মাজহারুল ইসলাম মাসুম,সিনিয়র সাংবাদিক, লেখক, ও গবষেক :
সুফিবাদকে আরবিতে তাসাউফ বলা হয়। সুফি বলতে কাদের বুঝায় তথ্য উৎঘাটন করতে গিয়ে উইকিপিডিয়ায় পাওয়া যায়, সুফিদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, সেটা এক ভিন্ন ধরনের সন্ন্যাসবাদ। বিশেষত জিকিরের মাধ্যমে আল্লাহকে স্মরণ করা ও ঐকান্তিক চর্চার মাধ্যমেই ধর্মপালন। যা তারা নামাজের পরে করে থাকে। উমাইয়া খিলাফতের (৬৬১-৭৫০) জাগতিক দুর্বলতার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া স্বরূপ, মুসলিমের মধ্য থেকে উল্লেখযোগ্য হারে এই মতবাদের অনুসারী লাভ করে।
দুনিয়ার সকল দেশেই সুফিবাদের প্রসার হয়েছে ব্যাপক ভাবে। আজো তার সমৃদ্ধি চলছে। কিন্তু তাৎপর্যের ব্যাপার হল সুফিবাদের ‘সুফি’ শব্দের মূল ভাবার্থ কি? তা নিয়ে কথা হয়েছে বিস্তর কিন্তু মনের মত সমাধান পাওয়া যায়নি।
র বুঝায়
সুফি শব্দের চলমান ব্যাখ্যা
শব্দটির আভিধানিক উৎপত্তি নেওয়া হয়েছে ‘সাফা’ থেকে। যার আরবি অর্থ বিশুদ্ধতা বা পবিত্রতা বা শুদ্ধতা বা পাপশূন্যতা। হৃদয়কে পাপশূন্য করার জন্য তাজকিয়া তথা আত্মশুদ্ধির দরকার হয়। আত্মশুদ্ধির জন্য জিকির অপরিহার্য। এই ব্যাখ্যাটি আধুনিক যুগে বিশ্লেষণ করে বানানো এবং এটাকেই সঠিক মনে করে সুফিবাদ এগুচ্ছে। ফলে উইকিপিডিয়াতেও এটাকেই মূল কথা হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।
সুফি শব্দের প্রকৃত ব্যাখ্যা
সুফি শব্দটি খাঁটি আরবি। যার অর্থ হল ‘পশম’। কিন্তু ‘সুফি’ শব্দ সাধারণ পশমের ক্ষেত্রে ব্যবহার হয় না। একেবারেয় খাটি বিশুদ্ধ পশমকে বুঝিয়ে থাকে। তাই অনেকে এই শব্দ দিয়ে সুফিবাদকে মূল্যায়িত করে থাকে। তারা এই শব্দটির মর্মার্থ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলে থাকেন, ‘সুফি’ শব্দটি দিয়ে পশমের গুন বুঝিয়ে থাকে এবং সুফিরাও গুনের কারণে পরিচিত। তাই সুফি মানে বিশুদ্ধ সাধক আর সুফি সাধনা মানে বিশুদ্ধতার সাধনা।
ধারণাগত ব্যাখ্যা
আবার কেউ কেউ সুফি শব্দটিকে আরবি ‘সফা’ শব্দের সঙ্গে জুড়ে দেন। রাসুল (সা) এর সাথীদের মধ্যে কেউ কাছাকাছি থাকতেন। এমন সাহাবীদের ‘আহল-উসসুফফা’ বলা হত। অনেকেই ব্যাখ্যা দেন রাসুল (সা) এর সাথীদের মত চরিত্র-জীবন যাদের প্রকৃতপক্ষে তারাই ‘সুফি’ বলে মতামত দিয়ে থাকেন। সুফি বলতে কা
দের বুঝায়
দার্শনিক আল-বেরুনীর ব্যাখ্যা
সুফিবাদ ও সুফি সম্পর্কে পরিষ্কার ও গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যাটি দিয়েছেন, জগৎবিখ্যাত গণিতজ্ঞ ও ইসলামী দার্শনিক “আবু রায়হান আর বিরুনী” (৯৭৩-১০৫০) তাঁর রচিত বিখ্যাত গ্রন্থ “আল কিতাবুল হিন্দ” গ্রন্থে। সুফিবাদের প্রচার প্রসার যখন মধ্যগগনে ইসলামের সেই সোনালী যুগে জগৎবিখ্যাত দার্শনিক আল বেরুনীর জন্ম। চলুন সরাসরি তাঁর কিতাব থেকেই বিষয়টি দেখি।
আল বেরুনীর ভাষায়, সুফি শব্দটি এসেছে ইউনানি (গ্রীক) ভাষা হতে। কেননা গ্রীক ভাষায় ‘সুফ’ শব্দের অর্থ প্রজ্ঞা (সুফিয়া)। আর গ্রীক ভাষায় ‘ফিলোসফার – philosopher (দার্শনিক) কে পিলোসোপা (philosophos-ফিলোসোপস) তথা প্রজ্ঞাবান বলা হয়। দর্শন, দার্শনিক শব্দগুলো গ্রীকে দেশে খুবই সম্মানিত ও ব্যবহৃত শব্দ। তাই মুসলিম শাসনামলেও লোকেরা গ্রীক দার্শনিকদের সিদ্ধান্তের সঙ্গে মিলিতভাবে নিজেরাও ‘সুফি’ তথা প্রজ্ঞাবান তথা দার্শনিক শব্দটিকে গ্রহণ করেছেন।
আর বেরুনীর মতে ‘সুফি’ শব্দকে বিশুদ্ধ পশমের সাথে মিলিয়ে যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, সেটা আবু ফাতহ আল কুস্তানির ব্যাখ্যা। সুফি শব্দটি যে গ্রীক থেকে এসেছে এ ব্যাপারে তিনি শক্ত অবস্থান নিয়েছেন এবং অন্য কোন ব্যাখ্যা তিনি মানতে রাজী নন। তথ্য সূত্র ভারততত্ত্ব-৩৭
উল্লেখ্য, উমাইয়া শাসন পরবর্তী আব্বাসীয় শাসনামলে প্রচুর গ্রীক সাহিত্য আরবিতে অনুবাদ হয়। সে থেকে দর্শন, গণিত সহ বহু-ধরনের বিষয়ের সাথে আরবিদের পরিচয় ঘটে। অধিকন্তু সে সময়ের মুসলমানেরা কোরআন-হাদিস-ফিকাহের বাহিরেও জ্ঞান অর্জনের নিমিত্তে পাগল পারা ছিল। তাদের অনেকেই গ্রীকের বৈষয়িক জ্ঞানের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠে। অন্যদিকে এই সময়টাই ছিল সুফিবাদের সূচনা যুগ। তার প্রায় আড়াই’শ বছর পরেই আল বেরুনীর জন্ম। ফলে তিনি সুফিবাদের জন্ম, উত্থান সম্পর্কে বর্তমানের অনেকের চেয়ে বেশী জানতেন। তাই ‘সুফি’ অর্থ প্রজ্ঞাবান কিংবা দার্শনিক আল বেরুনীর এই কথাটিই বেশী যুক্তিযুক্ত।