গাজী শাহনেওয়াজ :নাগরিকের বিদ্যমান তথ্যের
সঙ্গে চাহিদার তথ্যের গরমিল থাকায় জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) সংশোধনে প্রতিনিয়ত
সংকটের মুখোমুখি হতে হচ্ছে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি)। কারণ নিবন্ধনকালে যে তথ্য
দিয়েছেন, পরবর্তী সংশোধনের সময় দেখা যাচ্ছে ভিন্ন তথ্য ও দলিল উপস্থাপন করেছে
সংশ্লিষ্ট ভোটার।
দেখা
গেছে, আগের তথ্যের সঙ্গে পরের দেওয়া তথ্য বাস্তবতার সঙ্গে খুবই অসামঞ্জস্যপূর্ণ।
এনআইডি কর্তৃপক্ষ জানায়, বিশেষ করে শিক্ষা সনদ, ভূমির দলিল ও মুক্তিযোদ্ধা সনদের ভিন্নতা বেশি দেখা যায়। এ নিয়ে গত ১২
এপ্রিল একটি সভা করেছিলেন। সভায় এনআইডি কর্তৃপক্ষ ছাড়াও মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়,
বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড, বাংলাদেশ
উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি, বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা
বিভাগ, ভূমি মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন শিক্ষা
বোর্ডের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন।
আলোচনা
করে শিক্ষা সনদ সংক্রান্ত পাঁচটি কারণ যেমন- নিজ নামের সম্পূর্ণ বা আমূল পরিবর্তন, ধর্মান্তর,
পিতা-মাতার নাম সংশোধন, জন্ম তারিখ পরিবর্তন ও
চাকরির দলিল উপস্থাপন করে আইডি সংশোধন, মুক্তিযোদ্ধা সনদ
সংক্রান্ত তিন কারণ এবং ভূমির দলিল সংক্রান্ত চার কারণ; যেমন-
নিজ নামের ভিন্নতা (নিজ নামের সম্পূর্ণ পরিবর্তন, নামের
আংশিক বা টাইটেল পরিবর্তন, ধর্মান্তরজনিত কারণে নিজ নামের
পরিবর্তন) এবং একই ব্যক্তির দুই নাম যেমন- পারিবারিক ডাকনাম ও শিক্ষা সনদের মূল),
পিতা-মাতা ও জন্ম তারিখ এবং স্বামী-স্ত্রীর নাম পরিবর্তন।
জানতে
চাইলে জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক (গ্রেড-১) এ কে এম হুমায়ুন
কবীর প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, জাতীয় পরিচয়পত্রে থাকা নাম, জন্ম
তারিখ ও পিতা-মাতার নাম সংশোধন নিয়ে আমরা বিড়ম্বনার মধ্যে আছি। এটি সমাধানের জন্য
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে সভা করেছি। সভার রেজুলেশন কমিশন সভায় উপস্থাপনের আগে এ বিষয়ে
মন্তব্য করা সমীচীন হবে না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ২৬
এপ্রিল এ সংক্রান্ত রেজুলেশনে স্বাক্ষর হয়েছে।
শিক্ষা
সনদ সংক্রান্ত নথির তথ্যনুযায়ী এনআইডির বক্তব্যে দেখা গেছে, আবেদনকারীরা
ভোটার নিবন্ধনের সময় যে তথ্য লিপিবদ্ধ করে নিবন্ধিত হয়েছেন পরবর্তীতে আবার ভিন্ন
নাম ব্যবহার করে মাদরাসা-কারিগরি ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে মাধ্যমিক বা সমমানের
পাসের জন্য রেজিস্ট্রেশন করেন।
এখান
থেকে পাস করা সনদ দিয়ে নিজ নাম, জন্ম তারিখ ও স্বাক্ষর সম্পূর্ণ পরিবর্তন চেয়ে
আবেদন করেন, যা অনেক ক্ষেত্রেই ব্যক্তির সঠিকতা যাচাই করা
সম্ভব হয় না। ফলে সংশোধনের আবেদনগুলো নিষ্পত্তি করা জটিল হয়। একইভাবে ধর্মান্তরের
ক্ষেত্রে মাধ্যমিক বা সমমান সনদটি ধর্মান্তরের পূর্বে অর্জনকৃত এবং সনদে
ধর্মান্তরের আগের নামটি লিপিবদ্ধ থাকে। সনদ সংশোধন ছাড়া ধর্মান্তরজনিত কারণে নিজ
নামের সম্পূর্ণ পরিবর্তনের আবেদনগুলো নিষ্পত্তি করা জটিল হয়ে যায়। এ ছাড়া
নিবন্ধনকালে পিতা-মাতার নাম এক রকম ব্যবহার করে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রাপ্তির দীর্ঘ
সময় পর চাকরির দলিল অনুযায়ী পিতা-মাতার নাম বা সম্পূর্ণ পরিবর্তনের আবেদন পাওয়া
যায়। আবেদনের সঙ্গে মাদরাসা-কারিগরি ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে সনদ যুক্ত করা হয়।
ফলে অনেক ক্ষেত্রেই প্রকৃত পিতা-মাতার পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় না।
অনুরূপভাবে শিক্ষা সনদটি আবেদনকারীর নিজের কি না বিষয়টি স্পষ্ট হয় না। তা ছাড়া
অনেকে জাতীয় পরিচয়পত্র গোপন করে বয়স কমিয়ে চাকরিতে প্রবেশ করেন। পরে উন্মুক্ত বা এ
