কক্সবাজারের উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের ১৫নং জামতলী রোহিঙ্গা
ক্যাম্পকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে মাদক ও স্বর্ণ চোরাচালান চক্র। রোহিঙ্গাদের
ব্যাপকভাবে অনুপ্রেবেশের অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশে সক্রিয় ছিল নবী হোসেনের গড়ে
তোলা এই চক্র। উখিয়া-টেকনাফের হোয়াইক্যং, উলুবনিয়া, পালংখালীর
আঞ্জুমান পাড়া ও নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম তুমব্রু ও রেজু আমতলী সীমান্ত ব্যবহার করে
ইয়াবা, মদ, বিয়ার ও স্বর্ণ পাচার করে
আসছে নবী হোসেন চক্র।
নবী হোসেনের চোরাচালান চক্রের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের
সন্ত্রাসী গ্রুপের কাছে অস্ত্র বিক্রির অভিযোগ রয়েছে। বিভিন্ন সময় পুলিশ, বিজিবি, র্যাব, কোস্টগার্ডসহ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ
অধিদপ্তরের হাতে আটক একাধিক মাদক ও স্বর্ণ পাচারকারীকে আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদে উঠে
এসেছে নবী হোসেন, মোবাশ্বর, ফয়সালসহ
শতাধিক গডফাদারের নাম। সীমান্তে মাদকসহ নানা অপরাধ দমনে নবী হোসেনকে জীবিত অথবা
মৃত ধরে দিতে পারলে ১০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড
(বিজিবি)। এর পর থেকে নবী হোসেন মিয়ানমারের সীমান্তে আত্মগোপনে থেকে মাদক কারবার
চালিয়ে গেলেও রোহিঙ্গা ক্যাম্পভিত্তিক মাদক চোরাচালান ও অপরাধ সাম্রাজ্য গড়ে
তুলেছে নবী হোসেন গ্রুপের সেকেন্ড-ইন কমান্ড মোবাশ্বর। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা
অনুপ্রেবেশের সময় সপরিবারে মোবাশ্বর মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশের উখিয়ার পালংখালী
জামতলী ১৫নং ক্যাম্পের সি-ব্লকে আশ্রয় নেয়। মিয়ানমারের কোয়াচিবং এলাকার রহিম বক্স
ও সাজেদা বেগমের বড় ছেলে মোবাশ্বর। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় গ্রহণের এক বছর না
পেরোতে নবী হোসেন গ্রুপের হাত ধরে জড়িয়ে পড়ে অপরাধ জগতে। সে থেকে মিয়ানমার সীমান্ত
দিয়ে ইয়াবা ও স্বর্ণ নিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দিত মোবাশ্বর ও তার
অপরাপর সহযোগীরা।
সর্বশেষ ২০১৮ সালে মিয়ানমার থেকে অবৈধপথে আনা ১০টি স্বর্ণের
বারসহ মোবাশ্বর চট্টগ্রাম কোতোয়ালি থানাস্থ ডিবি পুলিশের হাতে আটক হন। আটক পরবর্তী
জিজ্ঞাসাবাদ শেষে মামলা দায়ের করে মোবাশ্বরকে জেল হাজতে পাঠায় কোতোয়ালি থানার
পুলিশ। ওই মামলায় ৭ মাস কারাভোগের পর ২০১৯ সালে জামিনে মুক্ত হয়ে আবারও
চোরাকারবারে জড়িয়ে পড়ে মোবাশ্বর। মোবাশ্বর এরই মধ্যে সুকৌশলে বাংলাদেশি
জন্মনিবন্ধন,
ভোটার আইডি কার্ড ও পাসপোর্টের মালিক বনে গেছেন, যেখানে বাংলাদেশে জন্ম গ্রহণকারী স্থানীয় বাসিন্দাদের পাসপোর্ট করতে গেলে
হিমশিম খেতে হয়। সেখানে রোহিঙ্গা মোবাশ্বর কোনো অদৃশ্য ছায়ায় বাংলাদেশের পাসপোর্ট
পেল সেটা এখনো অজানা।
মোবাশ্বরের ছোট ভাই মৌলবি ফায়সালের বসবাস পালংখালীর
শফিউল্লাহ কাটা ১৬নং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অ-৬ ব্লকে। মৌলবি ফয়সাল মাদরাসা প্রতিষ্ঠা
করে ওই ব্লকে লোকচক্ষুর অন্তরালে গড়ে তুলেছেন বিশাল মাদক সিন্ডিকেট। মোবাশ্বরের
মাদক ও স্বর্ণের চোরাচালান বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দিতে কাজ করে তারই
আপন ভাই মৌলবি ফয়সাল। মৌলবি ফয়সাল বাংলাদেশি পাসপোর্ট ব্যবহার করে সৌদি আরব গিয়ে
মসজিদ, মাদরাসার
নাম দিয়ে লাখ লাখ টাকা চাঁদা উত্তোলন করে নিজে আত্মসাৎ করে। মৌলবি ফয়সালেরও রয়েছে
বাংলাদেশি পাসপোর্ট।
মোবাশ্বর জেলে থাকাকালীন মাদক ও স্বর্ণ ব্যবসার যাবতীয়
