মুজাহিদ সরকার: রমজানকে সামনে রেখে অত্যাবশ্যকীয় কৃষিপণ্যের সরবরাহ, মূল্য পরিস্থিতি স্থিতিশীল ও যৌক্তিক পর্যায়ে রাখতে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও সরকারি-বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে আলোচনা করে চাহিদা নিরূপণ করা হয়েছে।
রমজাননির্ভর ছয় পণ্য- ছোলা, পেঁয়াজ, ভোজ্যতেল, মসুর ডাল, চিনি ও খেজুরের চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে আছে পর্যাপ্ত মজুদ; যা চাহিদার তুলনায় বেশি। এ ছাড়া বিপুল পরিমাণ পণ্য আছে আমদানি প্রক্রিয়ায়। রাজধানীর খামারবাড়িতে গতকাল রবিবার ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে মতবিনিময়কালেই উঠে আসে এসব তথ্য। বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবদুল গাফ্ফার খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিভিন্ন সুপারশপ, বাজার ব্যবসায়ী সমিতির নেতা, ভোক্তা অধিকারের কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টরা বক্তব্য দেন।
সভা থেকে জানা যায়, কৃষক থেকে ভোক্তা পর্যন্ত কৃষি পণ্য পৌঁছতে অনেক হাত বদল হয়। এসব পণ্য যত হাতবদল হয়, ততই বাড়ে পণ্যের দাম। এ ছাড়া কৃষিপণ্য ঢাকায় পৌঁছতে পরিবহন টোল এবং চাঁদাবাজির শিকার হতে হয় ব্যবসায়ীদের। এ কারণেও কৃষিপণ্যের দাম বহুগুণে বেড়ে যায়। আসন্ন রমজানে বাজার স্থিতিশীল রাখতে পরিবহন টোল ও চাঁদাবাজি বন্ধের দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ী ও ভোক্তারা। তারা বলছেন, সাপ্লাই চেইন ঠিক রাখতে হবে। দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ আছে
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, রমজানে বাজার স্থিতিশীল রাখতে মূলত ব্যবসায়ীদের সদিচ্ছা জরুরি। ব্যবসায়ীদের নীতি-নৈতিকতা মেনে ব্যবসা করার জন্য আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটির মহাপরিচালক আবদুল গাফ্ফার খান বলেন, ব্যবসায়ীদের পণ্য ক্রয় রসিদ সংগ্রহ এবং দোকানে মূল্য তালিকা টানানো নিশ্চিত করতে হবে। রমজানে বাজার মনিটরিং জোরদার করা হবে। ভোক্তা অধিকারসহ বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে অভিযান পরিচালনা করা হবে।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (বাজার সংযোগ-০১) মো. মজিবুর রহমান। দেশে কোনো পণ্যেরই সংকট নেই উল্লেখ করে এ কর্মকর্তা জানান, দেশে প্রায় ৩ কোটি ৫০ লাখ টন চালের চাহিদা রয়েছে। বিপরীতে চালের উৎপাদন হয় ৩ কোটি ৭৬ লাখ টন। গত ১৫ মার্চ পর্যন্ত আমদানি হয়েছে প্রায় ৯ লাখ ৫৯ হাজার টন। গত ৯ মার্চ পর্যন্ত খাদ্যশস্যের সরকারি মোট মজুদ ১৯ লাখ ৩৩ হাজার টন। এর মধ্যে চাল ১৭ লাখ ৭৬ হাজার টন, গম ২ লাখ ২০ হাজার টন এবং ধান ৩৭ হাজার টন।
দেশে পেঁয়াজের চাহিদা, উৎপাদন ও আমদানির চিত্র তুলে ধরে বিপণন অধিদপ্তরের এ কর্মকর্তা জানান, দেশে প্রায় ২৫ লাখ টন পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে শুধু রমজান মাসেই চাহিদা ৪ থেকে সাড়ে ৪ লাখ টন। স্থানীয়ভাবে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৩৫ লাখ ৪ হাজার টন। আমদানি হয় প্রায় ৬-৭ লাখ টন। স্থানীয় উৎপাদিত পেঁয়াজ সংরক্ষণকালে প্রক্রিয়াজাতকরণ ক্ষতি প্রায় ২৫ শতাংশ। আর আমদানিকৃত পেঁয়াজে প্রক্রিয়াজাতকরণ ক্ষতি প্রায় ৮-১০ শতাংশ। তিনি আরও জানান, দেশে প্রায় ২০ লাখ টন ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে রমজানে চাহিদা আড়াই লাখ থেকে ৩ লাখ টন। স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হয় ২ লাখ ৩ হাজার টন। আমদানি হয় প্রায় ১৮ লাখ টন। অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের আমদানি প্রায় ৫ লাখ টন। সয়াবিন বীজের আমদানি হয় প্রায় ২৪ লাখ টন। যা থেকে ৪ লাখ টন অপরিশোধিত তেল হয়। অপরিশোধিত পাম তেলের আমদানি হয় প্রায় ১১ লাখ টন। আর অপরিশোধিত তেল আমদানিতে শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে ২০ শতাংশ।