ধরনের সনদ দেখিয়ে আইডি সংশোধন চান- এগুলো বিবেচনায় নিয়ে বিদ্যমান আইডি সংশোধন করতে
গিয়ে ইসি সর্বদা সংকটে পড়ে।
ইসির
এ ধরনের পর্যবেক্ষণের জবাবে বাংলাদেশ কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
মো. আলী আকবর বলেন, সাধারণ শিক্ষা বোর্ড ৮ম শ্রেণি পাসের সনদ দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করেন; সেক্ষেত্রে মাধ্যমিক পাসের বয়সসীমা থাকে সর্বনিম্ন ১৪ বছর বা তদূর্ধ্ব। আর
কারিগরি শিক্ষা বোর্ড ৯ শ্রেণি পাসের সনদ দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করে থাকে। কিন্তু
পরিচয়পত্র নিবন্ধনের জন্য বর্তমানে সর্বনিম্ন বয়সসীমা ১৬ বছর বা তদূর্ধ্ব
(০১-০১-২০০৭ বা তার পূর্বে জন্ম ধরে), যার কারণে সনদের
সঠিকতা নির্ণয় করা দুরুহ হয়ে পড়ে।
আর
বাংলাদেশ কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব মীর মোশাররফ হোসেন
তার অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে বলেন, রেজিস্ট্রেশন করার সময় নাগরিকরা যে পিএসসি ও ৮ম
শ্রেণির সনদ দাখিল করেন এবং নাম, পিতা-মাতার নাম ও জন্ম
তারিখের গরমিল থাকলে, তা পরবর্তী সময়ে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা অফিস
বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হতে ম্যানুয়ালি সংশোধন করে নিয়ে আসেন। এ কারণে সঠিক বা ভুল
নির্ণয় করা জটিল হয়ে পড়ে।
সব
পক্ষের আলোচনার পর সাত ধরনের সিদ্ধান্তে উপনীত হন সভায় উপস্থিত পক্ষগুলো; যেমন- আবেদনকারীর
আগের পিএসসি-জেএসসি সনদের ভিত্তিতে মাধ্যমিক পর্যায়ে রেজিস্ট্রেশন নিশ্চিত করা,
পিএসসি সনদ যাতে সহজে শুধুমাত্র উপজেলা-থানা শিক্ষা কর্মকর্তা সহজে
সংশোধন করতে না পারে তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা, যেসব শিক্ষার্থীর জন্ম ১-১-২০০৭ বা তার আগে (যেহেতু তারা ২০২২ সালে কমিশন
কর্তৃক পরিচালিত নিবন্ধন কার্যক্রমের আওতায় এনআইডি প্রাপ্ত হয়েছেন) তাদের ক্ষেত্রে
আবশ্যিকভাবে এনআইডি কার্ড লিপিবদ্ধ জন্ম তারিখ আমলে নিয়ে রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করা
এবং যেহেতু মাধ্যমিক পর্যায়ে রেজিস্ট্রেশনের ন্যূনতম বয়সসীমা ১৪ বছর, সেহেতু দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরবর্তীকালে অনুষ্ঠিতব্য হালনাগাদ
কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে নিবন্ধনের উদ্দেশ্যে জন্ম তারিখের সীমারেখা এমনভাবে
নির্ধারণ করতে হবে যেন ১৩+ বয়সি শিক্ষার্থীরা নিবন্ধনের আওতায় চলে আসে।
এদিকে, মুক্তিযোদ্ধা
বিষয় মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি যুগ্ম সচিব রথীন্দ্র নাথ দত্ত বলেন, ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) এ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের (জীবিত-মৃত)
পূর্ণাঙ্গ তথ্য সংবলিত ডাটাবেজ তৈরি করা হয়েছে। জীবিত ১ লাখ ২ হাজার
মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ৯৮ হাজার জনকে এমআইএস নম্বরসহ স্মার্টকার্ড এবং ডিজিটাল সনদ
প্রদান করা হয়। বাকি ৪ হাজার মুক্তিযোদ্ধার স্মার্টকার্ড বিতরণের অপেক্ষায় রয়েছে।
আর
ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব তানিয়া আফরোজ বলেন, জমি
রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আইন মন্ত্রণালয়ের একটি সমঝোতা
স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে যেখানে জমি ক্রয়-বিক্রয়ের সময় জাতীয় পরিচয়পত্র
বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। অনলাইন পরিচয়পত্রের মাধ্যমে ভূমি রেজিস্ট্রেশন করা যাবে
এবং জমি রেজিস্ট্রেশনের যেসব সীমাবদ্ধতা রয়েছে সেগুলোর কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
সভায় ভূমি রেজিস্ট্রেশন কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট
মন্ত্রণালয়-বিভাগ-দপ্তরের এনআইডির অনলাইন যাচাই নিশ্চিত করতে হবে ইসির সঙ্গে
স্বাক্ষরিত চুক্তির আলোকে।