একসময় রাজধানী ঢাকার খাল, পুকুর, জলাশয় ও নদীগুলো প্রাকৃতিক পানিনিষ্কাশন ও জীববৈচিত্র্যের গুরুত্বপূর্ণ আধার ছিল; কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, শিল্প ও পয়োবর্জ্য পরিশোধন না করেই অপসারণের ফলে এসব জলাধার এখন চরম দূষণের শিকার। যা নগরের পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এক জরিপে দেখা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকার ৫৯ শতাংশ বাড়ির পয়োবর্জ্য (মল ও প্রস্রাব) সরাসরি নালা, খাল ও জলাধারে ফেলা হচ্ছে। এসব বাড়ি ঢাকা ওয়াসার পয়োনিষ্কাশন নালার আওতার বাইরে। নিয়ম অনুযায়ী, এমন ভবনের পয়োবর্জ্য সেপটিক ট্যাংকে রেখে পরিশোধনের বিধান রয়েছে; কিন্তু তা না করে গোপনে পয়োবর্জ্য ফেলা হচ্ছে করপোরেশনের নালায়। যা পরে খাল হয়ে জলাশয় কিংবা নদীতে গিয়ে মিশছে।
ঢাকা উত্তর সিটির ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের ২ হাজার ৯৬৯টি বাড়িতে এ জরিপ চালানো হয়েছে। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি, অর্থাৎ ১ হাজার ৭২৮টি বাড়ির পয়োবর্জ্যের সংযোগ সরাসরি নালায় দেওয়া হয়েছে। ৩০৯টি বাড়িতে সেপটিক ট্যাংক থাকলেও তা কার্যকর নয়। জরিপে মাত্র ৩০ শতাংশ বাড়িতে অর্থাৎ ৯১১টি বাড়িতে কার্যকর সেপটিক ট্যাংক পাওয়া গেছে।
ঢাকা উত্তর সিটির ৮ নম্বর ওয়ার্ডটি বারিধারা, নর্দ্দা ও কালাচাঁদপুর এলাকা নিয়ে গঠিত। ঢাকার অন্যতম অভিজাত এলাকা বারিধারার ১ হাজার ১০১টি বাড়ির মধ্যে ৪৮২টি বাড়ির পয়োবর্জ্যের সংযোগ সরাসরি নালায় দেওয়া হয়েছে। যা মোট বাড়ির প্রায় ৪৪ শতাংশ। এ এলাকার ৩০৯টি বাড়ির সেপটিক ট্যাংক কার্যকর নয়।
বারিধারা ছাড়াও গুলশান এলাকার ৭০ শতাংশ বাড়ির পয়োবর্জ্য সরাসরি নালায় ফেলা হচ্ছে। গুলশানের ৫২৪টি বাড়িতে জরিপ চালানো হয়। এর মধ্যে ৩৬৭টি বাড়ির পয়োবর্জ্যের সংযোগ সরাসরি নালায় পাওয়া যায়। মহাখালী দক্ষিণপাড়া এলাকার ৮৩ শতাংশ বাড়ির পয়োবর্জ্য সরাসরি নালায় ফেলা হয়। এলাকাটির ৫৬৯টি বাড়ির মধ্যে ৪৬৮টি বাড়ির পয়োবর্জ্য সরাসরি নালায় ফেলতে দেখা যায়।
* জরিপটি চালানো হয় গুলশান, বনানী, বারিধারা, নিকেতন, মহাখালী, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, বাড্ডা, খিলগাঁও, মালিবাগ, ইস্কাটন ও মধুবাগ এলাকায়।
* বারিধারা ছাড়াও গুলশান এলাকার ৭০ শতাংশ বাড়ির পয়োবর্জ্য সরাসরি নালায় ফেলা হচ্ছে।
ওয়াসার পয়োনালা থেকে জলাশয়ে
জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা ওয়াসার পয়োনিষ্কাশন নালার সঙ্গে ৩ হাজার ১৯৬টি বাড়ির পয়োবর্জ্যের সংযোগ পাওয়া গেছে।
২০২৩ সালের জুলাই মাসে আফতাবনগরের কাছে দাশেরকান্দিতে ৫০০ মিলিয়ন লিটার পয়োনিষ্কাশন ক্ষমতাসম্পন্ন পয়ঃশোধনাগার বা এসটিপি (সু৵য়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট) চালু করে ঢাকা ওয়াসা। ওয়াসার তথ্য অনুযায়ী দাশেরকান্দি এসটিপিতে তেজগাঁও, নিকেতন, বাড্ডা, বনানী, গুলশান (অংশ), বনানী, রমনা, ইস্কাটন, নয়াটোলা, মগবাজার, ওয়্যারলেস, মৌচাক, আউটার সার্কুলার রোড, মহানগর হাউজিং, হাতিরঝিল, কলাবাগান ও ধানমন্ডি (আংশিক) এলাকার পয়োবর্জ্য শোধন করবে। অর্থাৎ জরিপ চালানো বেশির ভাগ এলাকার পয়োবর্জ্য দাশেরকান্দিতে শোধন করা হবে; কিন্তু দাশেরকান্দিতে পয়োবর্জ্য নিতে এখনো পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়নি।
