- নুর মোহাম্মদ মিঠু, বিশেষ সংবাদদাতা : মালিক জমা, গ্যারেজ ভাড়া দারোয়ানের বেতন ও বোনাসের নামে ২১৩ কোটি টাকা বাড়তি আদায় ।
- চিঠি দেয়ায় শ্রমিক সংগঠনের কার্যালয় ভাঙচুর, সিএনজি অটো
থেকে নামিয়ে দেয়া হচ্ছে চালকদের, গ্রেপ্তার ও ক্রসফায়ারের হুমকি মালিকদের ।
- সরকারি নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চালক ও
যাত্রীসাধারণের পকেট কেটে সম্পদের পাহাড় গড়ছেন সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও গ্যারেজ
মালিকরা। অথচ যাত্রীসাধারণ জানছেন, সিএনজির চালকরাই পকেট কাটছেন তাদের। কিন্তু ঘটনা পুরোই তার উল্টো। সড়কে
যাত্রীদের পকেট কাটতে চালকদের বাধ্য করছেন মালিকরা। ঢাকার সিএনজি চালকরা বলছেন, সরকারি আইন অনুযায়ী দৈনিক ভিত্তিতে সিএনজির
মালিক জমা ৯০০ টাকা হলেও মালিকপক্ষ আদায় করছে এক হাজার ৩০০ টাকা। কোথাও কোথাও আদায়
করা হচ্ছে এক হাজার ৬০০ টাকাও। গ্যারেজভাড়া ও দারোয়ানের বেতনের নামেও চালকদের সাথে
মালিকরা করছেন চাঁদাবাজি।
বেশ ক’বছর ধরে এভাবেই চালকদের জিম্মি করে বাড়তি টাকা আদায় করছেন মালিকরা। চালকদের
কাছ থেকে বছরের পর বছর এভাবে চাঁদাবাজির মাধ্যমে আদায় করা বাড়তি অর্থ ফেরত চেয়ে
মালিকপক্ষকে সম্প্রতি চিঠি দেয় ঢাকা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়ন। চিঠিতে কাউকে ২০
রমজান কাউকে গেল ২২ রমজানের আগে চাঁদাবাজির মাধ্যমে আদায় করা বাড়তি অর্থ ফেরত দিতে
বলা হয়। যদিও এখন পর্যন্ত কোনো একজন মালিক সেসব অর্থ ফেরত দেননি; বরং ঈদ বোনাসের নামেও চালকদের কাছ থেকে আদায়
করা মোটা অঙ্কের অর্থ লুটে খাচ্ছেন তারা এবং চিঠি ইস্যুর পর থেকেই চালকদের নামিয়ে
দেয়া হচ্ছে, ভাঙচুর করা হচ্ছে শ্রমিক ইউনিয়নের কার্যালয়।
জানা গেছে, চালকসহ শ্রমিক নেতাদেরও গোয়েন্দা পুলিশ দিয়ে
গ্রেপ্তার করিয়ে ক্রসফায়ারে দেয়ার হুমকিও দিচ্ছে মালিকপক্ষ।
ঢাকা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের চিঠিতে জানা যায়, ঢাকার উত্তর বাড্ডা ঝিলপাড়ের সিএনজি ও গ্যারেজ
মালিক বাবুল মিয়া ও আমির হোসেন। ২০১৫ সালের ১ নভেম্বর থেকে চলতি বছরের মার্চ
পর্যন্ত যারা দুই হাজার ৬৯০ দিনে সরকার নির্ধারিত মালিক ভাড়ার থেকেও ৪০০ টাকা করে
বাড়তি আদায়ের মাধ্যমে গাড়িপ্রতি ১০ লাখ ৭৬ হাজার টাকা বেশি আদায় করেছেন। ২২টি
সিএনজি থেকে দুই কোটি ৩৬ লাখ ৭২ হাজার টাকা অতিরিক্ত আদায় করেছেন তারা। এ ছাড়া
