সুফিবাদ (সুফিবাদ বা সুফি দর্শন, আরবি- সুফিয়াত বা তাসাউফ) একটি ইসলামি আধ্যাত্মিক দর্শন। আত্মা সম্পর্কিত আলোচনা এর মুখ্য বিষয়। সুফিবাদের একমাত্র মূল বিষয়টি হল, আপন প্রাণ বা আত্মার সাথে পরমাত্মা ‘আল্লাহ’ যে শয়তানকে আমাদের পরীক্ষা করার জন্য দেওয়া হয়েছে, তার সাথে জেহাদ করে থেকে মুক্তি লাভ করা। এক কথায় এই জড় জগত থেকে মুক্তি পাওয়া। আত্মার পরিশুদ্ধির মাধ্যমে সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তার সাথে সম্পর্ক স্থাপনই হল এই দর্শনের মর্মকথা।
সুফিবাদের সংজ্ঞা
পরম সত্তা মহান আল্লাহ কে জানার আকাঙ্ক্ষা মানুষের চিরন্তন। স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ককে আধ্যাত্মিক ধ্যান ও জ্ঞানের মাধ্যামে জানার প্রচেষ্টাকে সুফি দর্শন বা সুফিবাদ বলা হয়। হযরত ইমাম গাজ্জালি (র.) এর মতে, আল্লাহ ব্যতীত অপর মন্দ সবকিছু থেকে আত্মাকে প্রবিত্র করে সর্বদা তাঁর আরাধনায় নিমজ্জিত থাকা এবং সম্পূর্ণ রূপে আল্লাহুতে নিমগ্ন হওয়ার নামই সুফিবাদ । শেখ সাদী (র.) বলেন, ‘এই সমুদ্রে হাজার কিশতি (পড়ুন নৌকা) ডুবে গেছে, কিন্তু একটিও ভেসে উঠে নদীর তীরে পৌঁছেনি।’
জড়বাদ মানুষের যে অধিকার ছিনিয়ে নিয়েছে বুদ্ধিবাদ তা পূর্ণ করতে পারেনি বলে সেই শূন্যতা পূরণ করেছে ইসলামের আধ্যাত্মিকতা। আর ইসলামের এই আধ্যাত্মিক জ্ঞানের নাম হলো সুফিবাদ। মানুষের জীবন আত্মা ও দেহের সমন্বয়ে গঠিত। সুফিবাদের যে জ্ঞানের সাহায্যে আত্মাকে পরিশুদ্ধ করা হয়, তাকে বলা হয় এলমে তাসাউফ।
‘সুফি’ শব্দের উৎপত্তি
ইবনে খালিদুন, ড. এ. ই আফিফি, আল-কালবাদি, আর-রুদবারি, আবু নসর আস-সাররাজ প্রমুখ প-িতদের মতে, ‘সুফি’ শব্দটি সুফুন থেকে নির্গত; যার অর্থ পশম। পশমি বস্ত্র সরলতা ও আড়ম্বরহীনতার প্রতীক। হজরত মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর সাহাবিরা বিলাসী জীবনযাপনের পরিবর্তে সাদাসিধে পোশাক পরতেন এবং পরবর্তীকালে সুফিরা সাদাসিধে জীবনযাপনের জন্য এই পোশাক গ্রহণ করে কম্বল-সম্বল করে চলেন বলে তাঁদের সুফি বলা হয়।
আলী হাজাবিরি, মোল্লা জামি (র.)-এর মতে, সুফি কথাটি সাফা থেকে নির্গত, যার অর্থ পবিত্রতা, আত্মশুদ্বি ও সচ্ছলতা। যাঁরা আত্মার শুদ্ধির সাধনায় নিয়োজিত থাকেন, তাঁদের সুফি বলা হয়। মুসলিম দার্শনিকেরা ও আধ্যাত্মিক সাধনায় সাধনাকারী ব্যক্তিরা বিভিন্নভাবে সুফিবাদের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন।
ইমাম শামি (র.) বলেন, ‘সুফিবাদ হলো আধ্যত্মিক জ্ঞান, যে জ্ঞানের সাহায্যে মানুষের সদগুণাবলির প্রকারভেদ এবং তা অর্জনের পন্থা ও অসদগুণাবলির প্রকারভেদ ও তা থেকে রক্ষার উপায় জানা যায়।
ইমাম গাজ্জালি (র.) বলেন, ‘তাসাউফ এমন একটি বিদ্যা, যা মানুষকে পশু থেকে উন্নীত করে মনুষ্যত্বের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে দেয়।’
