ভয়াবহ গ্যাস সংকটে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে গাজীপুর, সাভার, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার, মদনপুর, বন্দর, কাচঁপুর, রূপগঞ্জ, সোনারগাঁ, ফতুল্লার কাঠেরপোল, বিসিক শিল্পনগরীসহ জেলার বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে। গ্যাস সংকটের কারণে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্পের উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে।
এখন তৈরি পোশাক কারখানায় প্রচুর ক্রয়াদেশ রয়েছে। ক্রয়াদেশের প্রতিফলনও তৈরি পোশাক রপ্তানিতেও দেখা যাচ্ছে। দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক, চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট সময়ে এই খাতের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ১২ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ৭.৯৯ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৭.১১ বিলিয়ন ডলার।
বর্তমানে গ্যাস না পাওয়ার কারণে বন্ধ হয়ে গেছে অনেক কারখানা। বিদেশি ক্রেতাদের সময়মতো পণ্য দিতে পারছেন না অনেক রপ্তানিকারক। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশের পোশাক খাতের অর্ডার অন্য দেশে চলে যাওয়ার আশঙ্কা তাদের। তাই সরকারকে দ্রুত গ্যাস সংকট নিরসনে তাগিদ দিয়েছে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ এবং বিটিএমএ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত এক বছরে গ্যাসের এতো সংকট কখনোই ছিলো না। মে মাসেও এই সংকট দেখা দিয়ে ছিলো। তবে তখন মাঝে মধ্যে মেশিন চালাতে পারতো মালিকরা। এখন পুরোপুরিই বন্ধ রয়েছে কল-কারখানা।
গত ১৫-২০ দিন ধরে কোন গ্যাসই নেই। এর ফলে হাজার হাজার মানুষের বেকার হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার, মদনপুর, বন্দর, কাচঁপুর, রূপগঞ্জ, সোনারগাঁ, ফতুল্লার কাঠেরপোল, বিসিক শিল্পনগরীসহ জেলার বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে গ্যাস সংকট দেখা দিয়েছে। যেখানে ১০ পিএসআই গ্যাসের চাপ থাকার কথা, সেখানে নেমে এসেছে শূন্যের কোঠায়। গ্যাস সংকটে উৎপাদন বন্ধ থাকায় অলস সময় পার করছেন শ্রমিকরা। বেতন পাওয়া নিয়ে আছেন অনিশ্চয়তায়।
নারায়ণগঞ্জের বন্দর এলাকায় অবস্থিত টোটাল ফ্যাশন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাছিব উদ্দিন মিয়া সংবাদকে বলেন, ‘গ্যাস সংকটের গত ১৫ দিন ধরে পুরোপুরিভাবে কারখানা বন্ধ। গ্যাসের অভাবে কারখান বন্ধ রাখতে হচ্ছে। তিতাস কতৃপক্ষের কাছে বার বার তাগদা দিয়েও কোন ফল হচ্ছে না। উল্টো তারা লাইন কেটে দেয়ার ভয় দেখায়। এভাবে চলতে থাকলে রপ্তানিতে বাধাগ্রহ হবে।
‘প্রতি মাসে সাড়ে তিন কোটি টাকা কর্মীদের বেতন দিতে হচ্ছে। কিন্তু করাখানা বন্ধ থাকলে কোথা থেকে ১৮০০ লোকের বেতন দিবো,’ প্রশ্ন তার।
হাছিব উদ্দিন বলেন, ‘গ্যাস সংকটে সময় মতো বিদেশি ক্রেতাদের অর্ডারকৃত পণ্য না দিতে পারায় অনেক অর্ডার বন্ধের পথে। অথচ তিতাস বিলের জন্য দুইদিন দেরি হলেই সাথে সাথে লাইন কেটে দেয়। কোনও বিল বকেয়া রাখা যায় না। কিন্তু গ্যাস দেয়ার বেলায় নাই।
নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা বিসিক এলাকায় অবস্থিত এমএস ডাইং ফিনিশিং মিলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিনুর রশীদ জানান, ‘৫ হাজার কর্মী কাজ করে আমার প্রতিষ্ঠানে। তাদের বেতন-ভাতা দেয়া নিয়ে চিন্তায় আছি। গত মে মাসে একই সংকটে ছিলাম। পরে জুলাইয়ের পরে মোটামুটি গত কয়েক মাস গ্যাস পেয়েছিলাম। যদিও আশানুরু না। তারপরেও মোটামুটিভাবে কারখানা ৬-৭ ঘন্টা চালিয়ে রাখা গেছে। এখন আবার সেই মে মাসের মতো অবস্থা। এখন গত ১৫-২০ দিন ধরে একেবারেই নাই। পুরোপুরিভাবে বন্ধ কারখানা।
আইএফএস টেক্সওয়ার পাইভেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সালেহ উদ্দিন আহমেদ জানান, ‘আমরা বিদেশি ক্রেতাদের কাছ থেকে অর্ডার নিয়েছি কিন্তু গ্যাস সংকটের কারণে ডায়িং করতে পারছি না। গ্যাসের প্রেসার নেই। যখন থাকে তখন এত কম থাকে আমরা জেনারেটর চালাতে পারি না। দিনের অর্ধেকের বেশি সময়ই জেনারেটর বন্ধ রাখতে হচ্ছে গ্যাস না থাকার কারণে। বয়লার বন্ধ। কাপড় ডাইং মেশিনে উঠানো হলেও কন্টিনিউ প্রসেস না হলে, গ্যাস ফল্ট করলে তখন ফেব্রিক্স এর সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। আবার দ্বিতীয়বার ডাইং করতে দুই গুণ সময় লাগে। তাতে বেড়ে যায় উৎপাদন খরচ। কিন্তু বিদেশি ক্রেতারা এটা বোঝে না। বিদেশি ক্রেতারা বলেন, গ্যাস সংকট এটা তোমাদের সমস্যা, আমাদের তাতে কী। তোমরা অর্ডার নিয়েছো সময় মতো অর্ডার শিপমেন্ট করবা।
মহিউদ্দিন টেক্সটাইলে ডাইং লিমিটেডের পরিচালক শফিক আহমেদ জানান, ‘বিদেশি ক্রেতাদের নির্দিষ্ট একটি সময় থাকে। সেই সময়ের মধ্যে শিপমেন্ট করতে হয়। গ্যাস সংকটের কারণে দুই-তিন দিন শিপমেন্ট পিছানো কিংবা উৎপাদন দেরি হচ্ছে সেটা বিদেশি ক্রেতারা বুঝতে চায় না। একদিকে গ্যাস সংকটের কারণে উৎপাদন বন্ধ, অন্যদিকে শ্রমিকরা অলস সময় পার করছে। গত এক বছরে মধ্যে এতো খারাপ সময় ছিলো না।
গাজীপুরের ভবানীপুরের মোশারফ কম্পোজিট টেক্সটাইল মিলস সুতার পাশাপাশি ডাইং ও তৈরি পোশাক উৎপাদন করে। গ্যাসচালিত ক্যাপটিভ জেনারেটরের সাহায্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের নিজস্ব ব্যবস্থা রয়েছে তাদের। কারখানাটির অনুমোদিত গ্যাসের চাপ হচ্ছে ১৫ পিএসআই (প্রতি বর্গইঞ্চিতে গ্যাসের চাপের ইউনিট)। এখন সারা দিন সেই চাপ থাকে ১-৫ পিএসআইয়ের মধ্যে।
মোশারফ কম্পোজিট টেক্সটাইলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোশারফ হোসেন বলেন, ‘গ্যাস সংকটে অতিষ্ঠ হয়ে আমরা ১০ কোটি টাকা খরচ করে পল্লী বিদ্যুতের সংযোগ নিয়েছি। ডিজেল জেনারেটর স্থাপন করেছি। তারপরও আশি-নব্বই শতাংশের বেশি উৎপাদন করতে পারছি না। যদিও কারখানার জ্বালানি বাবদ খরচ ১৫ শতাংশের মতো বেড়েছে।
তিনি বলেন, গ্যাস সংকটের কারণে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় এখন তার ‘লোকসান গুনতে’ হচ্ছে।