গ্যারেজ ভাড়া ও দারোয়ানের বেতনের নামেও গাড়ি প্রতি ৪০ টাকা করে এক লাখ সাত হাজার
টাকা অতিরিক্ত আদায় করেন। এ ক্ষেত্রে ২২টি গাড়ি থেকে অতিরিক্ত আদায় করেছেন ২৩ লাখ
৬৭ হাজার টাকা। এ ছাড়া ঈদ বোনাসের নামেও প্রতি গাড়ি থেকে আড়াই হাজার টাকা করে ২২টি
গাড়ি থেকে ৫৫ হাজার টাকা আদায় করেছেন। সরকারি আইন অমান্য করে ২২টি গাড়ি থেকে সব
মিলিয়ে আদায়কৃত দুই কোটি ৬০ লাখ ৯৪ হাজার টাকার পুরোটাই ২২ রমজানের মধ্যে নিজ নিজ
চালককে ফেরত দিতে চিঠি দেয়া হলেও সেসব টাকা ফেরত দিতে অনীহা প্রকাশ করছেন বাবুল
মিয়া ও আমির হোসেন গং।
অনিয়মকে নিয়মে ফেরাতেই চিঠি দিয়েছি এরপরই
মালিকপক্ষের হামলা-হুমকি পাচ্ছি
—হানিফ খোকন, সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়ন
একইভাবে একই সময়ে ৮০টি গাড়িটি থেকে অতিরিক্ত ১৬
কোটি ৩৭ লাখ ৪০ হাজার টাকা আদায় করেছেন দক্ষিণ যাত্রাবাড়ীর বিদ্যুৎ গলির গ্যারেজ ও
সিএনজি মালিক হাজী বাবুল। ৫০টি গাড়ি থেকে অতিরিক্ত ৯ কোটি ৫৬ লাখ ২০ টাকা আদায়
করেছেন হাতিরঝিল গ্যারেজ পট্টি এলাকার মালিক বিল্লাল, ৫০টি গাড়ি থেকে এক কোটি ৬৫ লাখ ১৫ হাজার টাকা
আদায় করেছেন উত্তর বাড্ডা বাগানবাড়ী এলাকার মালিক আব্দুর রাজ্জাক, ৫০টি গাড়ি থেকে এক কোটি ৬৫ লাখ ১৫ হাজার আদায়
করেছেন উত্তর বাড্ডা বাগানবাড়ী এলাকার মালিক এনামুল হক ডালিম, ৮০টি গাড়ি থেকে ১৬ কোটি ৩৭ লাখ ৫২ হাজার টাকা
আদায় করেছেন যাত্রাবাড়ীর বিদ্যুৎ গলি এলাকার মালিক ইসমাইল-মহিউদ্দিন-মিজান ও জহির, ১১০টি গাড়ি থেকে চার কোটি ২১ লাখ ৭৬ হাজার টাকা আদায় করেছেন উত্তর বাড্ডার
বাগানবাড়ী এলাকার মালিক দেবাশীষ, ৪০টি গাড়ি থেকে সাত কোটি ৬৪ লাখ ৯৬ হাজার টাকা আদায় করেছেন রামপুরার ওয়াপদা
এলাকার মালিক সাবের মিয়া, ৮০টি গাড়ি থেকে ১৫ কোটি ২৯ লাখ ৯২ হাজার টাকা
আদায় করেছেন ওয়াপদা রোড এলাকার মালিক মনির মিয়া, ২০টি গাড়ি থেকে ৫৯ লাখ ৬৮ হাজার টাকা আদায় করেছেন ওয়াপদা রোড এলাকার মালিক
হিমায়েত শেখ, ৩৭টি গাড়ি থেকে সাত কোটি ৫৭ লাখ ৩৫ হাজার আদায়
করেছেন রামপুরার পূর্ব হাজীপাড়ার মালিক নজরুল ইসলাম পিন্টু, ১২০টি গাড়ি থেকে ৪০ কোটি ৭০ লাখ ২৮ হাজার টাকা
আদায় করেছেন যাত্রাবাড়ীর মীরহাজিরবাগের মালিক মাহবুব, ৮০টি গাড়ি থেকে ১৮ কোটি ৯ লাখ ৬৮ হাজার টাকা
আদায় করেছেন একই এলাকার মালিক হুমায়ুন, ৪৫টি গাড়ি থেকে সাত কোটি ৯১ লাখ ৭৩ হাজার টাকা আদায় করেছেন একই এলাকার মালিক