উল্লিখিত সংজ্ঞাগুলো পর্যালোচনায় বলা যায়, হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর নির্দেশিত পথে আত্মশুদ্ধি করে ইসলামের বাহ্য ও অন্তর জীবনের প্রেমপূর্ণ বাস্তব অনুশীলনের মাধ্যমে পরম সত্তার পূর্ণ জ্ঞানার্জন ও তার নৈকট্য লাভের রহস্যময় উপলব্ধিকে সুফিবাদ বলা হয়।
সুফিবাদের উৎপত্তি
সুফিবাদের উৎপত্তি সম্পর্কে পণ্ডিতদের মধ্যে মতবিরোধ লক্ষ করা যায়। তাঁদের মতামতগুলো পর্যালোচনায় যা পাওয়া যায়-১) বেদান্ত ও বৌদ্ধ দর্শনের প্রভাব; ২) খ্রিস্টীয় ও নিও-পেটানিক প্রভাব; ৩) পারসিক প্রভাব এবং ৪) কোরআন-হাদিসের প্রভাব। প্রথম তিনটি মতবাদকে অভ্যন্তরীণ মতবাদ বলা হয় আর শেষেরটিকে বলা হয় বাহ্যিক উৎস।
পাশ্চাত্যের কিছু চিন্তাবিদ তথা গোল্ডজিহার, এইচ মার্টেন প্রমুখদের মতে, সুফিবাদ বেদান্ত দর্শন ও বৌদ্ধ দর্শন থেকে উদ্ভূত। কিন্তু হাসান বসরি, জুন্নুন মিসরি, আবুল হাশিম কুফি, ইব্রাহীম বিন আদহাম, রাবেয়া বসরি প্রমুখ সুফিদের আবির্ভাব ও সাধনা প্রমাণ করে, সুফিবাদ ভারতীয় পণ্য নয়, বরং ইসলামের আধ্যাত্মিক শিক্ষার ফলে সুফিবাদের উদ্ভব ঘটে।উল্লেখ্য, বৌদ্ধধর্মে নির্বাণ সত্তায় আত্মবিলোপ শেষ স্তর হলেও মুসলিম সুফিরা ফানাকে শেষ স্তর বলে মনে করেন না বরং তাঁরা বাকাবিল্লাহকে সুফি-পথপরিক্রমার সর্বশেষ স্তর মনে করে থাকেন।
তাই অধ্যাপক নিকলসন ও ভনক্রেমার এ মতামত ব্যক্ত করেছেন যে, মুসলমানদের ভেতর সুফিবাদের আবির্ভাব ঘটেছে খ্রিস্টীয় ও নিওপ্লেটনিক মতবাদ থেকে। কিন্তু তাদের বিপরীতে যুক্তি হলো, মুসলিম সুফি-সাধকেরা খ্রিস্টীয় সন্যাসীদের মতো সংসার-বিরাগী নয়।
ঐতিহাসিক ব্রাউনি ও তাঁর অনুসারীদের মতে, সুফিবাদের উৎপত্তি ঘটেছে পারসিক প্রভাব থেকে। কিন্তু এ মতও সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও ভিত্তিহীন। কারণ আবু বকর ইবনুল আরাবি ও ইবনুল ফরিদসহ অনেক দার্শনিক আরবিভাষী ছিলেন। প্রকৃত অর্থে, ইসলামি আধ্যাত্মিক শিক্ষার মূল উৎস হলো কোরআন।
যদিও কোরআন ও হাদিসে ‘সুফিবাদ’ শব্দটি সরাসরি ব্যবহার করা হয়নি; তবে অসংখ্য আয়াত ও হাদিস দ্বারা সুফিবাদ তথা আধ্যাত্মিক জ্ঞানের দিকে বিশেষভাবে উৎসাহিত করা হয়েছে। ইবনে খালদুন অত্যন্ত জোর গলায় বলেন, ‘সুফিবাদ এমন এক ধর্মীয় বিজ্ঞান, যার উৎপত্তি খোদ ইসলাম থেকে হয়েছে।’
কোরআনের অসংখ্য আয়াত রয়েছে, যার দ্বারা মরমিধারাকে ইসলামে বিশেষভাবে উৎসাহিত করা হয়েছে। যেমন-
১) ‘তাঁর সিংহাসন সমস্ত আসমান ও জমিনকে পরিবেষ্টিত করে আছে।’ (বাকারা : ২৫৫)২) ‘তিনিই প্রথম, তিনিই সর্বশেষ, তিনিই প্রকাশমান ও অপ্রকাশমান এবং তিনি সব বিষয়ে সম্যক পরিজ্ঞাত।’ (হাদিদ : ৩)
৩) ‘তিনি তোমাদের সাথে আছেন তোমরা যেখানেই থাকো।’ (হাদিদ : ৪)
৪) ‘তারা খাঁটি মনে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত করবে।’ (বাইয়েনা : ৫