দূষিত হচ্ছে খাল, নদী ও জলাশয়:
ঢাকার খাল ও জলাশয়ের দূষণ নিয়ে বুয়েটের ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার অ্যান্ড ফ্লাড ম্যানেজমেন্ট (আইডব্লিউএফএম) ২০১৯ সালে ‘স্টাডি অন আরবান ওয়াটার বডিস অ্যান্ড পলিউশন ইন ঢাকা’ শিরোনামে একটি গবেষণা চালায়। তাতে দেখা যায়, শহরের ৪০টির বেশি খাল দূষণে প্রাকৃতিক অবস্থা হারিয়ে ফেলেছে। অনেক খাল নর্দমায় পরিণত হয়েছে। এই দূষণ মূলত অপরিশোধিত পয়োবর্জ্য সরাসরি খালে ফেলার কারণে।
‘রিভার পলিউশন অ্যান্ড সোশ্যাল ইনিকুইটিস ইন ঢাকা’ শিরোনামে ২০২১ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুষ্ক মৌসুমে তুরাগ ও টঙ্গী খালের পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা প্রতি লিটারে ১ মিলিগ্রামে নেমে আসে। যেখানে পানিতে প্রাণ ধারণের জন্য ন্যূনতম ৫-৬ মিলিগ্রাম প্রয়োজন। একই সঙ্গে নদীর পানিতে ব্যাপক মাত্রায় অ্যামোনিয়া, নাইট্রেট ও ফিকাল কলিফর্ম পাওয়া গেছে। এসবের প্রধান উৎস পয়োবর্জ্য। এগুলোর কারণে পানিবাহিত রোগ ছড়ায়।
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, প্রতিদিন প্রায় ৬ কোটি লিটার (৬০ হাজার ঘনমিটার) অপরিশোধিত তরল বর্জ্য সরাসরি নদী ও জলাশয়ে ফেলা হচ্ছে। এর ফলে নদীর পানি এখন পানযোগ্য তো নয়ই, কৃষিকাজ, গোসল বা মাছ চাষের জন্যও অযোগ্য হয়ে উঠেছে।
পয়োবর্জ্য কোনোভাবেই সরাসরি লেক অথবা খালে ফেলার কোনো সুযোগ নেই। অথচ বছরের পর বছর নগরজুড়ে নির্বিচারভাবে এটাই হয়ে আসছে। কর্তৃপক্ষ ও নগর সংস্থাগুলো যেন ঘুমিয়ে আছে। যার ফলে ঢাকার বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদে বর্জ্য ও দূষণ বেড়েছে মারাত্মকভাবে।
কর্তৃপক্ষের গাফিলতি-ব্যর্থতা:
ঢাকার খাল-জলাশয়ে প্রাণ ও জীববৈচিত্র্যের অস্তিত্ব এখন মারাত্মক হুমকির । স্বেচ্ছাচারী নগরায়ণের পাশাপাশি ওয়াসার নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও তদারকির অভাব, রাজউক ও ঢাকা দুই সিটি কর্তৃপক্ষের গাফিলতি ও ব্যর্থতায় অধিকাংশ এলাকায় পয়োনিষ্কাশন নেটওয়ার্ক ভেঙে পড়েছে। ফলে ঢাকার বাসাবাড়ি ও শিল্পকারখানার পয়োবর্জ্যসহ অন্যান্য বর্জ্য নালা-নর্দমা আর খাল-জলাশয়ে সরাসরি নিষ্কাশিত হচ্ছে।
ইমারত বিধিমালা, বিল্ডিং কোড ও স্থানীয় সরকার আইন অনুযায়ী রাজধানীর পয়োবর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বাসাবাড়ি ও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিজস্ব সেপটিক ট্যাংক করার কথা। পয়োবর্জ্য কোনোভাবেই সরাসরি লেক অথবা খালে ফেলার কোনো সুযোগ নেই। অথচ বছরের পর বছর নগরজুড়ে নির্বিচারভাবে এটাই হয়ে আসছে। কর্তৃপক্ষ ও নগর সংস্থাগুলো যেন ঘুমিয়ে আছে। যার ফলে ঢাকার বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদে বর্জ্য ও দূষণ বেড়েছে মারাত্মকভাবে।
দূষণ ঠেকাতে বাসাবাড়িতেই পয়োবর্জ্য শোধনের আধুনিক প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করা দরকার।