চোরাই কারবার পরিচালনা করত তারই আপন ভাই ক্যাম্প-১৫ তে বসবাসরত কায়সার। কায়সার
ইয়াবাসহ আটক হয়ে দীর্ঘদিন জেল-হাজতে ছিল, ইয়াবাসহ পুলিশের কাছে ধরা পড়ে মিথ্যা তথ্যে
হেলাল নাম লিপিবদ্ধ করেন এজাহারে, যাতে সহজে জামিনে আসা যায়
এবং এতে ঠিকানা উল্লেখ করেন বালুখালী। গত বছর জামিনে এসে আবারও রোহিঙ্গা ক্যাম্প
কেন্দ্রিক অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে কায়সার উরফে হেলাল।
মোবাশ্বরের বড় বোন ক্যাম্প-১৬ তে বসবাসরত জান্নাত আরা
প্রকাশ জন্নতি ও তার প্রবাসী বড় ভাই ফেরদৌসের স্ত্রী মিয়ানমার কোয়াচিবং এলাকার
মোস্তাফিজুর রহমানের মেয়ে বুলবুল প্রকাশ বুলবুলিকে দিয়ে শরীরে লুকিয়ে ইয়াবা পাচার
করে থাকে দেশের বিভিন্ন জায়গায়। তাদের ইয়াবা ও স্বর্ণ পাচারের প্রধান টার্গেট
বয়স্ক মহিলা,
যাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহজে ফাঁকি দেওয়া যায়। তাদের দিয়ে
কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের ভিআইপি হোটেলগুলোতে অল্প বয়সি রোহিঙ্গা তরুণী (যৌনকর্মী)
সরবরাহ করে থাকেন বলে জানিয়েছেন ক্যাম্পের একাধিক রোহিঙ্গা নেতা।
গত ৫ বছর ধরে ইয়াবা গডফাদার মোবাশ্বর নানা অপকর্ম করে গেলেও
তার বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পায় না, কেউ প্রতিবাদ করলে রাতের আঁধারে নবী হোসেন
গ্রুপের সদস্যরা তুলে নিয়ে গিয়ে অকথ্য নির্যাতন করে।
মোবাশ্বরের মাদক কারবার ও ক্যাম্পে খুন, গুমে জড়িত থাকার বিষয়ে ১৫নং
রোহিঙ্গা ক্যাম্পের চেয়ারম্যান হাবিবের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, রাতে ক্যাম্পে বহিরাগতদের আনাগোনা চোখে পড়ে, তবে এরা
কারা চিহ্নিত করা যাচ্ছে না, মাঝে মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর
অভিযানে গুটিকয়েক অস্ত্রধারী মাদক কারবারি আটক হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে
প্রকৃত অপরাধীরা।
১৬নং ক্যাম্পের চেয়ারম্যান সুরত আলম এই প্রতিবেদককে বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অপরাধে
জড়িতদের তালিকা করে আমর্ড পুলিশকে দেওয়া হয়েছে ওনারা তদন্তসাপেক্ষে ব্যবস্থা নেবেন
বলে আমাদের আশ্বস্ত করেছেন।
৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সহকারী পুলিশ সুপার
মোহাম্মদ ফারুক আহমেদ বলেন,
তার বিরুদ্ধে মাদক, স্বর্ণ, সন্ত্রাসী কার্যক্রমের অভিযোগ রয়েছে, তাদের ধরতে
আমাদের একাধিক টিম কাজ করছে।
পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান গপুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, খালি গায়ে, খালি হাতে মিয়ানমার থেকে ২০১৭ সালে ৭ লাখের অধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ
করলেও ৫ বছরের ব্যবধানে মাদক, স্বর্ণ চোরাচালান ও মানব পাচার
করে বেশিরভাগ রোহিঙ্গা কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন, তারা
ক্যাম্পের বাইরে এসে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। অবৈধভাবে বাংলাদেশি পাসপোর্ট করে
রোহিঙ্গারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাচ্ছে যা অদূর ভবিষ্যতে এদেশের জন্য
অশনিসংকেত বয়ে আনবে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পের শীর্ষ অপরাধী মোবাশ্বর ও তার সহযোগীদের
গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনলে নবী হোসেন সিন্ডিকেটের অনেক স্পর্শকাতর গোপন তথ্য
পাওয়া যাবে বলে জানিয়েছেন সাধারণ রোহিঙ্গা ও পালংখালী ইউনিয়নের সুশীল সমাজের
নেতারা।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা
ওসি শেখ মোহাম্মদ আলী জানান, মোবাশ্বর ও তার সহযোগীদের গ্রেপ্তার করতে
আমাদের টিম মাঠে কাজ করছে।