৫) হাদিসেও তাসাউফের কথা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়।
একবার হজরত মোহাম্মদ (সা.)-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে ইহসান কী? তিনি উত্তরে বলেছিলেন, ‘ইহসান হলো এ বিষয় যে, তুমি যখন নামাজ পড়বে, তখন তুমি এ মনে করবে যে, আল্লাহকে তুমি দেখছ আর তাও যদি সম্ভব না হয় তাহলে এই মনে করবে যে, আল্লাহ তোমাকে দেখছেন।
অর্থাৎ কোরআনের আয়াত ও হাদিস দ্বারা এ কথা অকাট্যভাবে প্রমাণিত যে সুফিবাদ কোরআন-হাদিস থেকে নিঃসৃত একধরনের বাতেনি জ্ঞান। বলা বাহুল্য, ইসলামি পরিভাষায় যে জ্ঞান একাগ্রতা ও ধ্যানের মাধ্যমে অর্জন হয় এবং তার কোন সীমা পরিসীমা নেই সেই জ্ঞানকে ইসলামিক পরিভাষায় ‘বাতেনি জ্ঞান বলে।
হজরত (সা.) হেরা গুহায় গভীর ধ্যানে নিমজ্জিত থাকতেন, যার দ্বারা বোঝা যায় তিনি আধ্যাত্মিক জীবন সাধনায় প্রায় সময় ব্যস্ত থাকতেন। কোরআন-হাদিসে সুফিবাদকে বিভিন্ন নামে নামকরণ করা হয়েছে। যেমন এলমে বাতেনি, এলমে লাদুনি, এলমে তরিকত, এলমে মা’রিফত।
সুফিবাদের ক্রমবিকাশ
সর্বপ্রথম মুসলিম সুফি হিসেবে চিহ্নিত করা হয় হজরত হাসান বসরি (র.)-কে। তাঁর জ্ঞানতত্ত্বের আলোকে পরবর্তী সুফি-সাধকেরা সুফিবাদের ক্রমবিকাশে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন। ভিন্নমতে, সর্বপ্রথম সুফি হিসেবে যাঁর নাম স্বীকৃতি দেওয়া হয়, তিনি হলেন আবয় হাশিম কুফি। হিজরী দ্বিতীয় শতকে সুফিবাদের জনপ্রিয়তা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেতে থাকে।
এ সময়ের উল্লেখযোগ্য সুফিরা হলেন ইব্রাহীম বিন আদহাম, রাবেয়া বসরি, দাউদ আততায়ী ও ফুজায়ল বিন হাইয়াজ প্রমুখ। পরবর্তীকালে সুফিবাদের ক্রমবিকাশে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেন জুন্নুন মিসরি। তিনি সুফিবাদের সর্বপ্রথম ব্যাখ্যাদানকারী।
কালক্রমে সুফিবাদে সর্বেশ্বরবাদের ধারণা যুক্ত হতে থাকে। এ ধরনের মতবাদের মূল প্রবক্তা বায়েজিদ বোস্তামী ও মানসুর হাল্লাজ। তবে মানসুর হাল্লাজের বক্তব্য কিছুটা বিতর্কিত ছিল।
অতঃপর ইমাম গাজ্জালির সময় থেকে সুন্নিবাদী মতবাদ সুফিবাদের ভেতরে একটি বিশেষ স্থান দখল করে নেয়। তিনি গোড়া ইসলাম ও সুফিবাদের মধ্যে সুন্দর সমন্বয় করেন। তার সময়ের সুফিদের মধ্যে আবদুল কাদের জিলানি, ফরিদ উদ্দিন আত্তার, আল-কুশাউরি, শিহাবুদ্দিন সোহরাওয়ার্দীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
সপ্তম হিজরিতে স্পেনে ইবনুল আরাবি সর্বেশ্বরবাদের প্রচলন করেন। তাঁর মরমি ধারার ক্রমবিকাশে সাহায্য করেছিলেন জালালুদ্দিন রুমি (রাঃ)। অতঃপর ভারতীয় উপমহাদেশে অনেক সুফির আবির্ভাব ঘটে, যাঁদের মধ্যে খাজা মইনুদ্দিন চিশতি, মুজাদ্দেদ আলফেসানির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
তথ্য- ইন্টারনেট