পট পর্যটকদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠেছে। দীর্ঘ ১৮ কিলোমিটারের সমুদ্র সৈকতে রাখাইনদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিভিন্ন প্রাগৈতিহাসিক স্থাপনা নিদর্শন দেখতে গভীর রাত পর্যন্ত ভিড় পরিলক্ষিত হচ্ছে। পর্যটকদের চাপে এবার শতভাগ হোটেল-মোটেল বুকিং হয়ে যাওয়ায় অনেকেই ৪/৫ কিলোমিটার দূরবর্তী হোটেলে কক্ষ ভাড়া নিচ্ছেন।
বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, আমরা সারা দেশে ১ হাজার ১০০ ট্যুরিস্ট অ্যাট্রাকশন পয়েন্ট আইডেন্টিফাই করেছি। এর মধ্যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অ্যাট্রাকশন পয়েন্টের আর্কিটেকচারাল ডিজাইন আমরা করব। আমরা ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যানও করব।
মুহাম্মদ জাবের আরো বলেন, দক্ষিণাঞ্চলকে আমরা প্রায়োরিটি দেব, কারণ ওখানে যাওয়াটা আগে কষ্টসাধ্য ছিল। এখন সেটা সহজ হয়েছে। কুয়াকাটা, পিরোজপুরসহ বরিশালের বিভিন্ন অঞ্চলকে আমরা অগ্রাধিকার দেব। এখানে কিছু নতুন ট্যুরিস্ট অ্যাট্রাকশন তৈরির জন্য কাজ করছি। এর মধ্যে আছে সোনাদ্বীপ, আরেকটা সোনারচর। ১০-১৫ দিন আগে আমরা দেখে এসেছি। কীভাবে এগুলো ডেভেলপ করা যায়, সেটা নিয়ে কাজ করছি।
তবে পর্যটন ব্যবসায়ী ও প্যাসিফিক এশিয়া ট্রাভেল অ্যাসোসিয়েশন (পাটা) বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের মহাসচিব মো. তৌফিক রহমান মনে করছেন, দক্ষিণাঞ্চলে পর্যটনকেন্দ্রিক সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তিনি বলেন, এতদিন মূল সমস্যাটা ছিল যাতায়াত। আরেকটা বড় সমস্যা থাকার ভালো ব্যবস্থাপনা নেই। এটা নিয়ে ভাবতে হবে। ভালো খাবারের জায়গাও নেই। ট্যুরিস্ট অ্যাট্রাকশনের জন্য এসব ক্ষেত্রেই সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা থাকতে হবে।