জসিম, ৫৫টি গাড়ি থেকে চার কোটি ১৫ লাখ ৬৩ হাজার টাকা
আদায় করেছেন রামপুরার হাজীপাড়ার মালিক মোস্তফা, ৫৭টি গাড়ি থেকে চার কোটি ৩০ লাখ ৭৪ হাজার টাকা আদায় করেছেন রামপুরার পূর্ব
হাজীপাড়ার মালিক কামরুল, ৫০টি গাড়ি থেকে ১৩ কোটি ৫৭ লাখ ২৬ হাজার টাকা
আদায় করেছেন যাত্রাবাড়ীর মীরহাজিরবাগের মালিক দেলোয়ার, ৪৩টি গাড়ি থেকে তিন কোটি ৪৫ লাখ আট হাজার টাকা
আদায় করেছেন রামপুরার হাজীপাড়ার মালিক মুক্তার, ৭০টি গাড়ি থেকে ১০ কোটি ৫৮ লাখ ৯২ হাজার টাকা আদায় করেছেন দক্ষিণ যাত্রাবাড়ীর
বিদ্যুৎ গলির মালিক মমিন, ৮০টি গাড়ি থেকে ১৩ কোটি ৭৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা
আদায় করেছেন একই এলাকার মালিক জহির, ৭০টি গাড়ি থেকে ছয় কোটি ২৩ লাখ ১৪ হাজার টাকা আদায় করেছেন যাত্রাবাড়ীর ওয়াপদা
কলোনি গেটের মালিক পেয়ার আলী, ২৫টি গাড়ি থেকে দুই কোটি ৮৯ লাখ ৮০ টাকা আদায় করেছেন একই এলাকার মালিক জাকির, ৩৫টি গাড়ি থেকে পাঁচ কোটি ২৯ লাখ ৪৬ হাজার টাকা
আদায় করেছেন দক্ষিণ যাত্রাবাড়ীর মালিক আসাদ মিয়া।
জানতে চাইলে ঢাকা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের
সাধারণ সম্পাদক হানিফ খোকন বিডি টুডেসকে বলেন, ‘চিঠি দেয়ার পর এখন পর্যন্ত মালিকপক্ষের কেউই তাদের
কোনো চালককে এক পয়সাও ফেরত দেয়নি; বরং আমাদের যাত্রাবাড়ী কার্যালয়ে ভাঙচুর চালানো হয়েছে। বাড্ডা এলাকায় চালকদের
গাড়ি থেকে নামিয়ে দেয়া হচ্ছে। রামপুরায় বিভিন্ন হুমকি দেয়া হচ্ছে চালকদের। বলা
হচ্ছে ডিবি দিয়ে গ্রেপ্তার করাবে এবং আমাকেসহ চালকদের ক্রসফায়ারে দেবে।
ঢাকা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়ন থেকে চিঠি ইস্যুর
এখতিয়ার আছে কি-না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, অবশ্যই আছে। তা ছাড়া আমরা অনিয়মকে নিয়মে রূপ দেয়ার জন্যই চিঠি দিয়েছি। যার কপি
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ-বিআরটিএ, মালিক সমিতি ও ডিএমপি কমিশনারকেও দিয়েছি। আমরা মন্ত্রণালয় ও বিআরটিএকে অনুরোধ
করব, তারা যেন ব্যবস্থা নেয়। তিনি আরও বলেন, থানা পুলিশে আমরা এ সংক্রান্তে কোনো অভিযোগ
করলে ব্যবস্থাও নিচ্ছে না পুলিশ। অথচ মালিকপক্ষ এত সব অনিয়মের পরও উল্টো আমাদেরই
হয়রানি করা হচ্ছে। সিএনজি মালিকরা সহজেই থানা পুলিশকে ম্যানেজ করে নিচ্ছেন।