রোকসানা মনোয়ার : বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশের তালিকায় শীর্ষস্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। বায়ুদূষণ এখন বিশ্বের বৃহত্তম পরিবেশগত স্বাস্থ্য হুমকি হিসেবে বিবেচিত। এর কারণে বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর প্রায় ৭০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। এমনকি বায়ু দূষণের কারণে বাড়ছে হাঁপানি, ক্যান্সার, হৃদরোগ, সিওপিডিসহ ফুসফুসের বিভিন্ন রোগের মতো অসংক্রামক রোগ। কমছে মানুষের গড় আয়ু। গত ২২ মার্চ প্রকাশিত ‘বিশ্বের বায়ুর মান প্রতিবেদন-২০২১’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। সবচেয়ে দূষিত শহর হিসেবে বলা হচ্ছে ঢাকাকে। এর আগেও বায়ুর মানের সূচকে বাংলাদেশ, বিশেষত ঢাকা কয়েক দফা শীর্ষে উঠে আসে।
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘আইকিউএয়ার’ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে। বিশ্বের ১১৭টি দেশ-অঞ্চলের ৬ হাজার ৪৭৫টি শহরের বায়ুর মান পর্যবেক্ষণ করে এটি তৈরি করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রায় ৪০ হাজার শিশুর মৃত্যুর প্রধান কারণ বায়ুদূষণ। ওই বছরে মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ায় বায়ুর মান সবচেয়ে খারাপ ছিল। বিশ্বের ৫০টি সবচেয়ে দূষিত
শহরের মধ্যে ৪৬টিই এই অঞ্চলে অবস্থিত। মূলত বাতাসে প্রতি ঘনমিটারে মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর সূক্ষ্ম বস্তুকণা ২.৫ মাইক্রোন বা তারচেয়ে ছোট বস্তুকণার পরিমাণ দেখে তালিকা প্রণয়ন করা হয়। ২০২১ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে বাতাসের প্রতি ঘনমিটারে বস্তুকণার আকার ২.৫ মাইক্রোন ৩৮ গুণ বড় বা প্রায় ৭৬.৯ শতাংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মান অনুযায়ী, প্রতি ঘনমিটারে যা থাকার কথা ১০ শাতাংশেরও কম।
বায়ুদূষণের দিক থেকে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের পরে রয়েছে চাদ, পাকিস্তান, তাজিকিস্তান, ভারত, ওমান, কিরগিজস্তান, বাহরাইন, ইরাক ও নেপাল। প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাজধানী শহরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহর ভারতের নয়াদিল্লি। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আমাদের দেশে বায়ু দূষণের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে ইটাভাটা, দীর্ঘমেয়াদি অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণ কার্যক্রম, ময়লা আবর্জনা পোড়ানো, ধারণক্ষমতার কয়েকগুণ বেশি মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ির কালো ধোঁয়া ইত্যাদি। এ ছাড়া নির্বিচারে বনায়ন ধ্বংস, যত্রতত্র গাছ কেটে ফেলা, প্রয়োজনীয় বৃক্ষরোপণ না করা পরোক্ষভাবে বায়ু দূষণের কারণ।
বিশ্বব্যাপী যেসব অসংক্রামক রোগের কারণে মানুষের সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় তার অণ্যতম কারণ বায়ু দূষণ। এই অতিক্ষুদ্র কণা এতোটাই ক্ষুদ্র যে এটি সহজেই মানুষের চোখ-নাক-মুখ দিয়ে প্রবেশ করে রক্তের সাথে মিশে যায়, যা ফুসফুস, হৃদযন্ত্র, কিডনি লিভারসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জটিল অঙ্গকে আক্রান্ত করে থাকে। এমনকি দূষিত বায়ু সেবনে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য। গর্ভপাত, জন্মগত ত্রুটি, শিশুর স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশে বায়ুু দূষণ নেতিবচক প্রভাব রাখছে।
গত বছরে শিকাগো ইউনিভার্সিটির এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউট প্রকাশিত সর্বশেষ এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্সে বলা হয়েছে যে, বায়ু দূষণের কারণে সারা বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু কমেছে প্রায় পাঁচ বছর চার মাস। ঢাকায় কমেছে প্রায় সাত বছর সাত মাস।
এ প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্যবিদ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. খালেকুজ্জামান বলেন, ‘বায়ুদূষণের পরিমাণ যখন বেশি থাকে তখন শিশু হাসপাতালে নিউমোনিয়া ও সিওপিডি রোগী অস্বাভাবিক হারে বাড়ে। এ সময় মানুষের শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি হয়। অ্যাজমা রোগীদের শ্বাসকষ্ট চরম অবস্থায় পৌঁছে। বায়ু দূষণের কারণে গর্ভবতী মায়েরা অক্সিজেন কম পান, ফলে কম ওজনের শিশু জন্ম নেয়। কিছু কিছু বায়ু দূষণ ফুসফুস ক্যান্সার পর্যন্ত ঘটিয়ে থাকে।’ তিনি বলেন, ‘সরকারের উচিত বড় ধরনের স্থাপনার কাজগুলো দিনের বেলায় না করে রাতে করা। এতে মানুষ অপেক্ষাকৃত কম দূষণের শিকার হবে।