মো. মজিবুর রহমান আরও জানান, দেশে প্রায় ১৮ লাখ টন পরিশোধিত চিনির চাহিদা রয়েছে। রমজান মাসে এর চাহিদা ৩ লাখ টন। দেশে গত দুই মাসে ৪ লাখ ৮৮ হাজার টন অপরিশোধিত চিনি আমদানি হয়েছে। যা গতবছরের এ সময়ের তুলনায় ২ লাখ ৬০ হাজার টনই বেশি। সুতরাং চিনির কোনো সংকট নেই।
একইভাবে তিনি রমজানে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত মসুর ডাল, ছোলা, খেজুর, অন্যান্য পণ্যের তথ্য বিবরণ তুলে ধরে বলেন, এসব পণ্যের কোনো ঘাটতি নেই দেশে। একইভাবে শাকসবজি ও আলু উৎপাদনসহ সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরে কিছু সুপারিশ করেন এ কর্মকর্তা। সেগুলো হলো- সমুদ্র ও স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ এবং শুল্ক স্টেশনগুলো পবিত্র রমজানকে সামনে রেখে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য খালাসে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকা প্রদান; নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে ফেরি পারাপারে বিআইডব্লিউটিসি কর্তৃক সর্বোচ্চ অগ্রাধিক প্রদান; নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট জেলা পুলিশ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সহায়তা প্রদান; জেলা ও উপজেলা প্রশাসন টিসিবির কার্যক্রম সার্বিক সহযোগিতা; ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরসহ ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিক্ষণ অধিদপ্তর এবং জেলা ও উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ; কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি ও মজুদকারীর বিষয়ে বিভিন্ন গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধ এবং সর্বোপরি বাজার মনিটরিং কার্যক্রম জোরদারকল্পে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার সুপারিশ করা হয়।
বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে বলেন, পবিত্র রমজান মাসে মানুষ যাতে স্বস্তিতে রোজা রাখতে পারেন, এ জন্য আপনাদের ভাবতে হবে। তিনি বলেন, বাজার যেন এখন হাসছে। বাজারে প্রচুর জিনিস। সবকিছুই এখন পাওয়া যাচ্ছে। বাজার অনেক স্বস্তির মধ্যে আছে। তবে আমাদের কৃষক যেন ন্যায্যমূল্য পান এবং পণ্য যাতে ভোক্তার ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকে দুটিই ভাবতে হবে। পণ্যের কৃত্রিম সংকট বা মজুদ যেন আমরা না করি। প্রয়োজনে অতিরিক্ত জিনিস যাতে আমরা না কিনি। একটা জিনিস ভাবতে হবে, আমার কারণে যেন বাজারে চাপ সৃষ্টি না হয়। আর রমজানে মালামাল বা পণ্য সরবরাহ যাতে গতিশীল থাকে এ জন্য বন্দর এবং পুলিশ প্রশাসন আমাদের সহায়তা করবে আশা করি।
যত হাতবদল হয় পণ্যের দাম তত বাড়ে উল্লেখ করে তিনি বলেন, নরসিংদীতে এক কেজি আলু কৃষক যে দামে বিক্রি করেন, ঢাকায় তা বহুগুণে কিনতে হয়। মাঝখানে অনেক হাতবদল হয়। আমরা চেষ্টা করছি মধ্যস্বত্বভোগী বাদ দিয়ে কৃষক যাতে সরাসরি তার পণ্য বিক্রি করতে পারে। এজন্য অ্যাপস্ ডেভেলপের কাজ চলছে। ইতোমধ্যে টেন্ডারও হয়েছে। আশা করছি এ অ্যাপস্টি ব্যাপক সাড়া পাবে।