সাভারের লিটল স্টার স্পিনিং মিল চার বছর ধরে গ্যাস সংকটের মধ্যে রয়েছে। কারখানাটির অনুমোদিত গ্যাসের চাপ ১০ পিএসআই হলেও দিনের বেলা (কারখানার উৎপাদনের সময়) কখনোই ২-৩ পিএসআইয়ের বেশি পাওয়া যায় না। চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস না পাওয়ায় ইতিমধ্যে মিলের ৩০-৪০ শতাংশ যন্ত্রপাতি অকেজো হয়ে পড়েছে। সব মিলিয়ে ৪ বছরে প্রতিষ্ঠানটিকে ১৪৫ কোটি টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে।
প্রতিষ্রঠানটির চেয়ারম্যান খোরশেদ আলম সংবাদকে বলেন, ‘তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কম করে হলেও ৪০টি বৈঠক করেছি। কিন্তু কোনো প্রতিকার পাচ্ছি না। বাধ্য হয়ে পল্লী বিদ্যুতের সংযোগ নিয়েছি। ডিজেল জেনারেটর কিনেছি। তারপরও দিনে যেখানে ২৬ হাজার পাউন্ড সুতা উৎপাদনের কথা, সেখানে উৎপাদন করতে পারছি মাত্র ১৫ হাজার পাউন্ড।
আক্ষেপ করে খোরশেদ আলম বলেন, ‘গ্যাস–সংকটের কারণে ৮ বছরে ১৬ কোটি টাকা লোকসানের পর বাইপাইলের একটি স্পিনিং মিল বন্ধ করে দিয়েছি। বর্তমানে গ্যাসের যা অবস্থা, তাতে ভবিষ্যতে আর ব্যবসা সম্প্রসারণে যাব না।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) এর সহ-সভাপতি সালেউদ জামান খাঁন সংবাদকে বলেন, ‘গ্যাসের সংকটে প্রায় অর্ধেকরও বেশি শিল্প-কারখানা বন্ধ রয়েছে। পণ্যের অর্ডার রয়েছে কিন্তু গ্যাসের অভাবে কারখানা চালু করতে পারছেন না মালিকরা। গ্যাস না পেলে মালিকদের পাশাপাশি সরকারও আয় হারাবে। এব্যাপারে তিতাসের সাথে বার বার যোগাযোগ করেও কোন উত্তর পাচ্ছি না। তাই এই সংকট উত্তরণের জন্য সরকারকে বিশেষ অনুরোধ জানাই।
রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম জানান, ‘গ্যাস সংকটের কারণে কোনাবাড়ী, সাভার, আশুলিয়াসহ কয়েকটি এলাকার ডাইং ও ওয়াশিং কারখানা একবারেই বন্ধ রয়েছে। সঠিক সময়ে পণ্য ডেলিভারি দিতে না পারায় অনেক অর্ডার বাতিল হয়ে যাচ্ছে। গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি হয়েছে কিন্তু গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। উৎপাদন খরচ বেড়েছে। কিন্তু গ্যাস সংকটে পোশাক উৎপাদন ব্যাহত ও রপ্তানি সংকুচিত হচ্ছে। পাশাপাশি গ্যাস না পেয়েও গ্যাসের বিল পরিশোধ করতে হচ্ছে।
বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ‘গ্যাস সংকটের কারণে ফ্যাক্টরিগুলোর প্রোডাকশন অনেক কমে গেছে। একদিকে অর্ডার কম অন্যদিকে উৎপাদন খরচ আরও বাড়তে যাচ্ছে। শ্রমিকদের বেতন বাড়ছে। এই ক্ষেত্রে আমরা যদি গ্যাস না পাই তাহলে সময়মতো পণ্য রপ্তানি করা সম্ভব হবে না। নিরবিচ্ছিন্ন গ্যাস না পাওয়া গেলে নতুন শিল্প উদ্যোক্তারা যেমন মুখ ফিরিয়ে নেবে তেমনি শিল্প কারখানা বন্ধ হলে লাখ লাখ শ্রমিক চাকরি হারাবে।
এব্যাপারে এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম সংবাদকে বলেন, ‘শুনতে পারছি অনেক জায়গায় গ্যাস নেই। তাই এব্যাপরে তিতাস কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলবো।